দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ তৃণমূলের পাখির চোখ এখন এক এবং একমাত্র ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। আর সেই লক্ষ্যেই এখন থেকে ঘুঁটি সাজানো শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলায় বিজেপির স্বপ্নভঙ্গ করে তৃতীয় বারের জন্য বিপুল আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে মোদি বিরোধী প্রধান মুখ হয়ে উঠছেন বাংলার নেত্রী।

আর এই পরিস্থিতিতে আজ ২৬ জুলাই, সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি যাচ্ছেন। তিন দিনের সফরে সরকারি কাজের পাশাপাশি আগামী লোকসভা ভোটের কৌশল নিয়ে বিজেপি বিরোধী দলগুলির সঙ্গে বৈঠক করবেন।

রাজধানী দিল্লিতে পা রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী। দিন কয়েক আগেই শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে এক হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। এবারের দিল্লি সফরে মূলত সেই কাজটির সলতেই পাকিয়ে আসবেন মমতা।

সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী রাজধানী থাকাকালীন দিল্লিতে তাঁর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সরব হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিজেপি। রাজ্যে বেকারি এবং ভোট-পরবর্তী হিংসাকেই পাখির চোখ করে আপাতত মমতার বিরুদ্ধে গোটা দেশের নজর আকর্ষণ করতে চাইছে গেরুয়া শিবির।

কারণ, তৃণমূল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হতে পারে ধরে নিয়ে বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রে শান দিতে শুরু করেছে। তৃণমূল চাইছে বিজেপি বিরোধী দলগুলির মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই দলনেত্রীকে ওই পদের জন্য তুলে ধরতে। বিজেপি চাইছে সেই বোঝাপড়া গড়ে ওঠার আগেই মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর করে তা ভেস্তে দিতে।

সরকারিভাবে ঘোষণা না করলেও গেরুয়া শিবির সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি থাকাকালীন বিজেপি সাংসদ ও বিধায়কেরা বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচমকা দলের সংসদীয় প্রধান হওয়ার ঘোষণায় বিজেপি আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের ট্যুইটার হ্যান্ডেল থেকে পেগাসাস ইস্যুতে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ানো হয়েছে। যা আসলে রাজনৈতিক বার্তা হিসেবেই দেখছে ওয়াকিবহাল মহল। সেই ট্যুইটের নেপথ্যে সনিয়া গান্ধির সুনিপুণ কৌশলও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। আর তা হলে আলাদা করে সনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনাও রয়েছে তৃণমূল নেত্রীর। প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপি বিরোধী প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস অবশ্য কাউকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করেনি। কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল দল জিতলে সনিয়াকেই ওই পদে দেখা যাবে। তিনি যদিও মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করেন। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।

লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্য না হয়েও সংদদীয় দলনেতা হওয়া যায়। সনিয়া গান্ধী কংগ্রেসে সভাপতি হওয়ার সময় সংসদের কোনও সদনেরই সদস্য ছিলেন না। কিন্তু দল তাঁকে সংসদীয় দলনেত্রী নির্বাচিত করে। আসলে এই পদটির সঙ্গে সংসদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই। আসল বিচার্য হল সিদ্ধান্তের পিছনে থাকা সমীকরণগুলি।


সনিয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেস বুঝিয়ে দিয়েছিল, বিজেপি যতই রাজীব পত্নীকে ‘বিদেশিনী’, ‘বিদেশিনী’ বলে গাল পাড়ুক না কেন তারা দলীয় সভানেত্রীকেই আগামীদিনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করবে।

এদিকে, নেত্রীর দিল্লি সফরের আগেই তৃণমূলের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই সংসদে পেগাসাস, কৃষি আইন সহ একাধিক বিষয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে একবগ্গা আন্দোলনে নেমেছে তৃণমূল। তাঁদের সেই আন্দোলন নজর কেড়েছে গোটা দেশের। এই পরিস্থিতিতে দলের সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে বসেও সংসদীয় রাজনীতিতে আগামীদিনের রূপরেখা তৈরি করে দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, ২৮ জুলাই সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন মমতা।

আবার ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে রাজ্যের জন্য সওয়াল করবেন তিনি, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষত করোনা টিকা নিয়ে রাজ্যের ক্ষোভের বিষয়টি ফের ওই বৈঠকে তুলে ধরতে পারেন তিনি। এই কদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী যেতে পারেন রাইসিনা হিল, রাষ্ট্রপতির দরবারেও। সেখানে কেন্দ্রীয় এজেন্সির অপব্যবহার, রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের বিষয়গুলিও উঠে আসতে পারে।

তৃণমূল নেত্রীর পরিকল্পনা আঁচ করেই দিলীপ ঘোষরা কোমর বেঁধে নেমে পড়তে চাইছেন। তাঁরা বলছেন, বাংলার বেকাররা চাকরি পাচ্ছে না। ডোমের চাকরিকে ইঞ্জিনিয়াররা দরখাস্ত করছে, আর মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

যদিও একান্তে বহু বিজেপি নেতাই মানছেন, ২০২৪-এর লড়াইটা মমতা বনাম মোদী হলে প্রচার এবং ইস্যু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই কারণে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় কালক্ষেপ করছে না তারা। উন্নয়ন এবং সন্ত্রাসের ইস্যুতেই দিল্লির ময়দানে তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। যেভাবে ২০১৪-র আগে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজিয়েছিল বিরোধীরা।

২০১৪-র সঙ্গে ২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে গুণগত মিল এবং অমিল দুই-ই আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দিল্লির রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় হওয়ায় বিজেপি মনে করছে, চোদ্দর তুলনায় চব্বিশের লড়াই অনেক কঠিন হতে পারে। প্রথমত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। দশ বছর আগে মোদীর প্রথম কাজ ছিল গুজরাটের বাইরে নিজেকে তুলে ধরা। পাশাপাশি উন্নয়ন, বিশেষ করে মমতার সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিগুলির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে হাতিয়ার করে তৃণমূল তুলে ধরবে বেঙ্গল মডেল। যেমন মোদীর ছিল গুজরাট মডেল।

মমতা-মোদী সম্ভাব্য লড়াই নিয়ে আরও একটি বিষয় বিজেপিকে চিন্তায় ফেলেছে। বাংলায় বিধানসভার ভোটে দলকে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ভোটের ফল বলছে বাংলার লড়াইয়ে মমতার কাছে মোদীর হার হয়েছে। সেদিক থেকেও ২০২৪-এর লড়াই তৃণমূল নেত্রীর কাছে তুলনামূলকভাবে মসৃণ।

তৃতীয় বার বাংলা জয়ের পর এই প্রথমবার দিল্লি যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দিনকয়েকের এই সফরেই যে ২০২৪-এর রূপরেখা তৈরি হতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here