বিশ্বজিৎ ঘোষ

নিত্যানন্দ ব্যাণার্জীকে চিনি সেই ছোট্টবেলা থেকে। আসলে তখন তিনি আমাদের পাড়াতেই বনগাঁর পূবর্তন কমিউনের একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন। তাঁর পাশের ঘরেই থাকতেন সিপিআই নেতা সর্বজনশ্রদ্ধেয় অজিত গাঙ্গুলী। আমাদের খেলার মাঠটা ছিল ঐ বাড়ির সামনেই।

মাঝেমাঝেই বল চলে যেত কমিউনে। তিনি তখন গোবরডাঙা কলেজের অধ্যাপক। কলেজ থেকে ফিরে প্রত্যেকদিন বিকেলে একটা ইজিচেয়ারে বসে চা খেতে খেতে তিনি বই পড়তেন। যে-ই বল কুড়িয়ে আনতে যেত তিনি তাকেই ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে তাঁর নাম,তাঁর বাবার নাম জিজ্ঞাসা করতেন।

তাছাড়া স্যারের বড়ছেলে অপুদা( বর্তমানে ডাক্তার) আমাদের চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র ছিলেন। অপুদাও আমাদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন। স্যারের মেয়ে দময়ন্তী ( কাঞ্চন) আমার একবছরের জুনিয়র।খুব গুণী মেয়ে। তো একদিন বল কুড়াতে গিয়েই স্যারের সাথে আমার আলাপ হয়ে গেল। তখন তো জ্ঞানজ্ঞম্যি কিছুই হয়নি। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারতাম এই মানুষটি গড়পড়তা অন্য মানুষের মতো নয়, একটু অন্যরকম। যাইহোক তারপর অনেকদিন কেটে গেছে।

আমরা তখন যুবক। বনগাঁয় বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়ক ও কিংবদন্তী প্রশিক্ষক শৈলেন দাসের নেতৃত্বে ‘বাতায়নিক’, রবীন্দ্রচর্চার একটি শাখা বনগাঁর দত্তপাড়ায় কলঘাটের রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক সমর সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু তাঁর প্রধান প্রাণপুরুষ হলেন নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বাড়িতেই গানের ক্লাসগুলি হত। যাইহোক তাঁর ও অল্প কয়েকজন রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষের আত্যন্তিক প্রচেষ্টায় ‘বাতায়নিক’ বনগাঁ কেন এই মহকুমার রবীন্দ্রচর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।আমিও জড়িয়ে পড়লাম এই সংগঠনের সাথে এবং এই সূত্রেই তাকে কাছ থেকে দেখার আমার সুযোগ হল।

এসময় শান্তিনিকেতন থেকে ‘বাতায়নিক’ গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পায়। ‘বাতায়নিক’- এর দমদম,বারাসাত ও বনগাঁ ব্রাঞ্চের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গানের টীম তৈরী হল। স্যার ও শৈলেনবাবু আমাকেও এই টীমের সাথে যেতে বললেন। স্যারের নেতৃত্বে বনগাঁর টীমের সদস্যরা শান্তিনিকেতনে পাঠভবনের সামনের মুক্তমঞ্চে তাদের সংগীত পরিবেশন করলেন। স্যার বললেন রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ ছাত্র ও কিংবদন্তী রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও শিক্ষক শান্তিদেব ঘোষ তখনও জীবিত আছেন।

আমাদের সবার উচিৎ তাঁর বাড়ি গিয়ে তাকে প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসা। স্যারের সাথে আমরা সবাই তাঁর বাড়ি যাওয়া ও শান্তিদেব ঘোষকে প্রণাম করা এখনও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। বনগাঁয় বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রেও তিনি পথিকৃৎ। বাতায়নিকের হয়ে তাঁর নেতৃত্বে শাান্তিনিকেতনের হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণের দিনে বনগাঁর কেশবলাল,গৌরীসুন্দরী, রাখালদাস স্কুলে ‘ মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও শূণ্যে ‘ গান গাইতে গাইতে আমরা বৃক্ষরোপণ করেছি।

