দেশের সময়: বাড়ির খাবারে চরম অ্যালার্জি! চিপস, বার্গার ছাড়া মুখে রোচে না! আপনার পরিবারের সবথেকে খুদে সদস্যটিও ফাস্ট ফুডে আসক্ত। দিনরাত মুখ চলছেই। তাও আবার ফল, সব্জি কিংবা বাড়ির রান্না করা খাবার নয়। মাইক্রোওয়েব পপকর্ন থেকে নিত্যনতুন চিপস। বাড়িতে তো বটেই, স্কুলের টিফিনেও সেগুলি চাই-ই চাই! স্কুল থেকে ফিরে হোক কিংবা কোচিং ক্লাসে যাওয়ার পথে একটু পেট ভরানো, বাবা-মা সন্তানের হাতে তুলে দেন পিৎজা, বার্গার নাহলে নামী ফুড চেনের ভাজাভুজি।

সকালের জলখাবারে এখন দই-চিড়ে উধাও। বদলে সন্তানের বায়না মেটাতে একগাদা ভাজা আর তেল-মশলার চটক।অধিকাংশ বাড়িতেই পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে মাখন, মেয়োনিজ, চিজে ডোবানো চপচপে খাবার। সঙ্গে সফ্ট ড্রিঙ্কস। ফলে চড়চড়িয়ে বাড়ছে মেদ।রোগ হানা দিচ্ছে বয়ঃসন্ধি থেকেই।
শুধু ছোটরা কেন, বড়রাও কম যান কীসে! কাজের ফাঁকে তাঁদেরও যে পছন্দের ফাস্ট ফুড। খেতে দারুণ লাগে আবার পেটও ভরে যায়। তবে পেট ভরাতে রান্না করার ঝামেলা থেকে চটজলদি এই সমাধানের পথ মোটেই সঠিক নয়। সহজ সমাধানেই ঘাপটি মেরে রয়েছে বিপদ। অতিরিক্ত ফ্যাট, গাদা গাদা প্রিজারভেটিভ এবং মাত্রাতিরিক্ত চিনি যুক্ত খাবার থেকেই দেখা দিচ্ছে ওবেসিটি সহ নানা অসুখ। নাগাড়ে এইসব খাবার খাওয়ার ফলে বেড়ে যাচ্ছে ওজন। অল্প বয়সেই পেটে ও কোমরে জমছে অবাঞ্ছিত মেদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার ফাস্ট ফুড খাওয়ার মাশুল গুণতে হতে পারে অকালে জীবন দিয়ে।একাধিক গবেষণা বলছে, টানা ফাস্ট ফুড খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
কখনও সময়ের অভাবে, কখনও আবার নিতান্তই শখের বশে আমরা অনেকেই প্রচুর ফ্যাটযুক্ত খাবার খেয়ে ফেলি। চিকিৎসকরা বলছেন, লাগাতার ফ্যাটি ফুড খেয়ে চললে পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট ক্যান্সারের আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকটাই।


রিপোর্ট বলছে, মাইক্রোওয়েব পপকর্নের কাগজের ঠোঙায় থাকে পেরফ্লুওরোকট্যানোইক অ্যাসিড, এই অ্যাসিড কিডনির অসুখ ও লিভারের সমস্যা এমনকী টেস্টিসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তাছাড়া মাইক্রোওয়েভ পপকর্নের মধ্যে থাকে প্রোপিল গ্যালেট নামে এক ধরনের পিজারভেটিভ ও ডায়াসোটিল নামে রাসায়নিক। ক্যান্সারের জন্য এগুলিও সমানভাবে দায়ী।
পট্যাটো চিপসে থাকে প্রচুর ফ্যাট ও ক্যালোরি। দীর্ঘদিন ধরে চিপস খেলে ওজন বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, যারা হটডগ, সসেজ জাতীয় খাবারে ডুবে থাকেন, তাদের ৪৪ শতাংশের ৫০ বছর কিংবা তার আগেই মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।


