দেশের সময়: গ্রাম দখলের লড়াইয়ে রক্তের হোলি। বেলাগাম সন্ত্রাস। ভোট শুরুর আগে থেকে শুরু হওয়া সন্ত্রাসে ঝরে গেল ২৬ প্রাণ। ভোটের দিন নিহত ৬। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিহতের সংখ্যা। ভোট শুরুর আগে থেকেই পর পর খুন। বেলাগাম সন্ত্রাস। হিংসার নগ্ন নৃত্য। গণতন্ত্রের উৎসবে জেলায় জেলায় খুনোখুনি। পঞ্চায়েত ভোটের বাংলা যেন কুরুক্ষেত্র! শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদেই নিহত ৮। কোচবিহারে হত ৪। সকাল থেকেই রক্তে ভাসল বাংলা। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলার পঞ্চায়েত ভোটে সবচেয়ে বিপন্ন হল ব্যালট পেপার। অর্থাৎ যে কাগজে ভোটাভুটি হবে।

এই ঘটনাপ্রবাহের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল শুক্রবার রাতেই। বনগাঁ ব্লকের একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে শুক্রবার রাতে ক্ষুব্ধ জনতা প্রিসাইডিং অফিসারের থেকে ব্যালট পেপার ছিনতাই করে পুকুরে ফেলে দেয়। অভিযোগ, তাঁরা বিজেপির সমর্থক। পরে সকালে সেক্টর অফিসার সেখানে নতুন করে ব্যালট পেপার পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন।


আবার ডায়মন্ড হারবারের একটি বুথে দেখা যায়, ভোটাভুটির আগেই বেশ কিছু ব্যালট পেপারে ছাপ্পা পড়ে গিয়েছে। তাতে তৃণমূলের প্রতীক চিহ্নে ছাপ রয়েছে বলে অভিযোগ।

মুর্শিদাবাদ জেলার ফতেপুরে ব্যালট বাক্স পুকুরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। পরে পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুকুর থেকে ব্যালট বাক্স উদ্ধার করে।

জ্যাংড়া ও পাথরপ্রতিমায় প্রথমে দুষ্কৃতীরা বুথে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। তার পর ব্যালট বাক্স ঝোপের মধ্যে ফেলে দেয়। পরে পুলিশ এসে ব্যালট বাক্স উদ্ধার করে।

বিপন্ন ব্যালটের এই যে খণ্ডচিত্র দেখা যাচ্ছে, সেই সংখ্যা খুব কম নয়। অন্তত একশর বেশি বুথে ব্যালট লুঠ হয়েছে বা তা পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে বা আগুন লাগানো হয়েছে। রাজনৈতিক শিবিরের আশঙ্কা, ১১ তারিখ ভোট গণনার দিন এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে।

অন্যদিকে , পঞ্চায়েত ভোটেও হিংসার হটস্পট দিনহাটা। পিছিয়ে নেই মুর্শিদাবাদের রানিনগর। কোথায় পুলিশ? কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনী? প্রশ্ন উঠলেও মিলল না উত্তর। গ্রাউন্ড জিরোয় রাজ্যাপল সি ভি আনন্দ বোস। সাধারণ মানুষকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানান তিনি।

কোচবিহারের খাটামারিতে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে গেল ভোট। প্রায় একশো শতাংশ ভোট পড়ল এখানে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন ভোট দিতে পারলেন। বাকি সব ভোট লুট হয়ে গেল। সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরার সামনে ব্যালট লুটের কথা স্বীকার করলেও অভিযুক্তদের পরিচয় জানাতে পারলেন না প্রিসাইডিং অফিসার। গোটা বুথ ভাঙচুর করা হয়। ছিড়ে ফেলা হয় ব্যালট। বুথের মধ্যে রীতিমতো তাণ্ডব চলল। এখানে তৃণমূল বনাম বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের লড়াই। আক্রান্ত হন প্রিসাইডিং অফিসার।

নন্দীগ্রামে দেখা গেল পুলিশ অফিসারের পা জড়িয়ে ধরে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার দাবি জানাচ্ছেন ভোটাররা। কোচবিহারের ফলিমারিতে খুন হলেন বিজেপির পোলিং এজেন্ট। ভয়ের ভাঙড়ে চলল গুলি। তৃণমূল-আইএসএফ সংঘর্ষ। দিনহাটায় ব্যালট বাক্সে জল ঢেলে দেওয়া হল। বন্ধ হয়ে গেল ভোট। অভিযোগ, পুলিস ও বাইরে সিভিক দিয়ে ভোট চলছিল এখানে। 