বনগাঁয় রাখী পূর্ণিমার দিনে স্টেশনে, যশোর রোডে, বাসস্ট্যাণ্ডে, বাসে ভেতরের যাত্রীদের রাখী পরানোর পরম্পরা তাঁরই সৃষ্টি। ‘বাতায়নিক’ ছাড়াও বনগাঁর প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চায়, বিজ্ঞান ও কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে, নাগরিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে, মেয়েদের নাচের স্কুল ‘ শ্রী’ প্রতিষ্ঠায়, শিশুদের বিদ্যালয় ‘ নন্দন’ প্রতিষ্ঠায়, অবসর নেবার পরেও বিনা পরিশ্রমিকে ত্রিশ বছর ধরে শুধু বনগাঁ নয় বনগাঁর বাইরের ছাত্র-ছাত্রীদেরও শিক্ষাদান করে, ক্ষুদিরাম,বাঘাযতীন, প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরার মতো দেশনায়কদের জন্মদিবস পালন করে বনগাঁর সাংস্কৃতিক জগতে তিনি এক মহিরূহ হয়ে উঠেছিলেন।

তিনি এইসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্নতা কাটাতে চেয়েছিলেন। তখন আমি ‘ শিস’ পত্রিকার সাথে জড়িত। ‘শিস’ পত্রিকার ২০ বছর উপলক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে তারই যোগাযোগে বাংলাদেশের কিংবদন্তী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন ও তাদের টীম ‘ছায়ানট’ বনগাঁর ‘শ্রীমা’ সিনেমা হলে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন।

রাতে সেইসব শিল্পীরা তার বাড়িতেই ছিলেন। তাদের মধ্যে ওয়াহিদুল হকেরর মতো ব্যক্তিত্ব, মিতা হক, ডালিয়া নওশিনের মতো আজকের বাংলাদেশের স্বনামধন্য গায়িকারাও ছিলেন। ‘এবং অন্যকথা’ দুবছর আগে ১লা বৈশাখে বাঙালী নববর্ষ পালন ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের বাণী পৌঁছে দিতে একটি পদযাত্রা আয়োজন করেছিল।

বারন করা সত্ত্বেও তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের সাথে কিছুটা পথ হাটলেন। এভাবেই তিনি বনগাঁর সাংস্কৃতিক জগতের মানুষদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বটগাছের মতো। আর তাঁর ছিল ফটোগ্রাফিক স্মৃতি। বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক চৌধুরী শাহিদ কাদের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তশহরগুলির মানুষের ভূমিকা সম্পর্কিত একটি বিষয়ে গবেষণার জন্য বনগাঁয় এসেছিলেন।

তাঁর এক ছাত্রী এবিষয়ে সাহায্য করবার জন্য আমাকে অনুরোধ করলে আমি তাকে স্যারের বাড়ি নিয়ে গেছিলাম। সেখানে তিনি যুদ্ধের সময় বনগাঁর কিছু মানুষের, কিছু সংগঠনের অবদানের এবং সেইসময় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির ( পরবর্তীকালে সিপিবি) কোন কোন নেতা বনগাঁয় আশ্রয় নিয়েছিলেন তার যে তথ্য ও নিখুঁত বর্ণনা দিলেন তাতে সেই অধ্যাপক বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি সস্ত্রীক স্যারের বেশ কিছু ছবিও তাঁর সংগ্রহে রাখবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর সাম্প্রতিককালের বক্তৃতাগুলিতে তাঁর যে মননশীলতা ও ঋষিকল্প প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়েছি তা ভোলার নয়। যেন একজন মানুষ যেন মন্ত্রের মতো কিছু উচ্চারণ করে চলেছেন,আর তা যেন মন্দ্রিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ইথার তরঙ্গে। কাল রাত ১-৫৫তে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী আজকে দুপুরে মেডিকেল কলেজে তাঁর দেহদান করা হয়েছে।

মৃত্যুর পরেও তাঁর দেহ যেন ডাক্তারির ছাত্রদের কাজে লাগে এই ভাবনার মধ্যে তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বাসে ও যাপনে এরকম মিল আর ক’জনের জীবনেই বা মেলে! এরকমভাবে মানুষকে ভালবাসতে আর কজনেই বা পারেন! বনগাঁর সংস্কৃতিজগতের এই নক্ষত্রের মহাপ্রয়ানে আমাদেরর মনে স্বজন বিয়োগের বেদনা। হে আচার্য, বনগাঁর মানুষের হৃদয়ে আপনি চিরকাল আলোকবর্তিকা হয়ে থেকে যাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here