পল্লব মণ্ডল : দেবী সতী দক্ষ রাজার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন দক্ষ রাজা। যজ্ঞের আগুনে আত্মঘাতী হন সতী। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন মহাদেব। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভয়ে ভগবান বিষ্ণু প্রলয় থামাতে, সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন। দেবীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে। এই সব কটি জায়গাকে সতীপীঠ বলা হয়। সতীর ৫১ পীঠ হিন্দু ধর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাগুলি প্রত্যেক হিন্দুর কাছে পরম পবিত্রের জায়গা। বিভিন্ন জায়গা জুড়ে রয়েছে এই ৫১ পীঠ। ভারতবর্ষ-সহ বাংলাদেশ,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় এই ৫১টি পীঠ অবস্থিত। অবিভক্ত বাংলায় ১৯ টি সতী পীঠ, যার মধ্যে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ১৪টি শক্তি পীঠের এবং একটি সিদ্ধপীঠ তারাপীঠের অবস্থান এই জননী জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে ।

  • কালীঘাট, কলকাতা – দেবী কালী , কলকাতা শহরের বুকে এই সতীপীঠকে আদি সতীপীঠ হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা হয়, এখানে পড়েছিল দেবীর ডান পায়ের আঙুল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন দক্ষিণাকালী এবং ভৈরবের নাম নকুলেশ্বর।
  • কংকালীতলা, বীরভূম- দেবী কংকালেশ্বরী, বীরভূম জেলার কোপাই নদীর ধারে অবস্থিত এই পীঠ। বলা হয়, এখানে পড়েছিল দেবীর কাঁকাল বা কোমরের অংশ। অধিষ্ঠিত দেবীর নাম এখানে দেবগর্ভা এবং ভৈরব হলেন রুরু। কারও মতে দেবী এখানে রত্নাগর্ভি নামে অধিষ্ঠিতা।
  • নলহাটি, বীরভূম – দেবী নলাটেশ্বরী , বীরভূমের নলহাটিতে অবস্থিত নলহাটেশ্বরী মন্দির। কেউ কেউ একে উপপীঠ বলে থাকেন। বলা হয়, এখানে সতীর গলার নলি বা কণ্ঠনালী পড়েছিল। এখানে দেবী শেফালিকা এবং ভৈরব যোগীশ নামে পরিচত।
  • সাঁইথিয়া, বীরভূম – দেবী নান্দিকেশ্বরী ,
    এই সতীপীঠের মন্দিরটি বীরভূমের সাঁইথিয়ার কাছে। কথিত আছে, এখানে পড়েছিল সতীর গলার হাড়। অধিষ্ঠিত দেবী এখানে নন্দিনী এবং ভৈরব নন্দিকেশ্বর।
  • কিরীটেশ্বরী, মুর্শিদাবাদ – দেবী কিরীটেশ্বরী , এই সতীপীঠ মুর্শিদাবাদ জেলার কিরীটকণা গ্রামে অবস্থিত। পুরাণ বলে, এখানে দেবী সতীর মাথার মুকুটের একটি অংশ পড়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে পড়েছিল দেবীর করোটির অংশ। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী বিমলা এবং ভৈরব সংবর্ত।
  • পাণ্ডুয়া (প্রদ্যুম্ন), হুগলি – দেবী শৃঙ্খলা ,পাণ্ডুয়াকে সেখানে পুন্ডর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেবী হলেন সর্বাক্ষিণী ও ভৈরব হলেন সর্ব। এখানে দেবীর লোমাবলী পতিত হয়েছিল । মুসলিম আক্রমণে বর্তমানে ধ্বংস হয়ে গেছে।
  • তমলুক (তাম্রলিপ্ত), পূর্ব মেদিনীপুর- দেবী বর্গভীমা ,পীঠ নির্ণয় গ্রন্থ অনুযায়ী ৫১ পীঠের প্রথম হল বর্গভীমা। এটি পশ্চিম মেদিনীপুরের তমলুকে অবস্থিত। বলা হয়, দেবীর বাঁ পায়ের গোড়ালি পড়েছিল এখানে। এ কথার উল্লেখ রয়েছে অন্নদামঙ্গল কাব্যেও। এখানে দেবী বর্গভীমা এবং ভৈরব সর্বানন্দ রূপে পূজিত হন।
  • ক্ষীরগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান – দেবী যোগাদ্যা , এই পীঠও বর্ধমানে অবস্থিত, বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে। এখানে সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল বলে কথিত রয়েছে। দেবীর নাম এখানে যোগাদ্যা বা যুগাদ্যা এবং ভৈরব হলেন ক্ষীরকণ্ঠক।
  • ত্রিস্রোতা, জলপাইগুড়ি – দেবী ভ্রামারী ,এটি অবস্থিত জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা নদীর তীরে। পুরাণ অনুযায়ী এখানে সতীর বাঁ পা পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী ভ্রামরী এবং ভৈরব হলেন ঈশ্বর। কথিত আছে, অরুণাসুরকে পরাজিত করতে দেবী দুর্গা অসংখ্য ভ্রমরের রূপ ধারণ করেন, সেখান থেকেই ভ্রামরী নামের আগমন।
  • কেতুগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান- দেবী বাহুলা এবং বাহুলাক্ষী , এই সতীপীঠ অবস্থিত বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে অজয় নদের ধারে। পৌরাণিক কাহিনী বলে, এখানে দেবীর বাঁ হাত পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলা এবং ভৈরব পরিচিত ভীরুক নামে।
  • বক্রেশ্বর, বীরভূম – দেবী মহিষমর্দিনী , বীরভূমের পাপহরা নদীর তীরে অবস্থিত বক্রেশ্বর মন্দির। দেবীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী অংশ এখানে পড়েছিল বলে কথিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন সতীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মহিষাসুরমর্দিনী এবং ভৈরব বক্রেশ্বর বা বক্রনাথ।
  • ফুল্লরা , বীরভূম – দেবী ফুল্লরা , এটি অবস্থিত বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে। অনেকে এটিকে উপপীঠও বলেন। পুরাণ অনুযায়ী, এখানে দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিল। দেবী এখানে ফুল্লরা এবং ভৈরব বিশ্বেশ।
  • রত্নাবলী, খানাকুল, হুগলি জেলা- দেবী কুমারী , এটি হুগলি জেলার খানাকুলে অবস্থিত। কথিত আছে, এখানে দেবী সতীর ডান কাঁধ পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ‘কুমারী’ এবং ভৈরবকে বলা হয় ‘ঘণ্টেশ্বর’। তবে এই সতীপীঠে দেবীর থেকে প্রভাব বেশি ভৈরবের।
  • কোগ্রাম উজানী, পূর্ব বর্ধমান- দেবী মঙ্গলচণ্ডী , সতীপীঠ উজানি বা সতীপীঠ মঙ্গলচণ্ডী অবস্থিত বর্ধমান জেলার কোগ্রামে। বলা হয়, এখানে দেবীর ডান হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মঙ্গলচণ্ডী এবং ভৈরব কপিলেশ্বর বা কপিলাম্বর।
    সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ, বীরভূম – দেবী তারা , বীরভূমের রামপুরহাটের কাছে এই সতীপীঠে ভক্তদের সমাগম লেগেই থাকে। তবে অনেকেই একে সতীপীঠ হিসেবে মানেন না। তবে বলা হয় এখানে দেবীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল। এখানকার পীঠরক্ষক হলেন শিব যিনি চন্দ্রচূড় নামে পূজিত হন।
    আমাদের এই শক্তি পীঠ যাত্রায় ৬০ জন মাতৃ ভক্ত একটি ভ্রাম্যমাণ বাসকে রথের ন্যায় সজ্জিত করে বাড়িয়েছে মালদা থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটি শক্তি পীঠ পরিক্রমা করে সেখান থেকে পবিত্র জল, মাটি, প্রসাদ, পুস্প সংগ্রহ করে বাংলার কুম্ভ ত্রিবেণীতে পৌঁছে মা গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে সাধু-সন্ত দের করকমলের দ্বারা অর্পণের মাধ্যমে কুম্ভ মেলা কে ঈশ্বরীয় আধ্যাত্ম পুষ্পে শোভিত করতে। ৫ ফেব্রুয়ারী থাকে ১০ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই শক্তি পীঠ পরিক্রমা চলবে জলপাইগুড়ি ভ্রামারী দেবী থেকে শুরু হয়ে অবশেষে কলকাতার কালীঘাটের মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে মাতৃ রথ ত্রিবেণী কুম্ভ পৌঁছাবে ১০ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায়।তারপর ১১ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি চলবে ত্রিবেণী কুম্ভ মূলত ২০২ ২ থেকে ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচালনা সমিতির পৃষ্ঠপোষকতা এবং তত্ত্বাবধানে ত্রিবেণী কুম্ভের অংশ হিসেবেই এই শক্তি পীঠ পরিক্রমা চালু করা হয় । মাননীয় কাঞ্চন ভট্টাচার্য মহাশয় শ্রীকান্ত মুখার্জি মহাশয় এবং ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচালনা সমিতির প্রধান সাধন মুখার্জি মহাশয় শক্তি পীঠ পরিক্রমা সূত্রপাতের মূল কান্ডারী। এই পরিক্রমা ঐহিক আনন্দ ও ত্যাগের প্রতীক । হিন্দুত্বের এই পুনঃজাগরণ মাতৃ আরাধনা ও ভারত মাতাকে ফের পরম বৈভাবশালী করার জন্য। হিন্দুত্বের এই পুনঃজাগরণ ভারত মাতাকে ফের পরম বৈভাবশালী করার জন্য । বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ভবানন্দকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমরা অন্য মা মানি না, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ এই সনাতন হিন্দুধর্মই পেরেছে দেশকে শুধু একটি জড় পদার্থ নয়, বরং মা হিসাবে দেখতে। তাই দেশ মায়ের এই ভক্তদের হাত ধরেই বিশ্বের মাঝে ধ্বনিত হবে ভারত মাতার জয়গান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here