পার্থসারথি সেনগুপ্ত , দেশের সময়:

সন্দেশখালির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) মনোজ বর্মা। তাঁর কথায়, ‘‘সন্দেশখালিতে হিংসার ঘটনায় ইতিমধ্যেই আট জনকে আটক করেছে পুলিশ।’’ পুলিশের থেকে আশ্বাস পাওয়ার পরেই থানার সামনে থেকে বিক্ষোভ তুলে নেন মহিলারা।

গত ৩৫ দিন ধরে বেপাত্তা সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শাহজাহান। বুধবার রাত থেকে তাঁর দুই অনুগামী শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারের বিরুদ্ধে ফুঁসছে গোটা সন্দেশখালি। শুক্রবার শাহজাহান ঘনিষ্ঠদের গ্রেফতারির দাবিতে বাঁশ, লাঠিসোঁটা এবং ঝাঁটা নিয়ে সন্দেশখালি থানার সামনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন কয়েকশো মহিলা। আন্দোলনে সামিল হন পুরুষরাও। শুক্রবার সকাল থেকে সন্দেশখালির উত্তপ্ত পরিস্থিতির ছবি দফায় দফায় উঠে এসেছে শিরোনামে।

শুক্রবারই সন্দেশখালিকাণ্ডে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।

জানা গিয়েছে, চিঠিতে শাহজাহান, শিবপ্রসাদ হাজরা, উত্তম সর্দারের নাম উল্লেখ করেছেন সুকান্ত। সন্দেশখালির উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি করেছেন তিনি। 

এদিন সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে নবান্ন থেকে এডিজি বলেন, “গত দু-তিন ধরে বসিরহাট পুলিশ জেলার সন্দেশখালিতে কিছু ঘটনা ঘটেছে। যারা হিংসার ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজকের ঘটনায় আটজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।” একইসঙ্গে ঘটনাটিতে কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জানালে তা নিয়ে পুলিশ সঠিক তদন্ত করবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘’এখনকার পরিস্থিতি পুরোটাই কন্ট্রোলে’’।

রেশন বণ্টনে ‘দুর্নীতি’র অভিযোগে গত ৫ জানুয়ারি শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালাতে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। কিন্তু সেখানে তাঁদের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে। গুরুতর আহত হন তিন ইডি অফিসার। এরপর থেকেই নিখোঁজ তৃণমূল নেতা। এরই মধ্যে শুক্রবার সকাল থেকে নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায় সন্দেশখালিতে। শাহজাহান ঘনিষ্ঠ তথা সন্দেশখালি-২ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি শিবুর তিনটি পোল্ট্রি ফার্ম এবং বাগান বাড়িতে আগুন লাগান বিক্ষোভকারীরা। পাল্টা ঘাসফুল শিবিরের লোকজন এলাকা দখলে নামে বলে অভিযোগ।  পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

পুলিশ, প্রশাসনের তরফে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করা হলেও শাহজাহন, শিবু হাজরাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে এখনও ফুঁসছে সন্দেশখালি।

শুক্রবার সকালে জেলিয়াখালিতে শিবু হাজরার তিনটি পোলট্রি ফার্ম ও বসত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। লাঠি হাতে রাস্তায় নামেন এলাকার মহিলাদের অনেকেই। বহু আদিবাসী মহিলাও বিক্ষোভে সামিল হন। এক কথায় , কার্যত রণক্ষেত্রের গোটা এলাকা জুড়ে। মোতায়েন হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী।

গ্রামবাসীদের অভিযোগ, গত বেশ কয়েক বছর ধরে চাষের জমি ও খাল দখল করে অজস্র ভেড়ি তৈরি করেছেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সদস্য শিবপ্রসাদ হাজরা এবং সন্দেশখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি উত্তম সর্দার। গ্রামবাসীরা আরও অভিযোগ জানান ,তাঁদের নিজেদের জমিতে চাষের পরও প্রাপ্য বুঝে পাননি। এসব সত্বেও এযাবত শাহজাহানের ভয়ে তারা মুখ খুলতে পারেননি বলেও দাবি গ্রামবাসীদের। বৃহস্পতিবার এলাকায় প্রতিবাদ মিছিলের পাশাপাশি শিবপ্রসাদ হাজরার ভেড়ির অফিসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েন পুলিশ আধিকারিকরা। ওই ঘটনায় রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ৩ জনকে।

