দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুয়ারে সরকার’ জীবনযুদ্ধে বাঁচার অক্সিজেন জোগাল আলো বিশ্বাস -কে। চাকরি নেই তাঁর স্বামীর। এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। স্কুলপড়ুয়া দশ বছরের ছেলের পড়াশোনার খরচ রয়েছে। বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ করোনার ভীতি। চিকিৎসার খরচ যে আকাশছোঁয়া! তাই বনগাঁয় স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের জন্য আবেদন করতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন আলো। তিনি উচ্ছ্বসিত, ‘এটা খুব ভালো কাজ। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার সুযোগ পাওয়াটা স্বপ্নের অতীত ছিল।’

বনগাঁ পুরসভার জয়পুর তালতলা জিএসএফ স্কুলে শিবিরের সূচনা করেন বনগাঁর মহকুমাশাসক প্রেম বিভাস কাঁসারি। প্রথম দিনই সমস্ত শিবিরে প্রচুর ভিড় ছিল। অনেক জায়গাতেই দূরত্ববিধি শিকেয় ওঠে। মাস্ক ছিল না অনেকের। দিপালী দেবনাথ নামে এক মহিলা বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য সাথীর কার্ড করতে এসেছিলাম। ফর্ম দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে পুরসভায় জমা দিতে।’’ মহকুমার প্রায় সব ব্লকেই এ দিন কর্মসূচি শুরু হয়েছে। অশোকনগর পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের দেবীনগর বালিকা বিদ্যালয়ের শিবিরে আসা উপভোক্তারা জানান, বাড়ির কাছে সরকারি পরিষেবা পেয়ে তাঁরা উপকৃত হয়েছেন।

বনগাঁ থেকে কলকাতা, কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার- আলোর ছবিটাই দেখা গেল বাংলা জুড়ে। ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার রাজ্যজুড়ে শুরু হয়ে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি। আর প্রথম দিনই প্রশাসনিক ক্যাম্পগুলিতে জমা পড়ল ২ লক্ষেরও বেশি আবেদন। দুয়ারে সরকার-এ যে প্রকল্পগুলির ডালি সাজিয়ে মমতা মানুষের দরবারে সামিল হয়েছেন, তাতে স্বাস্থ্যসাথী ছাড়াও রয়েছে খাদ্যসাথী, কন্যাশ্রী, কৃষকবন্ধু, রূপশ্রী, শিক্ষাশ্রী বা রূপশ্রী। কিন্তু প্রথম ইনিংসেই ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়েছে স্বাস্থ্যসাথী। এদিন সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত শুধু এই প্রকল্পের জন্যই জমা পড়েছে ১,৩৮,৬০৭টি আবেদনপত্র। শুধু স্বাস্থ্যসাথীর জন্য এই ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডায় মানুষ লাইন দিয়েছেন ভোর চারটে থেকে!

সরকারের এই কর্মসূচিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের সাড়া এবং প্রশাসনের তৎপরতা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘দুয়ারে সরকার’ শুধু তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত কর্মসূচিই নয়, এর রূপরেখা তিনিই তৈরি করেছেন। যার ফলে ব্যাপ্তি বেড়েছে স্বাস্থ্যসাথীর, রাজ্যের অনেক বেশি মানুষ এই সরকারি প্রকল্পের আওতায় এসেছেন। তাই বনগাঁর জয়পুরে লাইনে দাঁড়ানো আয়েষা খাতুন বা শাহেনা বেগমরা সবাই খুশি, সকলের মুখেই মমতার গুণগান। খুশি মমতাও। এদিন টুইটে তাঁর আহ্বান, ‘বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এবং সরকারি পরিষেবার সুযোগ নিতে সবাই আরও বেশি করে প্রশাসনিক ক্যাম্পে যান।’ মোট চার দফায় কোন কোন সময়ে ক্যাম্প বসবে, টুইটারে তা-ও রাজ্যবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে স্বাস্থ্যসাথীর সাফল্য মমতার জন্য ইভিএমে মাস্টারস্ট্রোক হয়ে উঠতে পারে। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প যে রাজ্য রাজনীতিতে বিরোধীদের পালের হাওয়া বেশ খানিকটা কাড়তে চলেছে, ‘দুয়ারে সরকারের’ পয়লা দিনের শিবিরগুলিতেই মানুষের ঢল সেই ইঙ্গিত দিয়েছে। ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডের শিবিরে দাঁড়িয়ে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলছিলেন, ‘আমি এখান থেকেই রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছি। আমি সবিনয়ে জানাচ্ছি, আজ ক্যাবিনেটে আমি আপনাদের তরফ থেকে, মানুষের তরফে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করব। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের জন্যই এই ধন্যবাদ তাঁর প্রাপ্য। আপনারা কী বলেন?’ সেই মুহূর্তে বহু মানুষের হাততালি নিশ্চিত ভাবেই অক্সিজেন জোগাবে সরকার ও তৃণমূলকে।

বিরোধীরাও জনমুখী এই প্রকল্প নিয়ে খুব একটা সরব হয়নি। তারা অবশ্য ঘুরিয়ে আক্রমণ করেছে সরকারকে। বিজেপি নেতা শমীক ভটাচার্যের কটাক্ষ, ‘শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন হয় না। তাঁদের বদলির ক্ষেত্রেও সরকারের নীতি অস্বচ্ছ। অথচ ভোটের আগে অনৈতিকভাবে সেই শিক্ষকদের বাধ্য করা হচ্ছে সরকারের কাজের খতিয়ান তুলে ধরতে। এটা কি শিক্ষকদের কাজ!’ সিপিএম নেতা সূজন চক্রবর্তীও এদিন রাজ্য সরকারের এই কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘এতদিন মুখ্যমন্ত্রী বলতেন একশো শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে। তা হলে এখন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতে হচ্ছে কেন?’

স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে আরও একটি বাড়তি পাওনা নারী বিকাশ ও উন্নয়নের পক্ষে জোরদার সওয়াল। কারণ, পরিবারের কর্ত্রীর নামেই কার্ডটি দেওয়া হবে। এদিন শিবিরগুলিতে তাই চোখে পড়ার মতো ভিড় ছিল মহিলা আবেদনকারীদের। মধ্য পূর্বাচলে দীপালি দাস, মৌমিতা নাইয়ারা বলছিলেন, ‘আমাদের নামেই তো কার্ড হচ্ছে। এটাও কম ব্যাপার নয়।’

সব মিলিয়ে, ২০২১-এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মুখে ‘সকলের’ জন্য স্বাস্থ্যসাথী যে ক্রমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুরুপের তাস হয়ে উঠছে, তা দুয়ারে সরকারের প্রথম দিনেই স্পষ্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here