প্রদীপ দে, ঢাকা: বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্মের মানুষ শান্তি এবং সম্প্রীতির আবহে বসবাস করেন বলে দাবি করলেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর আসন্ন ভারত সফর প্রসঙ্গে সংবাদসংস্থা এএনআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনা জানান, দেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোনও অত্যাচার ঘটলে তাঁর দল এবং প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ করে।

সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে হাসিনাকে প্রশ্ন করা হয়। হাসিনা জানান, প্রতিটি দেশেরই এই ব্যাপারে ‘মহানুভবতা’ দেখানো উচিত। নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুজিব-কন্যা বলেন, “বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে বহু ধর্মের মানুষ বাস করেন। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকলেও একটা দু’টো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায়।” তবে ‘অনভিপ্রেত’ কিছু ঘটলে তাঁর সরকার এবং দল তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ করে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে বার্তা দিয়ে হাসিনা বলেন, “আমরা যখন থেকে ক্ষমতায় আছি, তখন থেকে দেশের সংখ্যালঘুদের বলেছি যে, আপনারা দেশের নাগরিক। আপনারা নিজেদের দেশেই বসবাস করছেন। নিজেদের দুর্বল বলে মনে করার কোনও কারণ নেই।”

রাষ্ট্রীয় সফরে ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধেয় দিল্লি যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভারত সফরের আগে হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের একাংশ।

৫ – ৮ সেপ্টেম্বর ভারতে থাকবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ভারত সফরে এসে একাধিক কর্মসূচি রয়েছে শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও একান্ত বৈঠকের পাশাপাশি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর দেখা হতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। তিস্তা জলবন্টন চুক্তির ক্ষেত্রে মমতার মতামত গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৯ সালে শেষবার ভারতে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেই দাবি করছেন অনেকে। সেখানে রাতারাতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ সেই জল্পনাতে আরও জোরাল ইন্ধন দিয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক সংকট পরিস্থিতির কথা অস্বীকার করেছে শেখ হাসিনা সরকার। এই আবহে দীর্ঘ তিন বছর পর হাসিনার এই ভারত সফর তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।

কার্যত বাংলাদেশ ও ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক জোরদার করাই প্রাধান্য পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে। সফরসূচি অনুসারে, ভারতের প্রধানামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৫ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন। সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অফ অনার প্রদান করা হবে। মহাত্মা গান্ধীর সম্মানে রাজঘাটে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন শেখ হাসিনা।

পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তাঁর সঙ্গে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

ঐতিহাসিক হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন তিনি। মোদীর দেওয়া রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন। দিল্লি অবস্থানকালে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। 

এ সময় কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (সিআইআই) কর্তৃক আয়োজিত বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাঁর যোগদানের কথা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদ ও আহত ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ২০০ জন সদস্যের বংশধরদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মুজিব বৃত্তি প্রদান করবেন। 

বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এই সফরের মধ্যে দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নতুন মোড় নিতে পারে। কূটনীতিকদের মতে, দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের বোঝাপড়া, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে জ্বালানি সহ নিত্যপণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট সংকট এবং বাংলাদেশ ও ভারতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হাসিনার সফরটিতে এবার বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় থাকা সমঝোতা স্মারক ও নবায়ন তালিকার মধ্যে রয়েছে-দুই দেশের স্টাফ কলেজের মধ্যে সহযোগিতা, বিচার বিভাগীয় সহযোগিতা ও কুশিয়ারা নদীর জল উত্তোলন। এ ছাড়া নবায়নের মধ্যে রয়েছে ব্লু-ইকোনমি নিয়ে সমঝোতা স্মারক। এ ছাড়া রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের দুটি সমঝোতা স্মারক হতে পারে। নেপালের জিএমআর কোম্পানির সঙ্গে ভারতের ওপর দিয়ে জলবিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হতে পারে। এবারের সফরে রূপসা নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজ হস্তান্তরসহ আরও প্রকল্প উদ্বোধন হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইউনিট-১।