উচ্চ প্রক্রিয়াজাত ময়দায় থাকে গ্লাইসেমিক রাসায়নিক, যা ব্লাড সুগার ও ইনসুলিন লেভেলকে ক্ষতিকর মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এর থেকেও ক্যান্সার হতে পারে। রেড মিটে আসক্তি থাকলে তা ছাড়ার চেষ্টা করুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত রেড মিট কোলন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এড়িয়ে চলতে হবে রাসায়নিকযুক্ত ফল ও সব্জি। অ্যাট্রাজাইন রাসায়নিক ক্যান্সারের পরম বন্ধু। এটি অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভস্থ ভ্রুণের ক্ষতি করতে পারে। বাদ দিন প্রক্রিয়াজাত মাংসও। কারণ, ওই মাংসে মেশানো থাকে বিশেষ রাসায়নিক ও প্রচুর নুন, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো নয়।


পুষ্টিবিদরা বলছেন, রেড মিট মানেই কোলেস্টেরল।ফলে মেপে না খেলেই বাড়বে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড। দেখা দেবে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা। তাছাড়া প্রসেসড মিট বেশি খেলে পাকস্থলীতে কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করে। যা মাংসের কারনিটিন নামের উপাদানকে ভেঙে দিয়ে ট্রাইমিথাইল্যামিন যৌগে পরিণত করে। রক্তে শোষিত হয়ে এবং লিভারের বিপাক ক্রিয়ায় ভেঙে ট্রাইমিথাইল্যামিন এন অক্সাইডে পরিণত হয়, যা হার্টের সূক্ষ্ম রক্তনালিতে চর্বি জমিয়ে ইসকিমিক হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাস্ট ফুডের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার করা হয় গ্রিজ প্রুফ পেপার। এর মধ্যে থাকা ফ্লোরিনেটেড যৌগ বাড়িয়ে দেয় ক্যান্সারের ঝুঁকি। অতিরিক্ত চিনি দেওয়া সফ্ট ড্রিঙ্কস বিপাকের হার কমায়। হু হু করে মেদ জমতে থাকে শরীরে।


জাঙ্ক ফুডের খারাপ দিকগুলি আমাদের অজানা, তা নয়। এ ধরনের খাবার থেকে স্থূলত্ব, হজমের সমস্যা এসব তো রয়েইছে। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, দিনের পর দিন ফাস্ট ফুড ও ফ্যাটি ফুড খেয়ে চললে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ক্যান্সার।আমেরিকান ডায়েটারি অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য, দিনে ২ গ্রামের বেশি ট্রান্স ফ্যাট নৈব নৈব চ। তাহলেই বুঝুন, শুধু খেয়ে খেয়েই আমরা নিজেরা নিজেদের কতটা ক্ষতি করে চলেছি। তাই রোগ হওয়ার আগেই সতর্ক হোন। পুষ্টিবিদদের বক্তব্য, সব খাবারই খান, তবে মেপে।


মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল, এত অল্প বয়সে হৃদযন্ত্র বিকল হচ্ছে কেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় পাল্টেছে। বদলেছে খাদ্যাভাস, জীবনযাপন প্রণালী। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাজের চাপ। ইঁদুর দৌড়ে প্রথম হওয়ার প্রবণতা।আর এসবের জেরেই অল্প বয়সেই বিগড়ে যাচ্ছে হৃদযন্ত্র। বয়স না হতেই বাড়ছে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর সংখ্যা। তাই সতর্ক হতে হবে আজ থেকেই, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।


পুষ্টিবিদদের বক্তব্য, বেশিরভাগ জাঙ্ক ফুড ও ফ্যাটি খাবারে থাকে কর্ন সিরাপ, ফ্রুকটোজ, গ্লুকোজ, সুক্রোজ, ম্যালটোজ প্রভৃতি।এদের বলা হয় এম্পটি ক্যালোরি। এসবের আসলে কোনও পুষ্টিগুণ নেই। কিন্তু আপনার ওজন বাড়িয়ে দেবে। নষ্ট করবে দেহের বিপাক ক্রিয়ার ভারসাম্য।বেকন, সসেজ, হটডগের মতো প্রসেসড ফুড যেমন কোলন ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়, তেমনই বাড়িয়ে তোলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগের সম্ভাবনাও।

