পার্থসারথি সেনগুপ্ত , বনগাঁ:   রবিবার ব্রিগেডে তৃণমূলের জনগর্জন সভামঞ্চ থেকে বিশ্বজিৎ দাসের নাম ঘোষণা হতেই মতুয়াগড়ে রব ওঠে এবার ঠাকুরবাড়ির কোন প্রতিনিধি অর্থাৎ মতুয়া ভক্তকে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে টিকিট দিল না তৃণমূল।

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে লড়বেন বিশ্বজিৎ দাস। ঠাকুরবাড়ির কোন প্রতিনিধির বাইরে গিয়ে এ বারেই প্রথম বনগাঁ কেন্দ্র থেকে বিশ্বজিৎকে প্রার্থী করল তৃণমূল।

অন্য দিকে, অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা বনগাঁ প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ তথা বর্তমান  রাজ্যসভার সাংসদ মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘ বিশ্বজিৎ মতুয়া ভক্ত ,ঠাকুরবাড়ি-সহ মতুয়াদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে তফসিলি জাতির বিশ্বজিতের।’’

এ প্রসঙ্গে দেশের সময়’কে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘আমি নিজেই তো মতুয়া,’’ ঠাকুরবাড়ির বাইরের লোক কে বললো ’’!  আমরা সকলেই হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর পরিবারের সদস্য । তিনি আমাদের সকলের আরাধ্য দেবতা এই  সমাজ ও জগতের সকলেই তাঁর বৃহৎপরিবারের ভক্ত ও সদস্য ’’ ।

বিশ্বজিতের কথায়, মতুয়া-সহ ঠাকুরবাড়ি কেন্দ্রিক সব ধরনের যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। মতুয়া কমিটির সদস্যও হয়েছেন তিনি।

পর্যবেক্ষকদের মতে মতুয়া ভোট ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে মতুয়াদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা বিশ্বজিৎ দাসের উপরেই ভরসা রেখেছে দল।

রবিবার ব্রিগেডের জনগর্জন সভামঞ্চ থেকে বিশ্বজিৎ দাসের নাম ঘোষণা হতেই উচ্ছ্বাসে মাতলেন বনগাঁর তৃণমূলের কর্মীরা। এলাকায় ফ্লেক্স লাগানো থেকে নিজের মধ্যে আবির খেলা, মিষ্টি বিলি শুরু হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ।তখন বনগাঁ পুরসভার পুরপ্রধান ছিলেন শঙ্কর আঢ্য।

মূলত শঙ্করের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধের জেরেই কয়েকজন কাউন্সিলার নিয়ে দল ছেড়েছিলেন বিশ্বজিৎ। শুধু দল ছাড়াই নয় ,২০২১ সালে বিজেপির টিকিটেই বাগদা থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। কিন্তু বনগাঁর বিজেপি সংসদ শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর হওয়ার কারণে জেলার রাজনীতিতে তেমন কল্কে পাননি বিশ্বজিৎ।

ফলে গেরুয়া দলের প্রতি মোহভঙ্গ হতেও সময় লাগেনি বেশি। বিজেপির বিধায়ক থাকাকালীনই আচমকাই বিধানসভার অলিন্দে দাঁড়িয়ে পায়ে হাত দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রণাম করেছিলেন তিনি। একজন বিজেপি বিধায়কের এহেন আচরণে গেরুয়া শিবিরের অন্যান্য বিধায়করা হতবাক হয়ে পড়েন। সেই থেকেই বিশ্বজিতের ঘর ওয়াপসির কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছিল। ওই বছরেই বিশ্বজিৎ দাস তৃণমূলে ফিরে আসেন।

দলত্যাগের পরের বছর ২০২২ সালেই দল তাঁকে বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার তৃণমূলের সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিল। ততদিনে বিশ্বজিৎ দাস ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দলের সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার বনগাঁ পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল নিরঙ্কুশ জয় পায়। রাজ্য জুড়ে জনজোয়ার কর্মসূচি নিয়ে বনগাঁয় এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

জনজোয়ার কর্মসূচি সফল করতেও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। এরপর থেকেই অভিষেকের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বিশ্বজিৎ। বিশ্বজিৎ দাস যে এই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হবেন, তার একটা আভাস ছিলই। তাই দিদির দূত, দিদিকে বলো কর্মসূচি-সহ ঘর ঘর জনসংযোগেও বনগাঁ সহ বাগদায় চষে বেড়িয়েছেন বিশ্বজিৎ।

