দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ নভেলকরোনাভাইরাসের বাহক বাদুড় হতে পারে এমন আভাস আগেই দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) সাম্প্রতিক গবেষণার রিপোর্ট বলছে, ভারতের দুই প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে বিটা-করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী ভাইরাল স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে।

ইন্ডিয়ান ফ্লাইং ফক্স এবং ফল খাওয়া বাদুড়ের (Rousttus)শরীরে পাওয়া গেছে এই আরএনএ ভাইরাসের খোঁজ।
এই মারণ ভাইরাসের উৎসের কারণ বাদুড় হতে পারে কিনা সেই নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা চালাচ্ছিল আইসিএমআর ও পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি (এনআইভি)। গবেষকরা বলছেন, কেরল, তামিলনাড়ু, হিমাচলপ্রদেশ ও পুদুচেরীর নানা জায়গা থেকে ওই দুই প্রজাতির বাদুড় সংগ্রহ করে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল। দুই প্রজাতিরই ২৫টি বাদুড়ের গলা থেকে পাওয়া নমুনার আরটি-পিসিআর (রিভার্স-ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেন রিঅ্যাকশন)পরীক্ষা করে ভাইরাল স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে। মনে করা হচ্ছে নয়া করোনাভাইরাসের Reservoir এই দুইপ্রজাতির বাদুড় হলেও হতে পারে। তবে এই বাদুড়ের থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ এখনই ছড়িয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

আইসিএমআর-এনআইভি-র যৌথ গবেষণায় ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব, গুজরাট, ওড়িশা, তেলঙ্গানা, চণ্ডীগড় ও পুদুচেরী থেকে কয়েক প্রজাতির বাদুড়ের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়। ইন্ডিয়ান ফ্লাইং ফস্কের ৫০৮টি স্যাম্পেল ও ফল খাওয়া বাদুড়দের থেকে ৭৮ টি স্যাম্পেল নিয়ে আরটি-পিসিআর টেস্ট করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইন্ডিয়ান ফ্লাইং ফক্সের চারটি স্যাম্পেল ও ফল খাওয়া বাদুড়দের ২১টি স্যাম্পেলের মধ্যে ব্যাট-কভ (BtCov-যা আসলে বিটা-করোনারই স্ট্রেন) স্ট্রেন পাওয়া যায়।
২০০১ সালে নিপা ভাইরাস মাথাচাড়া দিয়েছিল ভারতে। সংক্রামিত ৬৬, মৃত্যু কম করেও ৪৫। সেই সময় আইসিএমআর-এনআইভির রিপোর্ট বলেছিল ফল খাওয়া বাদুড়রাই এই ভাইরাসের বাহক। ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণের সময়েও বাহক হিসেবে বাদুড়ের নামই করা হয়েছিল। যেহেতু সার্স ভাইরাসের পরিবারেরই সদস্য এই সার্স-কভ-২, তাই এই ভাইরাসের বাহক বা Reservoir হিসেবে বাদুড়কেই সন্দেহ করা হচ্ছিল।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৬৬ রকম ভাইরাসের বাহক হল বাদুড়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immune System) এমনই অদ্ভুত যেখানে ভাইরাসরা নানাভাবে নিজেদের বিস্তার ঘটাতে পারে। লক্ষণহীন সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন ভাইরাসও নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠে বাদুড়ের শরীরে।
৬৬ রকম ভাইরাসের বাহক বাদুড়, কীভাবে প্রাণঘাতী সংক্রমণ ছড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে জানুন:
২০০১ সালে নিপা ভাইরাস মাথাচাড়া দিয়েছিল ভারতে। সংক্রামিত ৬৬, মৃত্যু কম করেও ৪৫। এই ভাইরাসের বাহক বলে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছিল বাদুড়ের দিকে। ২০০২ সাল। এশিয়াতে মহামারী হয়ে আছড়ে পড়ল সার্স ভাইরাস (বিটা-করোনাভাইরাসেরই পরিবার যার কোপে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম হয়)। সংক্রামিত আট হাজারের বেশি, মৃত্যু ৮০০ ছাড়াল। এই সার্সেরও বাহকবলা হল বাদুড়কেই। এরপর ২০১৪-১৬ সাল। ইবোলার তাণ্ডব শুরু হল বিশ্বজুড়ে। মৃত্যু ১১ হাজারের বেশি, আক্রান্ত ছাড়াল ২৮ হাজার। সেবারও বিজ্ঞানীরা বললেন ইবোলার বাহকও বাদুড়ই। বর্তমান বিশ্বে মহামারী করোনাভাইরাসেরই প্রাণঘাতী ভাইরাল স্ট্রেন সার্স-কভ-২। এর উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য না থাকলেও বিজ্ঞানীদের দাবি এই করোনার বাহকও সেই বাদুড়ই।

ভাইরাস সামান্য হোক বা প্রাণঘাতী, তার বিস্তারের জন্য বাহকের দরকার হয় যাকে বলে Reservoir। ভাইরাস কিন্তু এই বাহকের ক্ষতি করে না। বরং তার শরীরকে আশ্রয় করেই আড়েবহড়ে বাড়তে থাকে। সুযোগ বুঝে ঝুপ করে হানা দেয় মানুষ বা কোনও পশুর শরীরে। বাহকের কাজ হল সযত্নে নিজের শরীরে এই ভাইরাসকে লালনপালন করা। এই দায়িত্ব নাকি খুব ভালভাবে পালন করতে পারে বাদুড়রা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৬৬ রকম ভাইরাসের বাহক হল বাদুড়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immune System) এমনই অদ্ভুত যেখানে ভাইরাসরা নানাভাবে নিজেদের বিস্তার ঘটাতে পারে। লক্ষণহীন সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন ভাইরাসও নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠে বাদুড়ের শরীরে।

কীভাবে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বাদুড়?

