দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ অবশেষে পিছু হটছে চিনা ফৌজ। পূর্ব লাদাখে গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষস্থল এবং আরও দুই জায়গা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার পিছিয়ে গেছে চিনা বাহিনী। পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ ও গোগরা হট স্প্রিংয়ের কাছে তাদের তাঁবুগুলোও উধাও হয়েছে। গতকাল রাত থেকেই তল্পিতল্পা গুটোতে শুরু করেছে চিনের লাল ফৌজ, ভারতীয় সেনার দাবি এমনটাই।

গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ানের পিপি ১৪ এলাকায় ভারত ও চিন সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে দুই দেশের সেনাকর্তারা তিনবার বৈঠকে বসেন। শেষবার বৈঠক হয় ৩০ জুন। দুই দেশের কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের পরেও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি বলেই জানা যায়। গত ৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লাদাখ সফরের পর বরফ সামান্য গলে। কমিউনিস্ট চিনের নাম মুখে না আনলেও বেজিংকে কড়া বার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “সাম্রাজ্য বিস্তারের জমানা খতম হয়ে গিয়েছে। এখন উন্নয়নের জমানা। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয় পরাস্ত হয়েছে, কিংবা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।”সম্প্রতি চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই কে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ফোনের পর থেকেই পিছু হঠতে শুরু করে চিনা বাহিনী। সেনা সূত্রে জানানো হয়, দু’দেশের সেনার মধ্যে আপাতত তিন কিমি বাফার জ়োন থাকবে বলে ঠিক হয়েছে।

যে সব এলাকা থেকে সরেছে চিনা ফৌজ:

দুই দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ যেখানে হয়েছিল সেই পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ থেকে বাহিনী ও সাঁজোয়া গাড়ি সরিয়েছে চিন।

গোগরা হট স্প্রিং এলাকায় ট্রাক, বুলডোজার নিয়ে ধীরে ধীরে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে ঢুকে আসছিল চিনের লাল ফৌজ। সেই জায়গা থেকে গাড়ি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে খবর।

ফিঙ্গার পয়েন্ট ৫ থেকে ফিঙ্গার পয়েন্ট ৮ এর মধ্যে সারি সারি কালো ত্রিপল ঢাকা চিনের সেনার ক্যাম্প লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেখান থেকেও ছাউনি উধাও হয়েছে।

প্যাঙ্গং রেঞ্জে চিনা বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি ও সামরিক পরিকাঠামো দেখা গিয়েছিল উপগ্রহ চিত্রে। সেখান থেকেও চিনের ফৌজ অন্তত ২ কিলোমিটার পিছিয়েছে বলে ভারতীয় সেনা সূত্রে খবর।

চিনের বিদেশমন্ত্রী ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, দুই দেশের কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের পরে ঠিক হয়েছে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য দুই দেশের বাহিনীও সচেষ্ট হবে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে একটা নিরপেক্ষ এলাকা বা বাফার জ়োন থাকবে।

এই পথেই ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে এসেছিল চিনা বাহিনী—

গত ১৫ জুন সংঘর্ষের পরেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চিনা বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্রে। উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়ে গালওয়ান উপত্যকা বরাবর শয়ে শয়ে ট্রাক, বুলডোজার, চার চাকার গাড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছে চিনা ফৌজ।

গত ৯ জুন সীমান্তের কাছে গালওয়ান উপত্যকার যে ছবি স্যাটেলাইটে ধরা পড়েছিল, তার থেকে ১৬ জুনের ছবি ছিল অনেকটাই আলাদা। উপগ্রহ চিত্র জানিয়েছিল, সীমান্তের কাছে বড়সড় সামরিক প্রস্তুতি চলছে।

১৬ জুনের উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়ে, ট্রাক, বুলডোজার মিলিয়ে অন্তত ৭৯টি গাড়ি এলএসি থেকে ১.৩ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে চিনের বাহিনী।

এলএসি বরাবর চিনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ১২৭টি গাড়ির বিরাট জমায়েত লক্ষ্য করা যায়। ওই এলাকা এলএসি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বে ছিল। এলএসি থেকে ২.৯ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে চিনা বাহিনীর ৫০ টি ক্যাম্প ধরা পড়ে উপগ্রহ চিত্রে।

প্যাঙ্গং রেঞ্জেও দেখা যায় চিনা বাহিনীর তৎপরতা। প্যাঙ্গং লেকের মাত্র ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পুরোদস্তুর বিমানঘাঁটি গড়ে তোলে চিন। শুধু তাই নয়, উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায় সেখানে  টারম্যাকে জে-১১ বা জে-১৬ জাতীয় যুদ্ধ বিমানও রয়েছে।

