দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ  মঙ্গলবারই ছিল আইপিএলের ফাইনাল। আর এদিনই গণনা হল বিহার ভোটের। কিন্তু না গুণে বলে দেওয়া যায় টিভি চ্যানেলের টিআরপি হোক বা নিউজ পোর্টালের হিট— এদিন এগিয়ে ছিল বিহারই। 
গত দুই দশকে সম্ভবত ভোট গণনা নিয়ে এত রোমহর্ষক উত্তেজনা কখনও হয়নি। ইভিএমের গুণতিই জানান দিচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। আর সেই লড়াই শেষে স্পষ্ট বিহারে আরও একবার সরকার গড়তে চলেছে এনডিএ জোট। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় বিজেপি জিতে নিয়েছে ১২৪ টি আসন (গণনা এখন রাত ১২ টায় অন্তিম লগ্নে)। আরজেডি-র নেতৃত্বে মহাজোট জিতেছে ১১০ টি আসনে। সুতরাং নীতীশ কুমারই হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তা নিয়েও দোলাচল নেই।

বিকাশের পক্ষে রায় দিল বিহার, ট্যুইট করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।বিহারের এনডিএ–কে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করলেন প্রধানমন্ত্রী, ‘বিহারের মেয়েরা ভোট করে দেখিয়ে দিলেন, আত্মনির্ভর ভারতে তাঁদের ভূমিকা কতখানি। বিহারের মাতৃশক্তিকে নতুন আত্মবিশ্বাস দেওয়ার জন্য এনডিএ ফের একটি সুযোগ পেল। আমি জানি, এই আত্মবিশ্বাস বিহারকে আরও আগে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিহারের সমস্ত বর্ণের মানুষের ভোটে ফের একবার গণতন্ত্র জয়লাভ করল। এনডিএ–এর সঙ্গে মিলে বিজেপির যেসমস্ত কর্মীরা পরিশ্রম করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। সবাইকে শুভেচ্ছা। বিহারই দেশকে গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ পড়াল। আত্মনির্ভর ভারতের রোডম্যাপ দেখাল যুবরা। ১৫ বছর পরেও বিহারে সুশাসন চালাচ্ছে এনডিএ। ‌বিহারবাসী বুঝিয়ে দিল তাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা কী।’ অমিত শাহ টুইট করলেন, ‌‘‌বিহারবাসী যেভাবে মোদি ও এনডিএ–এর নীতিকে সমর্থন জানিয়েছে, তা আশ্চর্যজনক। আমি বিশেষ করে বিহারের মহিলা ও যুবসমাজকে সাধুবাদ দিতে চাই। কারণ, তাঁরা এনডিএ–কে বেছে নিয়ে রাজ্যের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার পথ নিশ্চিত করে দিলেন। তাঁরা উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিলেন।


তবে নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমারের ঘাম ছুটিয়ে এই ভোটে অবশ্যই আর্বিভাব হল বিহারের নতুন প্রজন্মের এক নেতার। বিহার রাজনীতিতে নতুন ক্যারিশম্যাটিক নেতা—লালু প্রসাদের ছেলে তেজস্বী যাদব। জেলে বন্দী রয়েছেন বাবা। দল চালানোর অর্থের অভাব। এহেন আরজেডি-কে বিহারে বিজেপির সমতুল স্থানে তুলে আনলেন তেজস্বী। ভোট গণনার ওয়ালে যেন অলিখিত ভাবেই লেখা হয়ে গেল, ম্যান অব দ্য ম্যাচ তেজস্বী যাদব।

এদিন গণনা শুরুর প্রথমার্ধে হুহু করে এগিয়ে যাচ্ছিল মহাজোট। কিন্তু বেলা বাড়তেই খেলা ঘুরে যায়। আরজেডি,কংগ্রেস, বামদলগুলির মহাজোটকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় বিজেপি-নীতীশ কুমারের জোট। বিকেলের পর থেকে আবার রুদ্ধশ্বাস লড়াই। গায়ে গায়ে এসে পড়ে আসন সংখ্যা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামাম বুথ ফেরত সমীক্ষাকে দশ গোল দিয়ে বিহারে ফের সরকার গঠন করল বিজেপি-নীতীশ কুমার।


বিহারে মজাদার ভোট হল এবার
বস্তুত বিহারে এবার যখন ভোটের ঘোষণা হয়েছে, তখন থেকেই প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছিল বিজেপি। তার কারণও ছিল। বিরোধী জোট ছিল ছত্রভঙ্গ। তেজস্বী যাদবরা এখন ভোটই চাইছিলেন না। আসন নিয়ে আলোচনা পরের কথা, কংগ্রেস- বামেদের নিয়ে তাদের মহাজোট তখনও দানা পাকেনি।


কিন্তু ভোটের প্রচার শুরু হতেই ছবিটা বদলে বদলে যেতে থাকে। দেখা যায়, তেজস্বী যাদবের সভায় উপচে পড়ছে ভিড়। উদ্বেল তাঁর অনুগামীরা। আর নীতীশ কুমারের সভায় তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। ভোটের আপাতত চেহারায় ব্যাকফুটে নীতীশ। উপরি বিষফোঁড়ার মতো সকাল বিকেল তাঁর নিন্দে মন্দ করে চলেছেন এনডিএ-রই আর এক শরিক চিরাগ পাসোয়ান।