সূত্রের খবর ,, দুই দেশের মধ্যে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) করার জন্য আলোচনা শুরুর বিষয়ে একটি ঘোষণা আসতে পারে। এই চুক্তি হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে একটি শক্ত কাঠামো দাঁড়াবে, যার অধীনে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। গম, পেঁয়াজসহ ভারত থেকে জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্য সরবরাহের বিষয়েও উভয় দেশের মধ্যে অঙ্গীকার হতে পারে। ভারতের ব্যবহার না হওয়া বিদ্যুৎ রপ্তানির অঙ্গীকার আসতে পারে। পাশাপাশি গম ও পেঁয়াজের মতো পণ্যগুলোর চাহিদা ভারতকে অগ্রিম জানালে তারা রপ্তানির ব্যবস্থা করতে পারবে এমন সমঝোতাও হতে পারে। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,২০১৫ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার লক্ষ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সই হয়েছিল। ওই চুক্তির আওতায় ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ওই ঋণ বাস্তবায়নের দিক নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভারতের ঋণের বাস্তবায়নে অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা আছে। এখন পর্যন্ত ৮০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে ভারত।  দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, কানেকটিভিটির দিকটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছে দিল্লি। দুই দেশের মধ্যে ১৯৬৫ সালের আগের যোগাযোগ ব্যবস্থা ফের চালু করতে চায় দিল্লি।

রেলওয়ের ক্ষেত্রে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, খুলনা-মংলা রেল সংযোগ এবং দুই দেশের মধ্যে নতুন ট্রেন মিতালি এক্সপ্রেস চালুতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ভবিষ্যৎ প্রকল্পের কথা আসতে পারে যৌথ ঘোষণায়।

ঢাকা ও দিল্লি­র কূটনৈতিক সূত্রের খবর,, গুরুত্ব পাবে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সহযোগিতা। কারণ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নানান ঘটনা প্রবাহে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সংকট তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো বিভেদ তৈরি করছে বিরোধের বাইরে থাকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও। এ ছাড়া বিশ্বের নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক যেন প্রভাবিত না হয় বা নতুন কোনও মোড় না নেয় সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ থাকবে ভারতে। বাংলাদেশও চাইবে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে সেখান থেকে উত্তরণে বিশেষ সহযোগিতা।

এসব কারণে এ সফরে ভারত বাংলাদেশের সহযোগিতার পাশাপাশি প্রাধান্য পেতে যাচ্ছে উপ-আঞ্চলিক যে কোনও পরিস্থিতিতে দুই দেশের অবস্থান, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বিরোধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি।

স্থিতিশীলতার স্বার্থে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হতে পারে। জানা যাচ্ছে, প্রায় তিন বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  এবারের ভারত সফর করতে যাচ্ছেন। যদিও দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের কোনও কমতি নেই, তার পরও বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে এ ধরনের সফর আর আয়োজিত নাও হতে পারে। এ কারণেই এই সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে দুই দেশের পক্ষ থেকেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৷

মোদী-হাসিনা সাক্ষাতে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে দেখুন এক নজরে –

১> মোদীর সঙ্গে আলোচনায় পরস্পরকে সামরিক সহায়তার প্রসঙ্গ উঠে আসতে পারে। একদিকে ছ’মাস ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অন্যদিকে তাইওয়ান নিয়ে চিনের চোখ রাঙানি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেই নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

২> ধাক্কার মুখে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোদী সরকার কতটা সাহায্য করে, সেই নিয়ে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই আর্থিক সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমফের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। চিন থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে শ্রীলঙ্কার যা পরিস্থিতি, তাতে বেজিংয়ের থেকে সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই ভারতের মুখাপেক্ষী। ভারত সরকার যেভাবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আইএমফের মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, বাংলাদেশ সরকারও ভারত থেকে সেই সাহায্য চাইছে। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।

৩> নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার জন্য ভারতীয় সড়কপথ ব্যবহার করতে চায় বাংলাদেশ। সেই নিয়ে মোদী-হাসিনা কথা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে নব-নির্মিত পদ্মা সেতুকে বন্দর থেকে পণ্য পরিবহণের কাজে ব্যবহার করতে আগ্রহী ভারত। আলোচনায় সেই দিকগুলিও উঠে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here