দেশের সময় ওয়েবডেস্ক এতদিনে প্রথম দেখা গেল তাঁকে। বসিরহাট আদালতে পেশ করা হয় সন্দেশখালির বাঘ শেখ শাহজাহানকে। এজলাসে ১০ মিনিটের সওয়াল জবাবেই বিস্ফোরক জবানবন্দি শেখ শাহজাহানের। শাহাজাহান বলেন, “ইডি-র হাতে গ্রেফতারির  আশঙ্কায় হামলার নির্দেশ দিয়েছিলাম।” আদালতে জমা পুলিশের নথিতে শাহজাহানের স্বীকারোক্তির উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ ইডি-র ওপর সন্দেশখালিতে হামলা আদতে পূর্বপরিকল্পিত।

সূত্রের খবর, আদালতে পুলিশ যে নথি দিয়েছে, তাতে উল্লেখ, ১৬১-এ পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারি, অর্থাৎ যেদিন রেশন দুর্নীতি মামলায় ইডি আধিকারিকরা তল্লাশি চালিয়েছিলেন, সেদিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন শেখ শাহজাহান।

ইডি আধিকারিকরা সিআরপিএফ জওয়ান নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছিল, ইডি তাঁকে গ্রেফতার করতে পারে। সেই কারণে অনুগামীদের ফোন করে নির্দেশ দেন, যাতে কোনওভাবে ইডি আধিকারিকরা বাড়িতে ঢুকতে না পারেন। তাঁদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি তাঁদের জিনিসপত্রও লুঠের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে পুলিশি জেরায় শেখ শাহজাহান স্বীকার করে নিয়েছেন।

পুলিশের নথি অনুযায়ী, রাত ১.১৫ মিনিট নাগাদ শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। মিনাখাঁ থানায় সকাল পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশের দাবি, শেখ শাহজাহান জেরায় তাঁর নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। রাজ্য পুলিশ আদালতে সেই নথিই জমা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই পুলিশ শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে একাধিক প্রমাণ পেয়েছে। পুলিশ শাহজাহানের জামিনের তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে। আপাতত বসিরহাট আদালত শেখ শাহজাহানের ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার গ্রেফতারির পর বসিরহাট মহকুমা আদালতে তোলা হয় তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানকে। বিচারকের কাছে তাঁকে জামিন দেওয়ার আবেদন জানান শাহজাহানের আইনজীবী। তবে পাল্টা পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক সব বিস্ফোরক নথি তুলে ধরে। পুলিশের অভিযোগ, শেখ শাহজাহানকে তার নিজের এলাকায় প্রভাবশালী। তিনি জামিন পেলে সাক্ষীদের ভয় দেখাতে পারেন। তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে পারেন।

মূলত, ইডি-র উপর হামলার ঘটনাতেই গ্রেফতার হয়েছেন সন্দেশখালির ‘বাঘ’। আজ আদালতে ১০ মিনিটেই সওয়াল-জবাব পর্ব শেষ হয়। এরপর শাহজাহানকে বের করে নিয়ে আসা হয় আদালতের বাইরে। তৃণমূল নেতার দুই আইনজীবী রাজা ভৌমিক ও অভিজিৎ ঘোষ বলেন, “পুলিশ ১৪ দিন চেয়েছিল। ১০ দিনের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আমরা জামিন চেয়েছিলাম। ইডির উপর হামলার ঘটনায় নাম রয়েছে ঠিকই। তবে সরাসরি কোনও যোগ ছিল না।”

অপরদিকে, আদালতে দেওয়া নথিতে পুলিশ দাবি করে, শেখ শাহজাহান কে হেফাজতে রেখে জেরা করার দরকার রয়েছে। কারণ তিনিই জানেন, ইডি-র উপর হামলার দিন কারা-কারা জড়িত ছিলেন। তাদের গোপন ডেরার হদিশ জানেন শাহজাহান। ইডি আধিকারিকদের কাছ থেকে লুট হওয়া জিনিস উদ্ধার করতে শাহজাহানকে হেফাজতে দরকার। এর পাশাপাশি শাহজাহান নথিতে উল্লেখ ছিল, তৃণমূল এই নেতার অতীত-ইতিহাস খুব খারাপ। একাধিক অপরাধের ইতিহাস আছে। তাই কোনও ভাবেই তাকে জামিন নয়। জামিনের তীব্র বিরোধিতা করে আদালতে নথি পেশ রাজ্য পুলিশের।

