দেশের সময়: দুর্গাপুজো শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় কালীপুজোর প্রস্তুতি । বঙ্গদেশে কালীপুজোর প্রবর্তন করেছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ৷ সেই থেকেই সারা বাংলায় মহাসমারোহে পালিত হয় শ্যামাপূজা অথবা কালীপূজা। বাংলার কালী আরাধনা ও তার মাহাত্য ইতিহাস ও পুরাণেই উল্লিখিত আছে ৷ এই বঙ্গেই আছে বেশ কয়েকটি সতী পীঠ ৷

এরমধ্যে মুশির্দাবাদের কিরীটেশ্বরী, বীরভূমের তারাপীঠ, নলহাটি, কঙ্কালীতলা, নন্দিকেশ্বরী, ফুল্লরা, কলকাতার কালীঘাট বিশেষ উল্লেখযোগ্য ৷ তবে কলকাতা নামের সাথেই জড়িয়ে আছে কালীর নাম; এখানে কালীঘাট ছাড়াও রয়েছে দক্ষিনেশ্বর, আদ্যাপীঠ, লেক কালীবাড়ি, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, চিত্তেশ্বরী, সিদ্ধেশ্বরী, পুঁটে কালী, ফিরিঙ্গি কালী, চিনে পাড়ার চাইনিস কালী ইত্যাদি ইত্যাদি সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কোলকাতার কালী কথাও নেহাত স্বল্প নয়; আর এই কালী পুজোর সময় মায়ের যে ভোগ হয় তা অন্যান্য পুজোর থেকে বেশকিছুটা আলাদা। স্থান বিশেষে নিরামিষ ভোগের সাথে মায়ের পুজোতে আমিষ ভোগও থাকে। নিরামিষ ভোগের মধ্যে যেমন থাকে অন্ন ভোগ, পোলাও ভোগ – সাদা ভাত, খিচুড়ি, শুক্ত, শাক, ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, আলু পটোলের তরকারি, ফুলকপির তরকারি, লুচি, ছানার তরকারি, খেজুরের চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ৷

আমিষ ভোগে মা কে নিবেদন করা হয় যেকোনো আঁশযুক্ত মাছ রুই মাছ, কাতলা মাছ, ইলিশমাছ, চুনো মাছের টক, পোড়া শোলমাছ মাখা আর পিয়াঁজ রসুন ছাড়া নিরামিষ কচি পাঁঠার মাংস ৷ শোলমাছ পোড়া মূলতঃ তারাপীঠেই দেয়া হয়ে থাকে আবার চুনো মাছের টক দেওয়া হয় লাভপুরের ফুল্লরায়, কালীঘাটে মায়ের ভোগে থাকে চিংড়ি মাছও ৷

এদেরমধ্যে আবার সব জায়গায় মাংস নিবেদন করা হয় না। দক্ষিনেশ্বর এবং আদ্যাপীঠে মায়ের নিরামিষ ভোগ হয়৷এরমধ্যে আবার সাদা ভাত এবং খিচুড়ি ভোগ অবশ্যম্ভাবী। কালীঘাটে দিনের বেলা হয় অন্ন ভোগ এবং পোলাও ভোগ, রাতে হয় খিচুড়ি ভোগ৷ সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্থান কাল পাত্র বিশেষে পার্থক্য রয়েছে মা কালীর ভোগেও । তাই এইসব বিভিন্ন জায়গার ভোগের ধরণ অনুযায়ী এবারের দেশের রান্নাঘরের মেনুতে রইলো কালীপুজোর ভোগ ।

নারকেল কোৱা দিয়ে পাঁচ মিশালী তরকারি –
উপকরণ: মাঝারি সাইজের আলু ৪টে, পটল ৬টা, মাঝারি মাপের কুমড়ো দুই ফালি, বেগুন ১ টা, ঝিঙে ৩টে, ঘি ২ বড় চামচ, পাঁচফোড়ন ১ চা চামচ, তেজপাতা ২টি, নুন ১ চা চামচ, কাঁচা লঙ্কা ২ টি, নারকেল কোৱা এক কাপ , জল হাফ কাপ।
প্রণালী: সব সবজি ডুমো করে কেটে নিতে হবে৷ কড়াইতে ঘি গরম করে পাঁচ ফোড়ন ও তেজপাতা দিয়ে, সব সবজি দিয়ে নুন ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভালো করে ভাজতে হবে৷ অল্প জলের ছিটে দিতে হবে। সবজি ভাজা হয়ে নরম হয়ে গেলে ওপরে নারকেল কোৱা দিয়ে আবার ভালো করে ভাজতে হবে৷ এরপর সামান্য ঘি ছড়িয়ে নামাতে হবে।

