দেশের সময়,কলকাতা: ৫০ দিনের রাজ্যজোড়া ইনসাফ যাত্রার পর ব্রিগেড। ২০০৮ সালের পর ২০২৪। ১৬ বছর পর ফের ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকে রবিবার ব্রিগেড সমাবেশ হল কলকাতায়। ফের বাম যুব ফ্রন্টের হাত ধরেই উড়ল লাল পতাকা। লোকসভা ভোটের আগে বঙ্গ বামের এই কর্মসূচি নিয়েই জোর চর্চা রাজনীতির অন্দরে।

এদিন ঠিক দুপুর হতে না হতেই মীনাক্ষী দলের কর্মীর বাইকে চড়ে দীনেশ মজুমদার ভবন থেকে সোজা চলে আসেন ব্রিগেডে ৷ সভাস্থলে ঢুকতে না ঢুকতেই বাম ব্রিগেড যেন নতুন অক্সিজেনে আরও লাল হয়ে উঠল। মঞ্চে উঠতেই মঞ্চের চারদিক থেকে ‘লাল সেলাম’ দিয়ে কুর্নিশও জানালেন দলের কর্মীরা ৷

মঞ্চে ওঠামাত্রই সোজাসাপটা দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে চাঁচাছোলা আক্রমণ শানালেন, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মমতার বিরুদ্ধে ছুড়লেন কটাক্ষবাণ। শেষে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উদ্ধৃতি করতেই গিয়ে যেন কাটল তারটা। ‘আমি মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত/ যেদিন অত্যাচারিতের খড়গ কৃপাণ’… এই অবধি বলেই অকপটে বলে ফেললেন ‘ভুলে গিয়েছি’। তারপর ফের ধরলেন। বললেন, ‘এই রণভূমে রণিবে না, আমি সেই দিন হব শান্ত, বিদ্রোহী রণক্লান্ত!’ 

ততক্ষণে ব্রিগেডে শুরু হয়েছে ফিসফাস। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচায়ি চলছে। তখনই মীনাক্ষীর পরেই স্টেজে উঠলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। ওঠামাত্রই দক্ষিণপন্থা আর বামপন্থার তফাৎ বোঝাতে গিয়ে চড়া আক্রমণ শানালেন মোদী-মমতাতে। ব্যাট ধরলেন মীনাক্ষীর হয়ে। ভুল ধরেই দিলেন শিক্ষা। স্পষ্ট বললেন, ভুল স্বীকার করতে যদি কেউ পারে সেটা বামপন্থীরা। 

ব্রিগেডের মঞ্চ থেকেই চাঁচাছোলা ভাষায় সেলিম বলেন, “অনেকে বলে বামপন্থার সঙ্গে দক্ষিণপন্থার তফাৎ কী? খুব সহজ। কমরেড মীনাক্ষী আপনার সামনে বর্ক্তৃতা করছিল। বলতে বলতে উত্তেজনায় কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে বলল ভুলে গিয়েছি। আচ্ছা এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলে বলতে পারত ভুলে গিয়েছি! মোদী কখনও বলতে পারে জনসমক্ষে ভুলে গিয়েছি, ভুল বলেছি! কোনও স্বৈরতন্ত্রী, কোনও ফ্যাসিস্ট কখনও ভুল স্বীকার করে না। বামপন্থীরা পারে। কারণ, তাঁরা সত্যের পথে থাকে। ওসব ভুজংভাজুং দিয়ে চলে না।”

জেলা থেকে কলকাতা, ব্রিগেডে মিশল সব পথ। শিক্ষা দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতির মধ্যেই ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআইয়ের সমাবেশে জনজোয়ার। লোকসভা ভোটের আগে একযোগে তৃণমূল-বিজেপিকে আক্রমণ।  হাইভোল্টেজ লোকসভা ভোটের আগে, রাজ্যজোড়া কর্মসূচিতে বিপুল সাড়া দেখে উচ্ছ্বসিত সিপিএম নেতৃত্ব।
শিক্ষা দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতির মধ্যেই ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআইয়ের সমাবেশে ছিল জনজোয়ার ৷

এদিন ব্রিগেডে সিপিএমের যুব সংগঠনের সভা থেকে বিজেপি ও তৃণমূল দুই দলকেই সমানভাবে বিঁধতে চাইলেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা। এদিন প্রত্যাশা ছাপিয়ে ভিড় হয়েছে বিগ্রেডে। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডিওয়াইএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক আভাস রায়চৌধুরী বলেন, “বাংলায় ঘুরে ঘুরে এখন তৃণমূলকে চোর বলছেন শুভেন্দু অধিকারী। আরে তৃণমূল যে চোর সে আর নতুন কথা কী! কিন্তু শুভেন্দু যদি ঢেঁকুর তোলেন, তাতে কীসের গন্ধ বেরোবে? দুর্নীতির গন্ধ বেরোবে কিনা! তাঁকেও তো দেখা গিয়েছিল টাকা নিতে।”
আভাস বোঝাতে চান, তৃণমূল আর বিজেপির কোনও ফারাক নেই। ঠিক যেমন ফারাক নেই পুরনো তৃণমূল আর নব্য বিজেপিতে। তাঁর কথায়, নাগপুরের প্রেসক্রিপশনে তৃণমূল। দিল্লির সঙ্গে সেটিং রয়েছে নবান্নের।

নাম না করে আবার শুভেন্দুকে ফুটো মস্তান বলেন যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে বলেন, যত ভাগাড়ের লোকগুলো বিজেপিতে গিয়ে জুটেছে। 

