দেশের সময়: মিষ্টি সুবাস। লাল টুকটুকে। দূর দেশের ফল হলেও এখন হাতের নাগালেই। এ রাজ্যে চাষের এলাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় দামেও কিছুটা লাগাম এসেছে। দেখতে যেমন মোহময়ী, স্বাস্থ্যগুণেও জুড়ি মেলা ভার। স্বাদে-গন্ধে মাত করতে এখন অনেক খাবারেই যোগ করা হয় স্ট্রবেরি।

আইসক্রিম থেকে কেক-কুকিজ, জ্যাম-জেলিতে অন্য মাত্রা এনে দেয় এই ফলটি। যে কোনও রকমের ডেজার্ট কিংবা লিপ বাম থেকে শুরু করে শ্যাম্পু, প্রসাধনী সামগ্রীতে স্ট্রবেরি ফ্লেভার পছন্দ করেন না, এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। শুধু তাই নয়, স্ট্রবেরি থেকে যেমন তৈরি হয় চকোলেট, তেমনই হয় মকটেল। দুর্দান্ত এই ফলটির খোসা, বীজ কিছুই ফেলার নয়। সবেতেই লুকিয়ে রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টিগুণ। আর এ কারণেই বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ফল হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছে স্ট্রবেরি।

১৭৪০ সালে ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে প্রথম স্ট্রবেরি চাষ হয়। পরবর্তীতে এটি চিলি, আর্জেন্টিনা সহ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত এটি শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল। সেকারণে আমাদের দেশেও যেসব অঞ্চলে শীত একটু বেশিদিন থাকে, সেখানে ভালোভাবেই স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে।

সৌন্দর্যের কারণে তো বটেই, শরীরকে সুস্থ রাখতে বহু মানুষেরই পছন্দের তালিকায় একেবারে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিয়েছে এই ফলটি। ডায়েটারি ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ছাড়াও স্ট্রবেরিতে রয়েছে পর্যাপ্ত মাত্রায় ভিটামিন সি, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, মিনারেল সহ স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি বহু উপাদান। ফলে হার্টের অসুখ প্রতিরোধ থেকে ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে স্ট্রবেরির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। নিয়মিত স্ট্রবেরি খেলে ত্বকের জেল্লা বাড়ে। শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়ে না। চুল পড়া রোধ করে এই ফল। চোখ ভালো রাখে। ওজন থাকে নিয়ন্ত্রণে।

স্ট্রবেরির কয়েকশো প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয়। প্রথমেই বলতে হয়, জুন বিয়ারিং স্ট্রবেরি। বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে চাষ হয় এটির। জুন মাসে এই প্রজাতির স্ট্রবেরি পাকে। জুন বিয়ারিং স্ট্রবেরির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আর্লিগ্লো, হোনয়, অলস্টার, জুয়েল প্রভৃতি। স্ট্রবেরির আরএকটি ধরন হল, এভার বিয়ারিং। নামটি শুনে মনে হতে পারে চিরকালীন।

কিন্তু এ ধরনের স্ট্রবেরি বছরে দু’বার হয়। একবার শীত-বসন্তে, আর একবার গরমের শেষের দিকে। এই তালিকায় সবচেয়ে পরিচিত জাত ওজার্ক বিউটি। স্ট্রবেরির তৃতীয় ধরন, ডে নিউট্রাল। এগুলি মূলত গরমকালের। তবে আমাদের রাজ্যের আবহাওয়ার চরিত্র যা তাতে সুইটচার্লি, চ্যান্ডেলার, টিয়োগার মতো জাতগুলি ভালোভাবে হতে পারে বলে জানাচ্ছেন উদ্যানপালন বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে অক্টোবর থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত স্ট্রবেরি পাওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রবেরিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পলিফেনল যৌগ স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারি। এইসব উপাদান বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। সেই সঙ্গে স্ট্রবেরিতে থাকা ভিটামিন সি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি ত্বক ও চুলের যত্ন নিতেও সাহায্য করে। ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় খিদে দমন করতে সহায়তা করে স্ট্রবেরি। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এই ফলটিতে থাকা ডায়েটারি ফাইবার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরাও অনায়াসেই খেতে পারেন। মেদ ঝরাতে সাহায্য করে। ফ্লাভোনয়েড থাকায় অনাবশ্যক রক্ত জমাট বাঁধে না শরীরে। ফলে বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। সূর্যের অতিরিক্ত অতি বেগুনি রশ্মির হাত থেকে চোখকে বাঁচাতে ভিটামিন সি খুব বেশি করে দরকার হয়। তাছাড়া ভিটামিন সি ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না।