ভাজা মুগের ডাল পোরো –
উপকরণ: সোনামুগের ডাল ২৫০ গ্রাম, কাঁচা লঙ্কা ২ – ৩ টি, ২ বড় চামচ, তেজপাতা একটি, আদা বাটা ১ মাঝারি চামচ, নুন ২ চামচ, চিনি দেড় চামচ, দুধ এক কাপ৷
প্রণালী: ডাল ভেজে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে৷ কড়াইতে ঘি গরম করে তেজপাতা দিয়ে আদাবাটা ভেজে নিতে হবে, এরমধ্যে ডাল ঢেলে নুন, চিনি ও দুধ দিয়ে ভালো করে ফোটাতে হবে ৷বেশ ঘন হয়ে এলে নামাতে হবে।

ফুলকপির ছেঁচকি –
উপকরণ : ফুলকপি ১ টি, কুঁচো চিংড়ি ১২৫ গ্রাম, কালো সর্ষে ১ মাঝারি চামচ, সাদা সর্ষে ১ চা চামচ, শুকনো লঙ্কা ২ টো, কাঁচা লঙ্কা ২টো, হলুদ গুঁড়ো হাফ চা চামচ, জল ২ কাপ, নুন দেড় চা চামচ, সর্ষের তেল বড় সাড়ে চার চামচ।

প্রণালী: চিংড়ি খোলা ছাড়িয়ে ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে৷ ফুলকপি সরু করে কুচিয়ে ধুয়ে অল্প ভাপিয়ে জল ঝরিয়ে নিতে হবে৷ কালো সর্ষে ও শুকনো লঙ্কা শুকনো ভেজে গুঁড়িয়ে নিতে হবে। সাদা সর্ষে বেটে নিতে হবে৷ কড়াইতে দেড় বড় চামচ তেল দিয়ে কুচ চিংড়ি মুচমুচে করে ভেজে গুঁড়িয়ে নিতে হবে; এরমধ্যে বাটা সর্ষে, নুন, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আলাদা রাখতে হবে৷ আবার কড়াইতে তেল দিয়ে একটা শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ফুলকপি ভালো করে ভাজতে হবে, এরমধ্যে আলাদা রাখা মাছ ও বাটা মশলার মিশ্রণ দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে৷ এরপর শুকনো ভাজা মশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে নামাতে হবে৷

শোলমাছ পোড়া –

উপকরণ: বড় শোল মাছ ১ টি, কাঁচা লঙ্কা ২টো, সর্ষের তেল ৩ বড় চামচ, সর্ষের ফুল অথবা মুলোর ফুল ৬০ গ্রাম, নুন দেড় চা চামচ, রাই সর্ষে বাটা ১ চা চামচ, বড় কলাপাতা ১ টা ৷
প্রণালী: শোলমাছ ভালো করে ঘষে ধুয়ে নিতে হবে৷ সর্ষের ফুল ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে৷ এরপর মাছের মধ্যে সর্ষের ফুল, সর্ষে বাটা, কাঁচা লঙ্কা বাটা, নুন ও সর্ষের তেল দিয়ে মেখে রাখতে হবে। এক হাত লম্বা কলাপাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে শুকনো করে নিতে হবে; এরপর কলাপাতায় ১ মাঝারি চামচ সর্ষের তেল মাখিয়ে এরমধ্যে মশলা মাখা শোলমাছ রেখে, কলাপাতা ভালো করে মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে নিতে হবে৷ এটিকে আগুনে নরম আঁচে পোড়াতে হবে। কলাপাতা পুড়ে কালো হয়ে গেলে আগুন থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এবার পোড়া কলাপাতার ভিতর থেকে মাছ বের করে কাঁটা বাদ দিয়ে মশলা ও মাছ চেঁছে নিতে হবে, এবার এই মশলা মাখা মাছের মধ্যে দেড় বড় চামচ সর্ষের তেল দিয়ে ভালো করে মেখে নিতে হবে৷