তুলকালাম ভাঙড়। হাতিশালায় আইএসএফ প্রার্থীকে নিজের বাড়িতে আটকে রাখার অভিযোগ। তালা মেরে দেওয়া হয় গেটে। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। নিজের ভোট নিজে দিতে না পেরে হাতিশালায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখা যায় ভোটারদের। মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে খুনের বদলা খুন। আমডাঙার চণ্ডীগড় গ্রামের ৬৩ নম্বর বুথে টেবিলে বোমা রেখে অবাধে ভোট লুট। প্রিসাইডিং অফিসার জানান, ভোট শুরুর আধঘণ্টার মধ্যেই তৃণমূলিরা এসে সমস্ত ভোট লুট করে দেয়। দেদার বোমাবাজি হয় ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে ভোট শেষ হয়ে গেল এক ঘণ্টায়।

সকাল আটটার মধ্যে গালা দিয়ে সিল করে দেওয়া হল ব্যালট বাক্স। উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারে দু’টি বুথ থেকে প্রায় এক হাজার ব্যালট লুট। গোয়ালপোখর-১ ব্লকের শ্রীপুর ১৬৮ নম্বর বুথ থেকেও ব্যালট লুটের অভিযোগ। ইটাহারের দুর্গাপুর অঞ্চল, বোষ্টমতলার বুথে ছাপ্পা ভোট।

ভোট শুরুর আগেই মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় খুন তৃণমূল কর্মী। নাম বাবর আলি। শুক্রবার রাতে বেলডাঙার কাপাসডাঙা এলাকায় কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বাঁশ নিয়ে মারামারি চলে। দুই তৃণমূল কর্মী গুরুতর জখম হন। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। সেখানেই বাবরকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। দিনহাটার ওকরাবাড়ি পঞ্চায়েতের মহেশ্বর গ্রামে গুলি। হাফিজুর রহমান নামে বাম-কং জোটের কর্মী গুলিবিদ্ধ। ভোটের আগের রাতে সামশেরগঞ্জের শুলিতলায় ব্যাপক বোমাবাজি। কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ। বহু বাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর। প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকায় বালুরঘাটে জেলাশাসকের অফিসের সামনে বিক্ষোভ, ধর্না বিজেপির।

তুফানগঞ্জের রামপুর-১ পঞ্চায়েতের তৃণমূল কর্মী গণেশ সরকার খুন। খানাকুলের মাইনান গ্রামে বিজেপি প্রার্থী ও কর্মীদের মারধর। বিজেপির কার্যালয় ভাঙচুর। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের রাঙামাটি এলাকায় সিপিএম প্রার্থীকে মারধর। পোলিং এজেন্টকে বুথে ঢুকতে বাধা। মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু তৃণমূল কর্মীর। মৃতের নাম ইয়াসিন শেখ। বাড়ি নাজিরপুর এলাকায়। তিনি তৃণমূল প্রার্থীর শ্বশুর। ডোমকলে কুপিলা গ্রামে গুলি। জখম দুই তৃণমূল কর্মী। কৃষ্ণনগরের দোগাছি পঞ্চায়েতের পশ্চিম যাত্রাপুর বুথে বিজেপি কর্মীদের উপর হামলা। তিন বিজেপি কর্মী জখম। বিজেপি প্রার্থী রেবা বিশ্বাসের পরিবারের উপরও হামলা। চলল বোমা-গুলি।

চাপড়া থানার সুঁটিয়া গ্রামের বুথে বিরোধীদের এজেন্টকে ঢুকতে বাধা। মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জের ঘনশ্যামপুরে গুলিবিদ্ধ সিপিএম সমর্থক এক মহিলা। রানিনগরের কোমনগরের বুথে ব্যাপক বোমাবাজি। বেলডাঙার কাপাসডাঙায় দু’টি বুথে বসতে পারল না বিরোধী এজেন্ট। খড়গ্রামের রতনপুর গ্রামে তৃণমূল কর্মীকে গুলি করে খুন। মৃতের নাম রইসউদ্দিন শেখ। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরের ঘুঘুপাড়ায় চলল গুলি। উত্তর ২৪ পরগনার বিলকান্দায় অবাধে ছাপ্পা। তেহট্টের নাটনা পঞ্চায়েতের দু’টি বুথে প্রিসাইডিং অফিসার শাসকদলের হয়ে ছাপ্পা মারেন বলে অভিযোগ।

মুর্শিদাবাদের হুলাসপুরে বুথের বাইরে বোমাবাজির ঘটনায় জখম দুই। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরের হেরামপুরে বোমাবাজি। কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকায় হলদিয়ার দেভোগ পঞ্চায়েতের চাউলখোলা হরিপ্রিয়া স্কুলের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে তালা ঝোলালেন বিজেপির মহিলা মোর্চা। ফুলিয়ায় সাতটি বুথের এজেন্টকে মারধর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দিনহাটায় বুথের বাইরে ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে দেওয়া হল। রানিনগরে মুহুর্মুহু বোমা। ডায়মন্ডহারবারে ভোটকর্মীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দেদার ছাপ্পা। হলদিয়ায় ভোটকেন্দ্রে তালা। আরামবাগে আরান্ডি-১ সাতমাসায় পায়ে গুলি লেগে জখম নির্দল প্রার্থী।