সেক্ষেত্রে দারুণ সাহায্য করতে পারে স্ট্রবেরি। এই ফলটিতে থাকা পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এক কাপ স্ট্রবেরিতে ক্যালোরির পরিমাণ ৪৯ গ্রাম। ফলে অনায়াসেই আপনার ডায়েটে যোগ করতে পারেন এই ফলটি। ক্ষতিকারক জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে বারেবারে খাওয়া যেতে পারে স্ট্রবেরি। এতে পেটও ভরবে। শরীরও থাকবে সুস্থ। বলা হয়, দিনে দু’কাপ স্ট্রবেরি জ্যুস খেলে শরীরে ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণ হয়। প্রতিদিন যদি আটটি করে স্ট্রবেরি খাওয়া যায়, তা হলে সুস্থ থাকে হার্ট। কমে ক্যান্সারের ঝুঁকি।

এতে আছে ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি-৫, বি-৬ এর মতো উপাদান। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মস্তিস্ক বিকাশে বিশেষ সহায়ক স্ট্রবেরি। সাহায্য করে হাড়ের গঠনে। তবে বাচ্চাদের স্ট্রবেরি খেতে দেওয়ার আগে দেখে নিতে হবে তা থেকে অ্যালার্জি হচ্ছে কি না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। সমস্যা না থাকলে দুধ বা পুডিংয়ের সঙ্গে আপনার বাচ্চাকে স্ট্রবেরি দিতে পারেন।

গবেষণা বলছে, যাঁরা স্ট্রবেরি, কমলালেবু, কাঁচালঙ্কা, আপেল ও নাসপাতির মতো ফ্লাভোনয়েড সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন অল্প হলেও খান, তাঁদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কম থাকে। অন্তত ২০ শতাংশ কমে যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াল্টার উইলেটের মতে, ফ্লাভোনয়েড সমৃদ্ধ রঙিন খাবার মস্তিস্কের স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদী উন্নতির জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি ও চেরিতে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন ২৪ শতাংশ পর্যন্ত স্মৃতিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি কমায়। ১০০ গ্রাম ব্লুবেরিতে অ্যান্থোসায়ানিন থাকে ১৬৪ মিলিগ্রাম।