তাছাড়া প্রসেসড ফুডে থাকে অতিরিক্ত মাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট ও বিভিন্ন ধরনের প্রিজারভেটিভ। যা আমাদের শরীরকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। নানা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা অতিরিক্ত পরিমাণে প্রসেসড ফুড খান, তাঁরা বেশি মাত্রায় উদ্বেগ ও অবসানে ভোগেন।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অতিরিক্ত ভাজাভুজি, তেল-মশলাদার খাবার থেকেই সোফেগাল বা খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। মহিলাদের ক্ষেত্র বাড়ছে ওভারি ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের আশঙ্কা। অনেকেই রান্নায় সোয়া সস দিতে পছন্দ করেন।

এটি মোটেই বেশি খাওয়া ঠিক নয়।কারণ, এর মধ্যে থাকা সোডিয়াম বাড়িয়ে দেয় ক্যান্সারের ঝুঁকি। চরম ক্ষতিকর একটি প্রসেসড ফুড সালামি।এর মধ্যে প্রাকৃতিক কোনও পুষ্টিগুণ তো থাকেই না, বদলে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট ও নুন।যা শরীরে মারণ রোগ বাসা বাঁধার পরিবেশ তৈরি করে দেয়। স্টেক, এই খাবারটির প্রতিও অনেকের দারুণ আকর্ষণ। কিন্তু গবেষণা বলছে, পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে একেবারেই স্টেক খাওয়া চলবে না। নতুবা বেড়ে যেতে পারে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি। ব্রেক ফাস্টে যাঁরা পাউরুটিতে জঅ্যাম মিশিয়ে খেতে পছন্দ করেন, তাঁদের জন্যও রয়েছে সতর্কতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্যামে এমন কিছু প্রিজারভেটিভ মেশানো থাকে, যা আমাদের শরীরের জন্য মোটেই ভালো নয়। তাছাড়া জ্যামে থাকা সোডিয়াম পাকস্থলীর ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া মোটেই উচিত নয়।ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের মতে, এ ধরনের মাংস বেশি খেলে শরীরে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগের কোষ তৈরি হতে পারে। বর্জন করতে হবে প্যাকেটজাত চিপসও। যে প্রক্রিয়ায় ওই চিপস তৈরি করা হয়, তাতে তার মধ্যে অ্যাক্রিলামাইড রাসাইনিক তৈরি হতে পারে।এই রাসায়নিক সিগারেটের ধোঁয়াতেও পাওয়া যায়। বিভিন্ন শিল্প প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, অ্যাক্রিলামাইড ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, পেটে অতিরিক্ত মেদ জমার ফলেও ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বাড়তে পারে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বলছেন, ওবেসিটির ফলে ব্রেস্ট, প্রস্টেট, কোলন ও কিডনিতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

তাঁদের কথায়, পেটে জমা অতিরিক্ত ফ্যাটে এক ধরনের প্রোটিন থাকে।এনিয়ে তাঁরা ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালান। কিছুদিন পর দেখা যায় ইঁদুরগুলির মধ্যে এফজিএফ-২ প্রোটিন জমেছে। এই এফজিএফ-২ প্রোটিনের ফলে শরীরে টিউমার তৈরি হয়।এই প্রোটিনই আবার টিউমারের মধ্যে থাকা ক্যান্সারহীন কোষগুলিকে ক্যান্সার কোষে পরিণত করে। পেটের মেদের দু’টি স্তর থাকে। উপরের স্তরটি থাকে ঠিক ত্বকের নীচেই। পরের স্তরটি থাকে তারও নীচে, ওই স্তরের মেদ থেকেই ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে যায়। ফলে ক্যান্সার থেকে রেহাই পেতে জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলারই পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here