আবার শুক্রবার দুপুরে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। এখনও কেন গ্রেপ্তার করা হল না শিবু হাজরাকে এই অভিযোগে এদিন জেলিয়াখালি এলাকায় শিবু হাজরার আরও তিনটি পোলট্রি ফার্মে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। ভাঙচুর তো হয়ই, এরপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় শিবু হাজরার বসতবাড়িতেও।

গ্রামবাসীদের দাবি, অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে শিবুদের। গতকালই অশান্তির ঘটনার জেরে সন্দেশখালির সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দার-সহ ১১১ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের সদস্য শিবু হাজরা। তৃণমূলের বিধায়ক সুকুমার মাহাতোর পাল্টা অভিযোগ, সিপিএম-বিজেপি পরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের উসকানি দিয়ে অশান্তি বাধিয়ে লোকসভা ভোটের আগে ফায়দা তুলতে চাইছে। উত্তম সর্দার যদি অপরাধী হয়, তাহলে দল ব্যবস্থা নেবে বলেও তিনি দাবি করেছেন।

গ্রামবাসীরা বলছেন, এলাকায় চাষের সুযোগ নেই। কিন্তু টাকা আছে। সুন্দবনের নদী খাঁড়ির মাছ বিক্রির টাকা, মিন চাষের টাকা, বন্যপশুদের দেহাংশ পাচারের টাকা। বাংলাদেশ সীমান্ত যে একেবারেই লাগোয়া। এলাকার দখল হাতে থাকলে টাকা আসবেই। এটাই বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসা শেখ শাহজাহান ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন নিজস্ব একটা বৃত্ত। এই বৃত্তেই প্রথম সারিতে ছিলেন উত্তম সর্দার, শিবপ্রসাদ হাজরারা। গত প্রায় একদশক ধরে যারা সন্দেশখালির নদী বিচ্ছিন্ন এলাকার মানুষগুলিকে একরকম দাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন। 

ভেরিতে মাছ চাষে বিপুল লাভ। অতএব নিরীহ গ্রামবাসীদের রান্নাঘরের পাশে থাকা একফালি জমি রাতের অন্ধকারে রাতারাতি হয়ে গেছে ভেরি। পোল্ট্রিতে লক্ষ্মীলাভ। বাড়ির লাগোয়া যে জমিতে সবজি ফলিয়ে খেত কোনও দুঃস্থ পরিবার, সেখানেই তৈরি হয়ে গেছে পোল্ট্রি ফার্ম। না, জমির মালিকের কোনও অনুমতি লাগেনি। বরং জমির মালিককেও সেখানে শ্রম দিতে হয়েছে মাসিক সামান্য টাকার বন্দোবস্তে। গ্রামবাসীরা বলেন, “প্রতিবাদ করার সাহসই কোনওদিন পাইনি। তাহলে তো প্রাণই থাকবে না। ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে নদীতে নিয়ে ফেলবে।” 

জেলিয়াখালির এক স্থানীয়বাসিন্দার কথায , “শিবু হাজরা এই এলাকার আদি বাসিন্দা। কংগ্রেস করতেন। বিপুল জমির মালিকানা ছিল তাঁদের পরিবারের। বাম আমলে অপারেশন বর্গার পরে সেই জমি বিলি-বণ্টন হয়ে যায়। বিধায়ক অনন্ত রায় সেইসময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজ্যে পালাবদলের পরে শেখ শাহজাহানের হাতে এলাকার ক্ষমতা যাওয়ার পরে ফের জমি পুনরুদ্ধারে নামেন শিবু হাজরারা। এখন প্রায় সাড়ে সাতশো বিঘা জমির মালিক শিবু হাজরা। ভেরি, বাগানবাড়ি, হ্যাচারি কী নেই তাঁর। শেখ শাহজাহানের হাত ধরেই এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হন তিনি।”

শিবু হাজরার মতোই উত্তম সর্দারও শেখ শাহজাহানের হাত ধরে উঠে আসা এক নেতা। এই দুজনের দাপটেই তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত বলে জানালেন জেলিয়াখালি-তুষখালির মানুষ। বছরের পর বছর মানুষের মতো বাঁচার অধিকারটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। তুষের গাদায় আগুন তাই ছিলই। শেখ শাহজাহানের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে লাগাম ঢিলে হতেই বহিঃপ্রকাশ হল ক্ষোভের। অশান্তির আগুনে জ্বলে উঠল সন্দেশখালি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here