নিরামিষ পাঁঠার মাংস –

উপকরণ: ছোট পাঁঠার সামনের থাইয়ের মাংস ১ কেজি, বড় সাইজের আলু ৬টি, নুন ৪ বড় চামচ, সন্ধক লবন ১ বড় চামচ, দই ২৫০ গ্রাম, হলুদ বাটা ২ চা চামচ, আদা বাটা দেড় বড় চামচ, ভাজা ধনে গুঁড়ো দেড় বড় চামচ, ভাজা পাঁচফোড়ন গুঁড়ো দেড় চা চামচ, শুকনো লঙ্কারগুঁড়ো ২ চা চামচ, চিনি দেড় চা চামচ, গাওয়া ঘি ১ কাপ, সর্ষের তেল হাফ কাপ, কাঁচা লঙ্কা ৬টি, ছোট এলাচ ১৫টি, লবঙ্গ ১৫ টি, তেজপাতা ৪টি, গরম জল ১ লিটার ৷
প্রণালী : মাংস ধুয়ে আড়াই চা চামচ নুন, ২ চা চামচ হলুদ বাটা ও সমগ্র আদা বাটা দিয়ে মাখিয়ে ২ ঘন্টা ম্যারিনেট করতে হবে। এরপর এতে ভালো করে দই মাখিয়ে আবার দুঘন্টা ম্যারিনেট করতে হবে৷আলু ডুমো করে কেটে অর্ধেক ভেজে তুলে নিতে হবে৷ কড়াইতে আবার তেল গরম করে তেজপাতা, লবঙ্গ ও ছোট এলাচ ফোড়ন দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংস দিতে হবে, মাখানো বাকি থাকা ম্যারিনেশনের মশলা আলাদা সরিয়ে রাখতে হবে৷ মিনিট ১৫ অনেক বেশি আঁচে চাপা দিয়ে রাখতে হবে৷ এরপর হালকা আঁচে ভালো করে চাপা দিয়ে এক ঘন্টা বসিয়ে রাখতে হবে ও ১০ মিনিট অন্তর কষতে হবে যাতে কড়া ধরে না যায়৷ এক ঘন্টা পরে গাওয়া ঘি, আলু, নুন, লঙ্কা গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, বাকি হলুদ বাটা, তিন বড় চামচ জল দিয়ে ভালো করে সব মশলা দিয়ে কষে ২০ মিনিট চাপা দিয়ে রাখতে হবে৷ এরপর গরম জল, সন্ধক লবন, ঘরে ভাজা পাঁচ ফোড়ন দিয়ে ভালো করে নেড়ে চাপা দিতে হবে যতক্ষণ না হাড় থেকে মাংস খুলে আসে ও নরম হয় এবং ঝোল ফুটিয়ে নিতে হবে। নামিয়ে গরম গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশনকরতে হবে ৷

মৌরলা মাছের টক –
উপকরণ: মৌরলা মাছ ২৫০ গ্রাম, শুকনো লঙ্কা ৪ টি, পাঁচ ফোড়ন ২ চা চামচ, এক ছড়া তেঁতুলের ক্বাত, হলুদ গুঁড়ো হাফ চা চামচ, নুন হাফ চা চামচ, গুড় দুই বড় চামচ, সর্ষের তেল দুই বড় চামচ, জল দেড় কাপ ।
প্রণালী: মৌরলা মাছ ধুয়ে জল ঝরিয়ে, নুন হলুদ মাখিয়ে মুচমুচে করে ভেজে নিতে হবে। এরপর কড়াইতে তেল গরম করে শুকনো লঙ্কা ও পাঁচফোড়ন দিতে হবে, এরপর তেঁতুলের ক্বাত, নুন, হলুদ ও গুড় দিয়ে কষে জল দিতে হবে ; ফুটতে শুরু করলে ভাজা মৌরলা মাছ ঢেলে দিতে হবে, ঝোল ফুটে ঘন হয়ে এলে নামাতে হবে ৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here