প্রসঙ্গত, পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ১৮৬, ৩০৭, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫৩, ৩৭৯, ৫০৬, ৩৪১, ৩৫৩, ৩২৩, ৪২৭, ৫০৬, এবং সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি আইনের ৩ নম্বর ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে।

অন্যদিকে শেখ শাহজাহানকে পুলিশ গ্রেফতার করার পরই সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে ইডির পূর্বাঞ্চলীয় দফতরে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের অফিসে তৎপরতা শুরু হয়ে গেল।

ইডি সূত্রে খবর, শাহজাহানকে হেফাজতে নিতে চেয়ে কালবিলম্ব না করেই কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানাবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।

গত ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালিতে শেখ শাহাজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিলেন ইডির গোয়েন্দারা। সেখানে তাঁদের মারধর করা হয়। ইডির দুই গোয়েন্দার মাথা ফাটে। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এর পর ইডিই প্রথম শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কলকাতা হাইকোর্টেও এ ব্যাপারে মামলা দায়ের হয়। এর পর গত মাস খানেক সময়ে শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে সন্দেশখালিতে যে সব অত্যাচার, অনাচারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে তার ভিত্তিতেও এফআইআর নথিভুক্ত হয়েছে। পুলিশ সেই সূত্রেই গ্রেফতার করেছে শাহজাহানকে। 

ইডি সূত্রে বলা হচ্ছে, শাহজাহানকে গ্রেফতারের দাবিতে প্রথম অভিযোগ দায়ের করেছিল কেন্দ্রীয় এজেন্সি। সুতরাং তাকে হেফাজতে চাওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এজেন্সির। কারণ, শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে বেআইনি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ নিয়ে তাকে জেরা করা প্রয়োজন। ইডি সূত্রে বলা হচ্ছে, শাহজাহানকে হেফাজতে নিয়ে অনুব্রত মণ্ডলের মতই দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে তারা।

এখানে জানিয়ে রাখা ভাল, শাহজাহানের বিরুদ্ধে শুধু বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ নেই, কর্তব্যরত ইডি অফিসারদের উপর হামলার অভিযোগও রয়েছে। যে অভিযোগ যথেষ্টই গুরুতর। 

তবে মজার ঘটনা হল, শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে যে সন্দেশখালিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ইডির গোয়েন্দারা, সেখানেই এদিন আবির খেলা শুরু হয়েছে। মহিলারা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন। তাদের হাতে ধরা গোলাপি রঙের আবির। সেই আবির ছুড়ে দিয়ে তাঁরা বলছেন, সন্দেশখালির আপদ গ্রেফতার হয়েছে। এখন আর রাত বিরেতে কেউ উৎপাত করবে না। রাতে ঘুম হবে। এলাকায় শান্তি থাকবে।

সন্দেশখালির ‘নিখোঁজ’ তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখ ৫৫ দিন পর গ্রেফতার হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, মিনাখাঁ থানার বামনপুকুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে শাহজাহানকে। এই গ্রেফতারির জন্য পরোক্ষে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কৃতিত্ব দিচ্ছে শাসক তৃণমূল। তবে এই নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ করতে ছাড়ছে না বিরোধী দলগুলি।

বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ সূত্র মারফত শাহজাহানের গ্রেফতারির খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ লেখেন, “আদালতের বাধা ছিল, পুলিশ কাজ করতে পারেনি।” তার পরেই তিনি লেখেন “অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে আদালত বাধা সরিয়েছে। পুলিশ যা করার করেছে।”

সম্প্রতি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক জানিয়েছিলেন, কোর্টই পুলিশের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। না হলে রাজ্য সরকারের পুলিশ শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে পারে। গত সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি জানান, তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখকে গ্রেফতার করতে পারবে রাজ্যের পুলিশ। কোনও স্থগিতাদেশ তাতে দেওয়া হয়নি। হাই কোর্টের শেখ শাহজাহান সংক্রান্ত নির্দেশ এবং প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের পরে শাসক তৃণমূল সোমবার আবার দাবি করে, আদালতের কারণেই শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে পারেনি রাজ্য পুলিশ। ‘জট’ কেটেছে। সাত দিনের মধ্যে শাহজাহান গ্রেফতার হবেন।

অবশ্য পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, ইডি শাহজাহানকে দিল্লি নিয়ে যেতে চাইলে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি শেষমেশ আদালতের নির্দেশের উপরই নির্ভরশীল থাকবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here