দেশের সময়: ক্যামেরার ফ্রেমে ২০২২-এর ঠাকুর নগর মতুয়া মহামেলায় ফিরে এলো সেই পুরনো ছবি৷ ভক্তদের ঢল নেমেছে গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে তাঁরা দলবদ্ধ ভাবে হাতে ডাঙ্কা-কাঁসি-নিশান নিয়ে হরিচাঁদ- গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির প্রদক্ষিণ করছেন।

করোনা পরিস্থিতিতে দু’বছর বন্ধ থাকার পরে এ বার ফের হচ্ছে মতুয়া ধর্ম মহামেলা এবং পুণ্যস্নান।

মেলায় দেখা গেল, মতুয়া ভক্তরা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের দুই সঙ্ঘাধিপতি মমতা ঠাকুর এবং শান্তনু ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে প্রণাম করছেন। আগে যে কোনও এক জনকে ভক্তেরা প্রণাম করতেন। তাঁরা খাওয়া-দাওয়াও করতেন যে কোনও একদিকে। আড়াআড়ি বিভাজনের ছবিটা স্পষ্ট ছিল।

পুলিশ-প্রশাসনের হিসেব অনুয়ায়ী, মঙ্গলবার মতুয়া ধর্ম মহামেলা উপলক্ষে পুণ্যস্নান সারতে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে এসেছিলেন, প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ। যদিও অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের দাবি, বুধবার দুপুর পর্যন্ত ঠাকুরবাড়িতে এসেছেন প্রায় ২৫ লক্ষ পুণ্যার্থী।

বৃহস্পতিবার সকালেও দেখা গেল, ঠাকুরবাড়িতে যাওয়ার ঢল অব্যাহত মতুয়া ভক্তদের। মতুয়া মহাসঙ্ঘের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বার মেলায় প্রায় ৪৫-৫০ লক্ষ মানুষ আসবেন। মেলা চলবে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ সূত্রে জানানো হয়েছে, ঠাকুরবাড়িতে ‘কামনা সাগরে’ পুণ্যস্নানে তিথি শেষ হয়েছে বুধবার দুপুর দেড়টার সময়ে। তারপরেও ভক্তেরা আসছেন, ‘কামনা সাগরে’ স্নান সারতে। বৃহস্পতিবার সকালে এসে পৌঁছনো কয়েকজন মতুয়া ভক্ত জানালেন, পুণ্যতিথিতে স্নান করতে পারলে ভাল লাগাত। তবে আসতে দেরি হয়ে গেল। এ দিন ‘কামনা সাগরে’ স্নান করতে ভক্তদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে ভিড়ের কারণে।

দীর্ঘদিন পরে ঠাকুরবাড়ির দু’টি পরিবার মহামেলার আয়োজন করেছে। যে কারণে মেলা শুরুর আগেই অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সম্পাদক প্রসেনজিৎ বিশ্বাস বলেন, এ বার মেলায় রেকর্ড ভিড় হয়েছে। বুধবার দুপুর ১২টা নাগাদ ২৫লক্ষ পুণ্যার্থীর উপস্থিতি ছিল ৷

অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সহ সম্পাদক শঙ্কর বিশ্বাস অভিযোগ করে বলেন, এবছর ভক্তদের সংখ্যাযে ২৫লক্ষ ছাড়াবে তা আগেই জানানো হয়েছিল পুলিশ- প্রশাসনকে৷ খুবই দুঃখজনক বিষয় যে বনগাঁ মহকুমা শাসকের কাছে ভক্তদের জন্য পানীয় জলের পাউচ প্যাকেট চাওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি সে ব্যবস্থা করেননি বা তাঁকে বহুবার ফোন করলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি৷ অসংখ্য ভক্ত পানীয় জলের অভাব বোধ করেছেন ৷ আমরা মর্মাহত৷

মতুয়া ভক্তেরা জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে দু’বছর আসতে পারেননি। সে কারণে এ বার মেলায় আসার তাগিদ ছিল বেশি। তা ছাড়া, দুই পরিবারের ঐক্যের বার্তায় খুশি হয়েছেন ভক্তেরা। সাম্প্রতিক অতীতে অনেকেই দু’টি পরিবারের আকচাআকচি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। অনেকে মেলায় আসা বন্ধও করে দিয়েছিলেন।

দুলাল গোঁসাই নামে এক ভক্তের কথায়, ‘‘আমরা এ বার ২৫০ জনের দল নিয়ে মেলায় এসেছি। গত কয়েক বছর মেলায় আসতে মন চাইত না। ঠাকুর পরিবারের সদস্যেরা কেন নিজেদের মধ্যে মেলার আয়োজন নিয়ে বিবাদ করবেন? এ বার ঐক্যের বার্তা পেয়েছি বলেই এসেছি।’’

প্রসঙ্গত, এবারের মেলায় এবং পুণ্যস্নান উপলক্ষে মোদী মতুয়াদের উদ্দেশে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ভাষণ দেন। তার আগে সোমবার তিনি টুইট করেছেন, “মহান শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরজি সামাজিক ন্যায় ও জনকল্যাণে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আমরা তাঁর জন্মজয়ন্তীও উদ্‌যাপন করব।”