এমনিতেই অনেকে বলেন, বিহারের মানুষ খুবই রাজনীতি সচেতন। তার উপর নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন এক টানা ১৫ বছর। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল তীব্র।


তার পর ৭ নভেম্বর ভোট শেষ হতেই বুথ ফেরত সমীক্ষায় দেখা যায়, সকলেই এক বাক্যে বলছেন সংকটে রয়েছেন নীতীশ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট। আর এই সব সমীক্ষার মধ্যে বিজেপি-নীতীশকে সব থেকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল দুটি সমীক্ষা। চাণক্যর সমীক্ষা জানিয়েছিল বিহারে তেজস্বীরা পেতে পারেন ১৮০ টিরও বেশি আসন। তথা বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী নীতীশ-বিজেপির। আর অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া বলেছিল, তেজস্বীরা পেতে পারে ১৬১ টি আসন, অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে মহাজোট।
বুথ ফেরত সমীক্ষা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত হয়ে পড়েন কংগ্রেস, বামেরা। তার থেকেও বেশি উচ্ছ্বাস দেখা যায় তৃণমূলের এক শ্রেণির নেতার মধ্যে। বিহারের ভোট গণনা শেষ হতেই তাঁরা সংবাদমাধ্যমে কী বলবেন তার মকশো করে ফেলেন।

‘বদলাও’ হল না, কিন্তু কেন?


এক, তেজস্বী যাদবের পক্ষে তাগড়া জাত সমীকরণ ছিল ঠিকই। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের বড় অংশের মতে, সমাজের সব শ্রেণির ভোট তাঁরা পাননি। নীতীশ যেহেতু এবারও বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, তাই বিহারে যাদব ও মুসলিম ভোটের সিংহভাগই গিয়েছে আরজেডির দিকে।

যাদবদের সেই ইউফোরিয়া দেখা গিয়েছে প্রচারের সময়েও। কিন্তু এও ঠিক, সব বয়সের মানুষ তাঁর উপর ভরসা করতে পারেননি। ১০ লক্ষ যুবককে সরকারি চাকরি দেবেন বলেছিলেন তেজস্বী। তাতে যুব সমাজের একাংশ উদ্বুদ্ধ হলেও অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হয়েছে। তা ছাড়া তেজস্বীর মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার মতো অভিজ্ঞতাও নেই।


মহাজোটের হারের নেপথ্যে কংগ্রেসও একটা কারণ বলে অনেকের মত। কারণ ৭০ টি আসনে লড়ে কংগ্রেস ২০ টি আসনও জিততে পারেনি। অর্থাৎ আরজেডি আরও আসনে লড়লে বরং জোটের পক্ষে ভাল হতে পারত।
নীতীশের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ যে ছিল তা ভোট ফলাফলেই পরিষ্কার। তবে ভোট পণ্ডিতদের অনেকের মতে, মহিলাভোট বিজেপি-নীতীশ বেশি পেয়েছে। বিহারে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মহিলা ভোটকে পাখির চোখ করেছিলেন নীতীশ। কারণ, তাঁর জাত তথা কুর্মীদের ভোট বিহারে বেশি নেই। তাই অতি পিছড়া ও মহিলা ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করার কৌশল নিয়েছিলেন। সে জন্য বিহারে মদ বিক্রিও নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের কল্যাণে উজ্জ্বলা যোজনায় গ্যাস ও অন্যান্য সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন মহিলারা। তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ভোটে।

বিহারে গত পনেরো বছর ধরে টানা ক্ষমতাসীন জোটে রয়েছে বিজেপি। কিন্তু ঘোর বাস্তব হল, প্যান বিহার গ্রহণযোগ্য নেতা বিজেপির নেই। বাংলায় যেমন, অরূপ বিশ্বাস, ববি হাকিমরা বড় মন্ত্রী হলেও রাজ্যের সর্বত্র তাঁদের ব্যক্তিগত আবেদন কাজ করে না। বিহারে রবিশঙ্কর প্রসাদ, রাজীব প্রতাপ রুডি, শাহনওয়াজ হোসেনের মতো নেতারাও সব এলাকার নেতা।

কিন্তু সমগ্র বিহারে নরেন্দ্র মোদীর এখনও ভাল গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিহারে ভোটের সময়ে মোদীর সভায় ভিড় দেখে যেমন তা বোঝা গিয়েছে, তেমনই এ কথা বিহারের বিজেপি নেতারা ঘরোয়া ভাবে বলছিলেন।
আজ ভোটের ফল প্রকাশের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এক বাক্যে স্বীকার করছেন, বিহারে নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ভরপুর ছিল। বলা যেতে পারে মোদীই তাঁকে টেনে তুলেছেন।


তবে বিজেপি নেতারা জানাচ্ছেন, প্রতিশ্রুতি থেকে সরবেন না তাঁরা। ছোট শরিক হলেও মুখ্যমন্ত্রী হবেন নীতীশই। এদিন জয় সুনিশ্চিত হতেই তার স্পষ্ট বার্তাও দিয়েছেন মোদী-শাহরা। নীতীশকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দুজনেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here