দেশের সময়: একের পর এক নয়া কৃষি প্রযুক্তির বাস্তবায়ন। রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে নয়া দিশা দেখাচ্ছে কোচবিহারের সাতমাইল সতীশ ক্লাব ও পাঠাগার।

ইতিমধ্যেই তারা অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। নিরলস পরিশ্রম করে এখনও পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি কৃষককে তারা ফার্মার্স প্রোডিউসার অর্গানাইজেশনের ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে। সেইসব কৃষকদের প্রশিক্ষণ, তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন, শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, কৃষিযন্ত্র ভাড়া দেওয়া সহ কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে নানা ধরনের কাজ করে চলেছে তারা। আর এরই মাধ্যমে একদিকে যেমন বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে চলেছে বলে দাবি সংগঠনের সম্পাদক অমল রায়ের।

শুধু কোচবিহার নয়, গোটা উত্তরবঙ্গেই এখন অতি পরিচিত নাম সাতমাইল সতীশ ক্লাব ও পাঠাগার। বিহারেও কৃষির উন্নয়নে কাজ করছে তারা। পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ত্রিপুরা থেকেও বহু কৃষক তাদের কাছে আধুনিক চাষের প্রশিক্ষণ নিতে আসছেন। সংগ্রহ করছেন বীজ। মোটের উপর চাষের ‘মুশকিল আসান’ বলতে এখন নিজেদের নির্ভরযোগ্য করে তুলেছে এই কৃষক সঙ্ঘটি। চাষের সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া থেকে সার, বীজ, চারা, চাষের প্রশিক্ষণ, এক ছাতার তলাতেই মিলছে যাবতীয় সুবিধা। সংগঠনের সম্পাদক অমলবাবুর কথায়, আমাদের লক্ষ্য একটা ব্লকে একটাই ফার্মার্স প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন।

একটা ব্লকে একটাই ফসল। এতে অনেক সঙ্ঘবদ্ধভাবে এবং অনেক বেশি পরিমাণে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। চাষের খরচও কমবে। কারণ, কৃষকরা কৃষি যন্ত্রাংশ ভাড়া নিয়ে একলপ্তে গোটা জমিতে চাষ দিয়ে নিতে পারবেন। একটাই ফসলের জন্য একই ধরনের সার বা কীটনাশকের প্রয়োজন হবে। ফলে কৃষকের আলাদা করে তা কেনার প্রয়োজন হবে না।

কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে কোচবিহার-১ ব্লক। সাতের দশকে এখানেই গড়ে ওঠে সাতমাইল সতীশ ক্লাব। শুরুর দিকে আর পাঁচটা ক্লাবের মতো এখানেও খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এ ধরনের কর্মকাণ্ড হত। নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ক্লাবের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ২০০৩ সালে টোটাল স্যানিটেশনের কাজে যুক্ত হয় এই ক্লাব। ২০০৮ সালে ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, এমন একটা কিছু করতে হবে, যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সেই ভাবনা থেকেই কৃষিক্ষেত্রে নিজেদের যুক্ত করা শুরু। প্রথমে কোচবিহার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের সহযোগিতায় শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ। জিরো টিলেজ পদ্ধতিতে গম চাষ। উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে চাষাবাদ করা যায়, তা নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন ক্লাবের কয়েকজন সদস্য। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা কৃষকের জমিতে গিয়ে বোঝাতে থাকেন। এভাবেই কাজ করতে করতে নাবার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ। তৈরি করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। চালু করেন স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। ২০১৫ সালে ক্লাবের তরফে কেনা হয় ট্রাক্টর, থ্রেশার মেশিন, ধান রোপণের মেশিন।