একুশের বিধানসভা ভোটে বাংলায় ৭৭টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। বামেরা একটি আসনও জিততে পারেনি। অনেকের মতে, ভোটে এতটাই মেরুকরণ হয় যে বামেদের ভোটও চলে যায় জোড়াফুলে বা বিজেপিতে। ফলে এই প্রথমবার বিধানসভায় বামেদের কোনও বিধায়ক নেই। তাঁদের সংখ্যা শূন্য। রাজ্যে বামেদের কোনও সাংসদও এখন নেই। 

এহেন পরিস্থিতিতে এদিনের বিগ্রেড থেকে মীনাক্ষী এদিন শুভেন্দুকে চ্যালে়ঞ্জ করে বলেন, “বিজেপির যে বিধায়করা খাতায়কলমে গেরুয়া দলে থাকলেও বাইরে তৃণমূল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দম থাকলে তাঁদের বিধানসভার সদস্যপদ খারিজের জন্য পদক্ষেপ করুন। স্পিকারের কাছে আবেদন করুন। চ্যালেঞ্জ করছি বিরোধী দলনেতাকে।”

বিজেপি- তৃণমূলের বোঝাপড়া রয়েছে বলে এদিনের সভায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও দাবি করেন। সেই সঙ্গে বলেন, কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই তৃণমূল শাঁসে-জলে বেড়েছে। তাঁদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। সাঁইয়া যখন কোতয়াল তখন আর ভয় কী!”

মীনাক্ষী (Minakshi Mukherjee) প্রসঙ্গ উঠতেই একযোগে সে কথা বলছেন বঙ্গ বাম নেতারা। ক্যাপ্টেনের ব্রিগেড হবে ঐতিহাসিক ব্রিগেড, লেখা থাকবে বঙ্গ রাজনীতির ইতিহাসের পাতায়। এমনটাই বলছেন বাম শিবিরের নেতা-কর্মীরা। মীনাক্ষীর গলায় গ্রাম্য মেঠো টান, অনাড়ম্বর জীবযাপন, তৃণমূল স্তরে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, তাঁর এই ভাবমূর্তি দেখেই অনেকে তাঁর সঙ্গে পায়ে সাদা হাওয়াই চটি, নীল পাড় সাদা শাড়ির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা টানেন। অনেকই বলেন মমতার (CM Mamata Banerjee) উত্থানের সঙ্গেও অনেকটাই মিল রয়েছে কুলটির ঘরের মেয়ে মীনাক্ষীর উত্থানের।

এদিকে সিঙ্গুর আন্দোলনের হাত ধরেই বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় জাঁকিয়ে বসেছিলেন মমতা। সঙ্গে দোসর ছিল নন্দীগ্রাম। বাম শাসনের কফিনে শেষ পেরকটাও পুঁতেছিলেন এই জায়গাগুলি থেকেই। সরকারে বসার আগে ও পরে, দুই সময়েই নানা ইস্যুতে আন্দোলনের সময় দলীয় কর্মীদের বাইকে চড়ে গোটা রাজ্যে ছুটে বেড়াতে দেখা গিয়েছে মমতাকে। এবার যেন একই রূপে দেখা গেল মীনাক্ষীকে।  

এদিন ব্রিগেডের মঞ্চে মূল বক্তা ছিলেন তিনিই। দুুপুরে ব্রিগেডের উদ্দেশ্যে গেলেন একদম সাদামাট পোশাকে। দিনেশ মজুমদার ভবন থেকে ব্রিগেডের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় চড়লেন বাইক। বসলেন দলীয় এক কর্মীর বাইকের পিছনে। যা দেখে অনেকেই আবার ফেলে আসার মমতার কথা মনে করেছেন। 

এই মমতার বিরুদ্ধে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে বাম প্রার্থী হয়েছিলেন মীনাক্ষী। শুধু মমতা নন, লড়তে হয়েছিল শুভেন্দুর বিরুদ্ধেও। তবে ৬ হাজারের মাত্র বেশি কিছু ভোট পেয়ে ক্ষান্ত হতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু, তবুও তার উপর আশা হারায়নি দল। উল্টে আনিস খান ইস্যুতে লাগাতার ফুঁসে উঠতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। জেলেও গিয়েছেন। এমনকী সাম্প্রতিক সময়ে চলা নিয়োগের দাবিতে চাকরিপ্রার্থীদের পাশেও দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

রবিবার ব্রিগেডে ছবিগুলি তুলেছেন সজল মুখার্জী ৷

রবিবাসরীয় ব্রিগেডের মূল মন্ত্র ছিল বামেদের ভোট ফেরানো। বামেদের একটা বড় ভোট যে ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে বিজেপিতে বা তৃণমূলে চলে গিয়েছে, তাদের ঘর ওয়াপসি করানো। সেই কারণেই বিজেপি- তৃণমূলের আঁতাতের গল্প এদিন সিপিএমের সব নেতাই কমবেশি বোঝাতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে আভাস রায়চৌধুরীরা বুঝিয়েছেন, এক বিগ্রেডে থেমে থাকলে হবে না, পাড়ায় পাড়ায় বুথে বুথে যেতে হবে। নইলে এদিন ব্রিগেড শুধু একটু সমাবেশের ছবি হয়ে থেকে যাবে। তার অতিরিক্ত কিছু নয়। এখন দেখার লোকসভা ভোটের মুখে মীনাক্ষীর এই ব্রিগেডের হাত ধরে কতটা অক্সিজেন পায় ‘শূন্য’ বাম শিবির। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here