এনসিবিআই-পাবমেডের জার্নালে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ৪৬০০ স্তন্যপায়ী প্রাণীকে শনাক্ত করা গেছে যার মধ্যে ৯০০-রও বেশি প্রজাতি রয়েছে বাদুড়ের। এদের দুটো সাবঅর্ডার—মেগাচিরোপটেরা (Megachiroptera) যাদের একটাই বড় পরিবার (১৬৬ রকম প্রজাতি) এবং মাইক্রোচিরোপটেরা (Microchiroptera) যাদের ১৬টা পরিবার (প্রায় ৭৫৯ প্রজাতি)। গবেষকরা বলছেন, এই বাদুড়রা মানুষের সংস্পর্শ সাধারণত এড়িয়েই চলে। তবে যেভাবে জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে তাতে তাদের খাদ্যশৃঙ্খলে বড় বাধা পড়ছে। গাছ কাটার ফলে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলছে না। তাছাড়াও মানুষের শিকার, বাদুড় খাওয়ার প্রবৃত্তি নানা কারণে এরা ক্রমশই মানুষের সমাজের কাছাকাছি চলে আসছে। এদের শরীরে লুকিয়ে থাকা ভাইরাসও স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের শরীরের মতো উপাদেয় ও বড় আধার খুঁজে নিচ্ছে। দেহকোষের প্রোটিনের স্বাদ পেয়ে ইচ্ছামতো জিনের বদ ঘটিয়ে আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রাচীর ভেঙে ফেলে নিজেদের বিকল্প প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, হোয়াইট-নোজ সিন্ড্রোম নামে একধরনের রোগ বাদুড়েরও হয়, যেটা মহামারীর আকার নেয়। রোগাক্রান্ত বাদুড়ের সংস্পর্শে আসা প্রাণী বা মানুষের মধ্যেও রোগ ছড়াতে দেরি হয় না।
এই ৬৬ রকম ভাইরাসের মধ্যে কিছু প্রাণঘাতী ভাইরাসের সঙ্গে পৃথিবীর পরিচয় হয়েছে। যেমন রেবিস ভাইরাস। এদের বাহকও বাদুড়। নিপা ভাইরাসের বাহক তিনরকম বাদুড় যার মধ্যে একটা পরিচিত Pteropus hypomelanus। হেন্দ্রা ভাইরাসের বাহক ব্ল্যাক ফ্লাইং ফক্স Pteropus alecto, তাছাড়া গ্রে-হেডেড বাদুড় Pteropus poliocephalus, আরও দুই প্রজাতি আছে। মারবার্গ ইবোলা ভাইরাসের বাহকও বাদুড়ই। পশুদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে হানা দিয়েছে এমন উদাহরণ আছে। এই মাঝের বা Intermediate বাহকরা যেমন সিভেট ক্যাট থেকে সার্স, উঠ থেকে মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম), ঘোড়া থেকে হেন্দ্রা ভাইরাস ও মনে করা হচ্ছে প্যাঙ্গোলিন থেকে কোভিড-১৯। সার্স-সিওভি২ ভাইরাল জিনোমের সঙ্গে ব্যাট করোনাভাইরাসের (bat-SL-Cov-ZC45 এবং bat-SL-Cov-ZXC21) বিস্তর মিল। মূল আধার কিন্তু সেই বাদুড়ই।

বাদুড়ের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজের শরীরে ভাইরাস ছড়াতে দেয় না:

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাদুড়রা নিজেদের শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এদের বিপাকের শক্তিও বেশি। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের কোষ থেকে টাইপ-১ ইন্টারফেরনের (IFNs) ক্ষরণ বেশি হয়। এই ইন্টারফেরন অ্যান্টি-ভাইরাল প্রতিরোধ গড়ে তোলে কোষের মধ্যে। তাই ভাইরাস দ্বারা কোনও ভাবেই সংক্রামিত হয় না বাদুড়ে। পরিবর্তে এরা রোগ ছড়াতে পারে মানুষের মধ্যে। পরিবেশের তাপমাত্রার পার্থক্য, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, মানুষের খাদ্যাভ্যাস নানা কারণে মারণ জীবাণু বাহক থেকে স্থানান্তরিত হতে পারে মানুষের মধ্যে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের পিছনেও এমনই কারণ আছে বলেই মত বিজ্ঞানীদের। সার্স-কভ-২ এর স্বাভাবিক আধার বা উৎস আছে বলেই সম্প্রতি দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেটা বাদুড় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন হয়ে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে সার্স-কভ-২। এর পরে মানুষের সচেতনতার অভাব, খাদ্যের প্রকৃতি, রোগ চেপে যাওয়ার মানসিকতা ও অসংযমী জীবনের কারণে সেই ভাইরাস আরও বেশি প্রাণঘাতী হযে উঠে মহামারীর চেহারা নিয়েছে।

তথ্যসূত্র: এনসিবিআই-পাবমেড।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here