প্লাস্টিকের ট্রের উপর রেডিমেড ধানের চারা উৎপাদন করে সাড়া ফেলে দেন অমলবাবুরা। কৃষক দেখেন, তাঁদের বীজতলা তৈরির প্রয়োজন হচ্ছে না। সাতমাইল সতীশ ক্লাব ও পাঠাগারের কাছ থেকে তাঁরা সহজেই ধানের চারা পেয়ে যাচ্ছেন। আর এর সবচেয়ে বড় সুবিধা প্লাস্টিকের ট্রেতে থাকায় ওই ধানের চারা এক জায়গা থেকে সহজেই অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ফলে কৃষকদের কাছে বিষয়টি খুবই গ্রহণযোগ্য হয়। কারণ, ধানের বীজতলা করতে যথেষ্ট পরিচর্যার প্রয়োজন হয়, তাছাড়া প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময়ও লাগে।

রেডিমেড ধানের চারা কিনে সরাসরি তা মূল জমিতে বসিয়ে দিলে সময় ও পরিশ্রম দু’টোই সাশ্রয় হয়। তাছাড়া সুস্থ সবল চারাও পাওয়া যায়। ফলে রেডিমেড ধানের চারা বিক্রি করেই সাতমাইল সতীশ ক্লাব অনেকটা এগিয়ে যায়। এই ক্লাবের উদ্যোগে ইতিমধ্যেই ৪০টি ফার্মার্স প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন গড়ে উঠেছে। কৃষককে যাতে চাষ করার পর কোনও ফসল জলের দরে বিক্রি করতে না হয়, সেজন্য তারাই চাষির কাছ থেকে ন্যায্য দাম দিয়ে ফসল কিনে নেয়।

চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালকে মিলেট ইয়ার হিসেবে ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। ভারত সরকারের তরফেও এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। চাল-গমের পরিবর্তে মিলেটে যে পুষ্টিগুণ অনেক বেশি তা বোঝানোর পাশাপাশি মিলেটকে জনপ্রিয় করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে মিলেট চাষের এলাকা বৃদ্ধিতেও। এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে কোচবিহার সাতমাইল সতীশ ক্লাব ও পাঠাগার।

কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি এই তিন জেলা মিলিয়ে নাবার্ডের সঙ্গে তারা সাড়ে তিনশো বিঘারও বেশি জমিতে মিলেট চাষ শুরু করেছে। এজন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। মিলেটের বীজের জন্য কৃষককে মোটেই হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়নি। ন্যাশন্যাল সিড কর্পোরেশনের কাছ থেকে বীজ কিনে তা কৃষকদের দিয়েছে এই কৃষক সংগঠনই। অমলবাবু জানিয়েছেন, আমরা ফক্সটেল মিলেট চাষ করছি।

উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও মিলেট চাষের প্রদর্শনী ক্ষেত্রে করা হয়েছে। মিলেট একদিকে যেমন অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। তেমনই এই ফসলটি চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে অনেক কম। তাছাড়া জলও কম লাগে। ধান চাষের ক্ষেত্রে যেমন সবমিলিয়ে ৪৫ থেকে ৫০ ঘণ্টা সাব মার্সিবল পাম্প চালাতে হয়, সেখানে মিলেট চাষে সাকুল্যে জল লাগে ১০ ঘণ্টা। ফলে ভূগর্ভস্থ জল অনেকটাই কম নষ্ট হবে মিলেট চাষে। রবি মরশুমে মিলেট চাষে সময় লাগে মোটামুটি চারমাস।

বর্ষায় লাগে ৮০ দিনের মতো। তবে বর্ষায় যে কোনও জমিতে এটি চাষ করা যাবে না। মাঝারি ও উঁচু জমি, যেখানে জল দাঁড়ায় না, সেটিই এই চাষের জন্য আদর্শ। অমলবাবু বলেন, ফসল বিক্রি করা নিয়ে কৃষকদের চিন্তার কিছু নেই। ইতিমধ্যেই অনেক কৃষকের কাছ থেকে আমরা মিলেট কিনে নিয়েছি। শীঘ্রই একটি মিল বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে এখানেই মিলেট ভাঙানো সম্ভব হয়। মিলেট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ বাড়াতে আমরা মিলেট রান্নার প্রতিযোগিতারও আয়োজন করেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here