বিশ্বজিৎ বলেন, ‘গত পাঁচ বছর বনগাঁয় কোনও উন্নয়নের কাজ করেননি শান্তনু ঠাকুর। বরং একশো দিনের কাজ থেকে আবাস যোজনায় বঞ্চিতদের হয়ে পাশে থাকেননি বিজেপির সাংসদ। নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা নিয়ে ভাঁওতা দিয়েছেন মতুয়াদের। এবার বনগাঁর মানুষ বিজেপিকে পরাজিত করবেই।’

বিশ্বজিতের কথায়, ‘দলের কিছু মানুষের শুদ্ধকরণের জন্য দল ছেড়েছিলাম। দল এবং বনগাঁর মানুষ আমার পাশেই আছেন।’

অন্যদিকে লোকসভা ভোটের আগে গোষ্ঠীকোন্দল মেটাতে রবিবার গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে বৈঠক করেন শুভেন্দু অধিকারী।

লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি নেতৃত্বের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলায় দলের গোষ্ঠীকোন্দল। লোকসভা ভোটে বনগাঁ কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে ইতিমধ্যেই বর্তমান সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের নাম ঘোষণা করেছে বিজেপি। তারপরেও কিছু বিধায়ক, নেতা শান্তনুর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন বলে অভিযোগ। এরই মধ্যে শান্তনুর দাদা, গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুরকে নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, তিনি নাকি তৃণমূলে যোগদান করতে চলেছেন। শান্তনু এবং সুব্রত ঠাকুরের মধ্যে অনেক দিন হল কার্যত কথাবার্তা বন্ধ বলেই দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে এ বার দলের দু’পক্ষকে এক ছাতার তলায় এনে দলের মধ্যে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে পদক্ষেপ করলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ শুভেন্দু ঠাকুরবাড়িতে আসেন। সুব্রত ঠাকুরের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন। কথা বলেন সুব্রতের বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গেও। এ দিন শান্তনু-সুব্রত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল এবং কল্যাণীর বিধায়ক অম্বিকা রায়।

বৈঠক শেষে শান্তনু এবং সুব্রতকে দু’পাশে বসিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন শুভেন্দু। তাঁর তৃণমূলে যোগদানের গুঞ্জন নিয়ে সুব্রত সেখানে বলেন, ‘‘মাসখানেক ধরে তৃণমূলের থেকে এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এবং বিজেপি কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে এমন করা হচ্ছে।’’

এ বিষয়ে শুভেন্দুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই গুজব সম্পূর্ণ মিডিয়ার তৈরি করা (প্ল্যান্টেড)। সুব্রত ঠাকুর মোদী পরিবারের একনিষ্ঠ সদস্য। খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ।’’ এ দিন দেবদাস এবং সুব্রত ঠাকুরের আমন্ত্রণে ঠাকুরবাড়িতে এসেছেন বলে জানান বিরোধী দলনেতা।

অন্য বিধায়কদের দেখা গেল না কেন?

বিধায়কদের অনুপস্থিতির বিষয়ে বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘অশোক ও অসীম সন্দেশখালিতে ছিলেন বলে আসতে দেরি হয়েছে। স্বপনের ব্যক্তিগত কাজ ছিল বলে আসতে পারেননি। সকলের সঙ্গেই ভিডিয়ো কলে কথা হয়েছে।

বিজেপির মধ্যে কোনও মতানৈক্য নেই। আমরা সকলে মিলে ভোটে লড়াই করে শান্তনু ঠাকুরকে ২ লক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী করব।’’

শান্তনু এ দিন বলেন, ‘‘তৃণমূল ঠাকুরবাড়িতে গোলমাল বজায় রাখতে মমতা ঠাকুরকে রাজ্যসভার সাংসদ করেছে।’’

শুভেন্দুর বৈঠক নিয়ে তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস (বনগাঁ কেন্দ্রে সদ্যঘোষিত তৃণমূল প্রার্থী) পরে বলেন, ‘‘ সম্পূর্ণভাবে গোষ্ঠীকোন্দলে ডুবে থাকা একটা দল বিজেপি। এরা মানুষের পাশে থাকে না। লোকসভা ভোটের পরে বনগাঁ কেন্দ্র থেকে ওদের দলটাই কপ্পুরের মতো উবে যাবে।’’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here