শরীরের মেদ ঝরাতে আমরা কতকিছুই না করে থাকি। সেক্ষেত্র ব্রেকফাস্টে অনায়াসেই এই ফলটি যোগ করা যেতে পারে। মিল্কশেক আমাদের অনেকেরই পছন্দের। তাতেও যোগ করা যায় স্ট্রবেরি। সেক্ষেত্রে আরও বেশি সুস্বাদু হয়। বেড়ে যায় পুষ্টিগুণও। স্ট্রবেরির খোসা ছাড়িয়ে নরম অংশটি বের করে নিতে হবে। তার সঙ্গে অল্প চিনি ও লেবুর রস মিশিয়ে রেখে দিতে হবে কয়েক মিনিট। এর পর হাল্কা আঁচে সেটি ভালোভাবে নেড়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে জ্যাম। ফ্রিজে রেখে এই স্ট্রবেরি জ্যাম অনেক দিন ধরে খাওয়া যায়। বাড়িতে স্ট্রবেরি কেকও বানাতে পারেন। কেক বানানোর যে পদ্ধতি রয়েছে, এক্ষেত্রেও সেটাই অনুসরণ করতে হবে। তৈরির সময় চাইলে আপনি কেকে স্ট্রবেরি এসেন্স যোগ করতে পারেন। মনে করলে টাটকা স্ট্রবেরির সঙ্গে চিনি জ্বাল দিয়ে এসেন্স বানিয়ে নিতে পারেন।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, স্ট্রবেরিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসায়ানিন শরীরে অ্যাডিপোনেক্টিন নামক হরমোনের উৎপাদন বাড়ায়। যা খিদে কমিয়ে দেয়। একইসঙ্গে মেটাবলিজম রেট বৃদ্ধি করে। ফলে খাবারের বিপাক ক্রিয়া উন্নত হয়। স্ট্রবেরিতে থাকা বিভিন্ন উপাদান ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়। শরীরকে কার্সিনোজেন ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ-এর তথ্যে প্রকাশ, স্ট্রবেরিতে অ্যান্টি ক্যান্সার উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম অ্যালজিক অ্যাসিড। এটি একটি ফাইটো কেমিক্যাল। যা ত্বক, ফুসফুস, মূত্রাশয় ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
অ্যান্থোসায়ানিনের কারণেই স্ট্রবেরির রং লাল টুকটুকে হয়। এটি রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ধমনীর উপর ক্ষতিকারক আস্তরণ পড়তে দেয় না। নিয়ন্ত্রণে রাখে রক্তচাপ।

নিউ ইয়র্ক সিটির লেনক্স হিল হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, যে সব মহিলা সপ্তাহে তিনবার বা তার বেশি স্ট্রবেরি খান, তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যায় এক-তৃতীয়াংশ।
বেকিং সোডার সঙ্গে স্ট্রবেরি পালপ মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে ব্রাশ করলে দাঁত চকচকে হয়। স্ট্রবেরিতে থাকে ম্যালিক অ্যাসিড। যা অ্যাস্ট্রিনজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এতে দাঁতের হলুদভাব দূর হয়। দাঁতের উপর পড়া ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে।

দাঁতের ভাঙন রোধ করে। কিন্তু বেশি মাত্রায় ব্যবহার করা যাবে না। তা হলে ফলের অ্যাসিড দাঁতের এনামেলের ক্ষতি করতে পারে। স্ট্রবেরিতে ম্যাগনেশিয়ামের উপস্থিতি হাড়কে শক্তিশালী করে। স্ট্রবেরিতে যেহেতু বিশেষ আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড থাকে, যা ত্বককে মসৃণ করে। মেরিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, শরীরে কিছু প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে অ্যালঝাইমার্স বা পার্কিনসনের মতো রোগ হয়। সেক্ষেত্রে নিয়মিত যদি স্ট্রবেরি খাওয়ার অভ্যাস করা যায়, তা হলে ওইসব বিষাক্ত প্রোটিন জমা অনেকটাই কম হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসকদের গবেষণা বলছে, ভিটামিন সি ইমিউনোগ্লোবুলিনের ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে। এটি একটি অ্যান্টিবডি ও ইমিউন সিস্টেমের মূল উপাদান। স্ট্রবেরি অ্যালার্জি ও হাঁপানির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।

ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতেও টবে অনায়াসেই সুমিষ্ট এই ফলটি চাষ করা যেতে পারে। ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে ৪০ দিনেই গাছে ফল ধরবে। টিস্যু কালচার চারা বসাতে পারলে সবচেয়ে ভালো। উইন্টার ডন, সুইট চার্লি, কামা রোজা প্রভৃতি প্রজাতির স্ট্রবেরি চারা পাওয়া যায় নার্সারিতে। দেখে শুনে গাছ কিনতে হবে। টবে স্ট্রবেরি চাষ করলে মোটামুটি মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here