অশোক মজুমদার।

লোহার গেটটা আস্তে করে খুলে ডিম, সুজি, ছাতু, কলা, পাউরুটি, ম্যাগির প্যাকেটগুলো রেখে রাস্তায় এসে মাকে ফোন করলাম। মা অন্যান্য দিনের মতোই বললো “গেট তো খোলা আছে চলে আয়”। আমি বললাম, “না না তুমি বাইরে এসো।”

আজ মায়ের সাথে দেখা করতে গেছিলাম। প্রতিবছরই যাই। মা ভাইয়ের কাছে থাকে। বেশিরভাগ মানুষই আজকের দিনে মন্দিরে পূজো দিয়ে বছর শুরু করে। আমার সেসবের পাট নেই বলে কলকাতায় থাকলে আমি বছরের প্রথম দিন মাকে দিয়েই শুরু করি। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঠাকুমার কাছে যাবো শুনে রিক, পিকুর সাথে মেয়ে অদ্রিজাও যাবার বায়না ধরেছিল কিন্তু ওদের নিইনি। প্রতিবার এইদিনে মায়ের জন্য নতুন শাড়ি ছাড়াও নিই মিষ্টি আর দই। মায়ের সুগার থাকলেও মিষ্টি আর দই খুব পছন্দের। ভরদুপুরে সুনসান রাস্তায় আজ পয়লা বৈশাখের দিনেও বহু মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় মায়ের প্রিয় দই আর নিতে পারিনি। বাকি যা নিয়েছি সব মা নিয়ে যাবার জন্য বলেছিলো। কাক শালিকহীন রাস্তায় দুবার পুলিশ আটকেছিলো। খুব অনুরোধের সাথে তাদের আজ বলেছি মায়ের কাছে যাচ্ছি, মায়ের শরীরটা ভালো নেই। একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। ফাঁকা শহরে তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম গরিয়ার কল্পতরু রাজবাড়ী। মায়ের জিনিসগুলো গেটের ভিতরে নামিয়ে মা কে বাইরে আসতে বললাম।

মা কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে ধীরে ধীরে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো। আমি মায়ের থেকে দশফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি। অদ্ভুত লাগছিল নিজের ভিতরেই। অনেকটা যেন জেলখানার মতো। মা গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাকে যেন কেউ আটকে রেখেছে আর আমি হাজার চেষ্টা করেও ছুঁতে পারছিনা। আমার তিরাশি বছরের মা বলছে “তুই ভিতরে আসবিনা? আমি টিভিতে দেখেছি, আমি কারো সাথে মিশছিনা, সব পরিস্কার করে রেখেছি, আমার ঘরে আমি কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিনা, দুধ, কাজের লোক, জঞ্জাল সব বন্ধ করে দিয়েছি, আয় ভিতরে আয়। ” আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।

কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠলো, “কি ব্যাপার বলতো? খাবারগুলো এখানে রেখে তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছিস, হয়েছে টা কি ? বলছি তো আমি কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিইনা।”

আমি তখন বললাম “মা, আমি যে রোজ বাইরে বাইরে ঘুরছি, নিজের কাজ ছাড়াও এইসময় অনেক মানুষ অসুবিধায় পড়েছে তাদের কিছু না কিছু সাহায্য করার জন্য অনেকের সাথেই দেখা করতে হচ্ছে, তোমার অনেক বয়স হয়েছে, আমি বাড়িতে ঢুকে তোমার বিপদ বাড়াতে চাইনা। তাছাড়া এই ভাইরাস হলে…….. আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো, কথা আর বলতে পারিনি কিছুক্ষন।

আমার কথায় যখন মা বুঝলো আমি আর ভিতরে যাবোনা, চুপ করে গেলো। হয়তো ভাবছিলো এই মুহূর্তে রিলিফের মতো পায়ের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী রেখে দিয়ে তার বড়োছেলে অশোক দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, ভিতরে আসবে না….জানিনা ঠিক কি চলছিলো মায়ের মনে।

প্রতিবার পয়লা বৈশাখে বাড়িতে গেলে মা বানিয়ে দেয় লিকার চা আর মুড়ি। আর যদি আগে থেকে বলে যাই তাহলে শুকনো আলুপোস্ত বানিয়ে রাখতো। দই নিয়ে গেলেই হাঁড়িটা একটু নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকতো। ভাইয়ের সাথে করা সমাজ, জীবন, সাহিত্য, রাজ্য, রাজনীতি, দেশের অবস্থা, খেলা, সিনেমা কোনো আলোচনাতেই মায়ের কোনো আগ্রহ কোনোদিন দেখিনি। ক্লাস থ্রি পড়া অধুনা বাংলাদেশ সেইসময় পূর্ব পাকিস্তানের মেয়ে অর্চনাকে (সুধা) বর্ধমানের অজ পাড়াগাঁয়ে বলতে শুনতাম, আমার ছেলেরা রেলে চাকরী করবে না(আমার বাড়ির বেশিরভাগ লোকজন রেলের চাকুরে, বাবাও ছিলেন)। আজ কলকাতায় আমরা তিনভাই (মেজভাই গত অকালে গত হয়েছে) যতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি আপনাদের সামনে, আধুনিক চিন্তায় নিজেদের গড়তে পেরেছি তা সবটাই মা অর্চনা মজুমদারের শাসন, আদরে। অথচ আমার মা কোথাও জাননা, এমনকি পূজোর সময় পর্যন্ত একটা প্যান্ডেলেও যায়নি কোনোদিন। সারাজীবন ছেলে ছেলে করেই আজ জীবনের তিরাশি বছর কাটিয়ে দিলো। বাবাও প্রায় আটবছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

মিনিট চারপাঁচ মা লোহার গেট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি মাকে চলে যেতে বললাম। মা দম দেওয়া পুতুলের মতো পায়ের কাছে রাখা জিনিসগুলো তুলে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। আমি বিবস মায়ের চলে যাওয়া দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখটা বোধয় আরো একবার ভিজে এলো। হটাৎ ড্রাইভার সুখেন বলে উঠলো, “দাদা চলুন, মাসিমা ভিতরে চলে গেছেন।”

ফেরার পথে গাড়িতেও চোখ বুজে বসে ছিলাম। মায়ের জন্য কষ্ট ছোটবেলা পেরিয়ে বড়োবেলা হয়ে এই বুড়োবেলায় এভাবে অনুভব করতে হবে ভাবিনি। হটাৎ সুখেন দেখছি হোয়াটস্অ্যাপে এই ছবিগুলো পাঠালো। আমার সঙ্গদোষ বা গুন জানিনা, ও কখন মায়ের আর আমার ওই দৃশ্য দেখে এগুলো তুলেছে।

তারপর থেকে মনে হচ্ছে কি অদ্ভুত অবস্থায় আমরা দিন কাটাচ্ছি। আজ আমার মা আমাকে ডাকছে অথচ আমি একটু কাছে যেতে পারলাম না। তাহলে এরকম কত সন্তান, কত মা আছে যাদের আজ কতদিন দেখা পর্যন্ত হয়নি। তাদের মনের অবস্থা কি হচ্ছে। আমি তো তাও মাকে দেখতে পেলাম, কেউ কেউ অবস্থার দুর্বিপাকে পরে সেটুকুও করতে পারছেনা। আজব এই ভাইরাস করোনা, সামাজিক দূরত্বের হাত ধরে মানবিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলো। আমার দেশ শুধু নয় বিশ্বের কেউই আজ আমরা ভালো নেই। তবুও একদিন এই ভাইরাস শেষ হবেই, সেদিন হবে আমাদের সকল দুঃখের অবসান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here