চাপড়ার কল্যাণদহে কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘর্ষে তৃণমূল কর্মীর মৃত্যু। ডোমকলের জোতকোনাই এলাকায় তৃণমূলের হামলায় মাথা ফাটল সিপিএম কর্মীর। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর থানার মোল্লাডাঙার ঘুঘুপাড়ায় গুলি। নওদায় বোমাবাজি। বোমায় জখম কংগ্রেস কর্মী। বহরমপুরের রাজধরপাড়া পঞ্চায়েতের কাদামাটি বুথ থেকে বের করে দেওয়া হল সিপিএমের এজেন্টকে। রায়নার পলশনে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ। জখম। বাইরে লাঠি হাতে হামলাকারীরা। দিনহাটায় শিশু সন্তান সহ খাটের তলায় লুকোতে হল এক ব্যক্তিকে। ডোমকলের হরিশঙ্করপুরে তৃণমূল ও বামকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ। ময়ূরেশ্বরের কাঞ্চনা বুথে বিজেপির এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

কোচবিহার-১ ব্লকের পাটছড়ার কাসারটারিতে ভোট দিতে গিয়ে আহত বেশ কয়েকজন। তৃণমূলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ। সামশেরগঞ্জে গুলি। জখম তৃণমূল কর্মী সানাউল শেখ। ধানতলার দত্তপুলিয়া পঞ্চায়েতের কালোপুর ও নারায়ণপুরে উধাও ব্যালট বাক্স। আরামবাগে চোখে বোমার আঘাত নিয়ে হাসপাতালে আরান্ডি-১ পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান সোহরাব হোসেনের ছেলে শেখ জামির হোসেন।

পাণ্ডবেশ্বরের হরিপুরে বিজেপি প্রার্থীকে মারধর। আক্রান্ত তাঁর বাবাও। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে খুন সিপিএম কর্মী রাজিবুর হক। গোঘাট-১ ব্লকের ভাদুর পঞ্চায়েতের বাঘেরপাড় বুথ থেকে বিজেপি প্রার্থী ও এজেন্টদের বের করে দেওয়া হল। মুর্শিদাবাদের রানিনগর থানার মালিয়াড়ি-১ পঞ্চায়েতে আমিরাবাদ এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি। লালগোলার দু’টি বুথের ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে পালল দুষ্কৃতীরা। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে না, এনিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমতেই নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে এলেন বিএসএফের ডেপুটি কমান্ডার দিলীপ মালিক। 

পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরে আক্রান্ত সিপিএম প্রার্থী। জখম প্রার্থীর নাম শামসুল শেখ। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। নির্বাচনে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিতে চিঠি দিলেন আইনজীবী কৌস্তভ বাগচি। মালদহের রতুয়ায় চাঁদমনি-২ পঞ্চায়েতে কংগ্রেসের হামলায় মেজারুল হক নামে এক ভোটার জখম। বনগাঁর আকাইপুরের মেহেরপুর পঞ্চায়েতে একাধিক বুথে বিরোধীদের এজেন্টকে বসতে বাধা। বাগদার হেলেঞ্চা পঞ্চায়েতের মণ্ডপঘাটায় ৫০টি ব্যালট উধাও।

পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা-১ ব্লকের ৮ নম্বর বুথে সিপিএম প্রার্থীর চোখে ছিটিয়ে দেওয়া হল লঙ্কার গুঁড়ো। মথুরাপুর-১ লক্ষ্মীনারায়ণপুর শ্রীকৃষ্ণনগর এফপি স্কুলে ছাপ্পার অভিযোগ। হরিরামপুরের ভবানীপুর ৩ নম্বর বুথে ২৫০টি ব্যালট না থাকায় উত্তেজনা। ভোট বন্ধ। বীরভূমের মুরারইয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বুথ জ্যাম ও ছাপ্পার অভিযোগ।

বারুইপুরের হাড়দহতে আইএসএফ প্রার্থীকে মারধর। দিনহাটার কালীরপাড় স্কুলের বুথে গুলি। দুই বিজেপি কর্মী গুলিবিদ্ধ। এর মধ্যে একজন মহিলা। নদীয়ার মোহনপুরের বুথে বোমাবাজি। গুলি। ভাঙচুর করা হল চেয়ারটেবিল। ভগবানপুরের ছয়ানি পূর্বপাড়ায় বোমা ফেটে জখম দুই শিশু।

অভিযোগ, ভোট শুরু গেলেও অফিসে দেখা পাওয়া যায়নি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহার। কন্ট্রোল রুমে মুহুর্মুহু ফোন আসে। তা সামাল দিতে হিমশিম খান ১৫ জন অফিসার। বহু বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছয়নি বলে অভিযোগ আসতে থাকে। সকাল দশটার পর অফিসে আসেন নির্বাচন কমিশনার। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here