দেশের সময়, কলকাতা: কামদুনি ধর্ষণ এবং হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করল কলকাতা হাই কোর্ট। ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত সইফুল আলি এবং আনসার আলির সাজা বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করেছে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি অজয়কুমার গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ।

নিম্ন আদালতে আর এক ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আমিন আলি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অন্য দিকে, নিম্ন আদালতে আমৃত্যু জেলের সাজাপ্রাপ্ত ইমানুল ইসলাম, আমিনুর ইসলাম এবং ভোলানাথ নস্করও ১০ বছর জেল খাটার কারণে খালাস পেয়েছেন হাই কোর্ট থেকে।

২০১৩ সালে বারাসতের কামদুনিতে গণধর্ষণের ঘটনার ১০ বছর কেটে গেছে। এতদিন পর কলকাতা হাইকোর্টে সেই মামলার নিষ্পত্তি ঘটল। ঘটনার আড়াই বছরের মাথায় ৬জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করেছিল কলকাতা নগর দায়রা আদালত। ৩ জনের ফাঁসির নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। বাকিদের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় শুনিয়েছিল নিম্ন আদালতের বিচারক।

নিম্ন আদালতের সাজা মুকুবের আবেদন জানানো হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানি চলছিল। শুক্রবার সেই মামলায় রায় দিল হাইকোর্ট। 


ডিভিশন বেঞ্চ রায়ে জানায়, অভিযুক্ত সইফুল আলি ও আনসার আলির ফাঁসির সাজা রদ করা হল। তার বদলে তাদের আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হল। সেইসঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করল হাইকোর্ট। 

বাকি চার অভিযুক্তর মধ্যে আমিন ইসলাম আলিকেও ফাঁসির সাজা দিয়েছিলেন নিম্ন আদালতের বিচারক। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে আমিন বেকসুর খালাস পেল। অন্য অভিযুক্ত  ইমানুল হক, ভোলানাথ নস্কর ও আমিনুল ইসলামকেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই রায়ে হাইকোর্ট জানিয়েছে, অন্য তিন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা করা হয়েছিল, তার সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর। যেহেতু তারা ইতিমধ্যেই ১০ বছর জেল খেটেছে, তাই তাদের খালাস করা হল। তবে ১০ হাজার টাকা বন্ডে মুক্তি পাবে চারজন।  

২০১৩ সালের ৭ জুন কলেজ থেকে ফেরার পথে এক ছাত্রীকে উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনিতে ধর্ষণ করে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল। সেই ঘটনা নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা রাজ্য। দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের মতো তার ঢেউ পৌঁছয় দেশের অন্যান্য প্রান্তেও। দোষীদের চরম সাজার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কামদুনি সফরের সময় তাঁর সামনে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মৌসুমী ও টুম্পা কয়াল। শুক্রবার রায় ঘোষণার পরে মৌসুমী বলেন, ‘‘আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাব। নির্ভয়া-কাণ্ডের আইনজীবীর সাহায্য নেব।’’

প্রাথমিক ভাবে পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও এর পরে ঘটনার তদন্তের ভার পায় সিআইডি। চার্জশিটে অভিযোগ আনা হয় ন’জনের বিরুদ্ধে। বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন গোপাল নস্কর নামে এক অভিযুক্তের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি কলকাতার নগর দায়রা আদালতের (ব্যাঙ্কশাল কোর্ট) বিচারক সঞ্চিতা সরকার দোষী ছ’জনের শাস্তি ঘোষণা করেন। এদের মধ্যে সইফুল আলি মোল্লা, আনসার আলি এবং আমিন আলিকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। বাকি তিন অপরাধী শেখ ইমানুল ইসলাম, আমিনুর ইসলাম এবং ভোলানাথ নস্করের হয় আমৃত্যু জেলের সাজা। প্রমাণের অভাবে মুক্তি দেওয়া হয় অন্য দুই অভিযুক্ত রফিক গাজি এবং নুর আলিকে।

ব্যাঙ্কশাল আদালতে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত সইফুল, আনসার এবং আমিনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৬-এ, ৩৭৬-ডি, ৩০২, ১২০ বি এবং ২০১ ধারায়। ওই ধারাগুলিতে ন্যূনতম সাজা ২০ বছরের কারাদণ্ড। মূল অভিযুক্ত সইফুলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দু’টি ধারাও ছিল— ১০৯ এবং ৩৪২। অন্য দিকে, আমৃত্যু জেলের সাজাপ্রাপ্ত ইমানুল, আমিনুল এবং ভোলাকে ৩৭৬ ডি, ১২০ বি এবং ২০১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন বিচারক সঞ্চিতা।

বিচারক সঞ্চিতা তাঁর রায় ঘোষণার সময় জানিয়েছিলেন, এমন নৃশংস অপরাধ বন্ধ করার জন্য সমাজকে কড়া বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে এই ধরনের অপরাধকে আড়াল করা না-হয়। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘এমন অপরাধের প্রবণতা অঙ্কুরেই বিনাশ করা দরকার। তা না-হলে এই অপরাধ সমাজে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে।’’ সাজা ঘোষণার সপ্তাহ দুয়েক পরে ২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে সাজাপ্রাপ্তেরা সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি অজয়কুমার গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে অপরাধী ছ’জনের সাজা মকুবের সেই আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছিল।

বিগত প্রায় পাঁচ মাস ধরে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি হয়। ২৪ জুলাই বিচারপতি বাগচির ডিভিশন বেঞ্চে সেই মামলার শুনানি শেষ হয়। শুক্রবার সেই মামলার রায় দেওয়া হল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here