১৬ থেকে ১৮ হাজার ফুট উচ্চতার প্যাঙ্গং লেক পর্যন্ত রেঞ্জকে ফিঙ্গার এলাকা বা ফিঙ্গার পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভারতীয় বাহিনী ফিঙ্গার পয়েন্ট ১ থেকে ফিঙ্গার পয়েন্ট ৮ অবধি এলাকাকে নিজেদের অধিকারে দাবি করে টহল দেয়। অন্যদিকে, চিনা বাহিনী ফিঙ্গার পয়েন্ট ৮ থেকে ফিঙ্গার পয়েন্ট ৪ পর্যন্ত এলাকায় টহল দেয়। এই দুই এলাকার কমন পয়েন্ট হল ফিঙ্গার পয়েন্ট ৪। ভারতীয় বাহিনী জানায়, ফিঙ্গার পয়েন্ট ৪ থেকে ফিঙ্গার পয়েন্ট ৮ এর মধ্যবর্তী যে এলাকা অবধি ভারতীয় সেনারা টহলদারি করে, সেই এলাকাতেই নিজের তাঁবু খাটিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে গেছে চিনের লাল ফৌজ।

পাশাপাশি, প্যাঙ্গং রেঞ্জের ফিঙ্গার পয়েন্ট ৪ ও ফিঙ্গার পয়েন্ট ৫ এলাকার মাঝামাঝি চিনের মান্দারিন ভাষায় লেখা বিশেষ প্রতীক ধরা পড়ে উপগ্রহ চিত্রে। ওই প্রতীকের সঙ্গেই আঁকা হয়েছিল চিনের মানচিত্র।

প্যাঙ্গং লেক বরাবর কংক্রিটের বাঙ্কার তৈরি করে ফেলে চিনা সেনা। অন্তত ১৮৬ টি অস্থায়ী ছাউনি বানিয়ে ফেলে। উপগ্রহ চিত্রে কালো ত্রিপল ঢাকা অন্তত ১৬টি চিনা ক্যাম্প দেখা গিয়েছিল পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ এর কাছে।

ভারতীয় সেনা সূত্র জানায়, দৌলত বেগ ওল্ডিতে বায়ুসেনা ঘাঁটির দক্ষিণে দেপসাং উপত্যকায় এলএসি পেরিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঢুকে এসে চিনা সেনা ‘ওয়াই-জংশন’-এ ডেরা বেঁধেছে। ওই ‘ওয়াই-জংশন’ থেকেই পেট্রোলিং পয়েন্ট ১০, ১১এ, ১২ ও ১৩ –তে যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। চিনা সেনা ওই এলাকা দখল করে বসে গেছে।

গত ১৫ জুন পিপি-১৪-তে দু’দেশের সেনাদের প্রাণঘাতী সংঘর্ষ হয়। তার পর ২২ ও ৩০ জুনের সেনা কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক, প্রধানমন্ত্রীর লাদাখ সফর, চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-কে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের  ফোনের পরে বরফ গলে। সেনা সূত্রে খবর, দু’দেশের সেনার মধ্যে আপাতত তিন কিমি বাফার জ়োন থাকবে বলে ঠিক হয়েছে। ৭২ ঘণ্টা পরে ভারতীয় সেনা গিয়ে দেখবে বাস্তবে কতটা সরেছে চিন।

এক নজরে: লাদাখের পরিস্থিতি

• সংঘর্ষস্থল (পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪) থেকে চিনা সেনা ১ থেকে ২ কিমি পিছিয়েছে বলে দাবি ভারতীয় সেনার।

• পিপি ১৫ ও পিপি ১৭এ থেকে চিনা সেনা তাঁবু সরিয়ে নিয়েছে।

• তবে গোগরা হট স্প্রিং ও প্যাংগং হ্রদের উত্তরে কেবল কিছু সাঁজোয়া গাড়ি পিছিয়েছে চিন।

• বিরোধীদের অভিযোগ, ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তত ১৮ কিমি ভিতরে ঢুকে বসে আছে চিন। মাত্র ২ কিমি পিছিয়ে লাভ কী!

• চিনা অনুপ্রবেশের আগে যে স্থিতাবস্থা ছিল, বেজিং তা কি মানতে রাজি?

• তা না-হলে নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নিয়ে মানচিত্রে নতুন করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা টানবে চিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here