মঙ্গলবার মতুয়াদের বারুণী মেলায় ভার্চুয়াল বক্তব্যের শুরুতেই বাংলায় ভাষণ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।স্পষ্ট বাংলায় বললেন, “জয় হরি বোল। হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১১ তম আবির্ভাব তিথি উপলক্ষ্যে সকল পূণ্যার্থীদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা অভিনন্দন ও নমস্কার।”সেই সঙ্গে অতীতে তাঁর ওরাকান্দি সফরের কথাও উল্লেখ করেন। বললেন, “ঠাকুরবাড়ি আমাকে সবসময় আপন করে নিয়েছে। ওরাকান্দি সফরের সময়েই আন্তরিকতা পেয়েছি। আজ ঠাকুরবাড়ির মতো মহাতীর্থে প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পেরে ভাল লাগছে।”

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়ির বড়মা বীণাপাণি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আর ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর্বে বাংলাদেশের ওরাকান্দির ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। ওরাকান্দি থেকেই হরিচাঁদের সামাজিক এবং ধর্মীয় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। বড়মার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ওরাকান্দি দর্শনের কথাও৷ মতুয়া ধর্ম মহামেলায় ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

মহামেলা উপলক্ষে ঠাকুরনগর-সহ গাইঘাটা সেজে উঠেছে। চারিদিকে বড় বড় তোরণ লাগানো হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের ছবি। কোথাও বনগাঁর প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুরের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও আছে। কোথাও আবার মতুয়াদের বড়মা বীণাপানি ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর স্বামী তথা ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের ছবি।

গোটা এলাকা জুড়ে অসংখ্য জলসত্র খোলা হয়েছে। ঠাকুরনগরে বাসিন্দারা বাড়ির উঠোন ভক্তদের থাকার জন্য খুলে দিয়েছেন। প্রচুর দোকানপাট বসেছে। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল, মঙ্গলবার ঠাকুরবাড়িতে কামনা সাগরে পুণ্যস্নানের মাধ্যমে মেলা শুরু হবে।

অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাত ৯টার সময় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। তা মানুষকে সরাসরি শোনানোর জন্য ঠাকুরবাড়িতে ১৫টি জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয়। এ ছাড়া, বনগাঁ, বাগদা, চাঁদপাড়া, হরিণঘাটা, কল্যাণী, চাকদহ-সহ বিভিন্ন এলাকায় জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের লিঙ্ক দেশ-বিদেশে থাকা আমাদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’’

ছবিগুলি তুলেছেন দেবানন্দ পাইন৷

এ বার রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মতুয়া ভক্তদের আসার জন্য বিশেষ ট্রেন, এক্সপ্রেস ট্রেনের ব্যবস্থা করেছেন রেল কর্তৃপক্ষ। বাড়ানো হয়েছে লোকাল ট্রেনের সংখ্যাও। দীর্ঘদিন পরে এ বার মমতা ঠাকুর এবং শান্তনু ঠাকুর এক সঙ্গে মেলার আয়োজন করছেন বলে ভক্তদের মধ্যে উৎসাহ বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘ভক্তদের যাতে ঠাকুরবাড়িতে এসে কোনও অসুবিধার মধ্যে পড়তে না হয়, সে জন্য থাকা-খাওয়া সহ সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ভিড় সামলাতে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। 

বনগাঁ তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা পুরপ্রধান গোপাল শেঠ তাঁর ফেসবুক পেজে মতুয়া ভক্তদেরর উদ্দ্যেশ্যে বার্তা দিয়েছেন বড়মার ছবি সহ ৷ সেখানে তিনি লিখেছেন৷ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে পূর্ণব্রহ্ম ভগবান শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১১তম আবির্ভাব উপলক্ষে , বড়মা স্বর্গীয় শ্রী বিনাপানী দেবীর আশীর্বাদ কে পাথেয় করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মতুয়া ধৰ্ম মহামেলা । সকল মতুয়া ভাই বোনদের জানাই প্রণাম এবং সাদর আমন্ত্রণ।
জয় হরিচাঁদ , জয় গুরুচাঁদ ৷

গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোবিন্দ দাস জানিয়েছেন, সমিতির পক্ষ থেকে মতুয়া ভক্তদের থাকার জন্য ত্রিপল ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহামেলা উপলক্ষে স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, ঠাকুরনগরে থাকা চাঁদপাড়া ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে।

মহামেলার দিনগুলিতে (২৯ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল) পর্যন্ত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুত যাতায়াতের জন্য বিশেষ রুট থাকছে। পুলিশি সহযোগিতায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা ওই রুটে যাতায়াত করবেন।

গাইঘাটার বিএমওএইচ সুজন গায়েন জানান, ‘‘ঠাকুরবাড়িতে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র করা হয়েছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকবেন। এ ছাড়া, ৪৫টি সংগঠনকে ওষুধপত্র দেওয়া হয়েছে।’’ লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমে যাতে করোনা ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্যও পদক্ষেপ করা হয়েছে। সুজন বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার বিলি করা হবে। র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা থাকছে। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলেই করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।’’

বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার বলেন, ‘‘১০০ জন অফিসার এবং ৩০০ জন পুলিশকর্মী মহামেলার নিরাপত্তায় রয়েছেন। এ ছাড়া, থাকছেন সিভিক ভলান্টিয়াররা।’’

মেলা ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যও ভাল হচ্ছে বলে জানান অনেকে। এক দোকানির কথায়, ‘‘এ বার ছোট-বড় মিলিয়ে সাতশোটি ডাঙ্কা এনেছিলাম। সবই প্রায় বিক্রির মুখে। বছরের এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। সারা বছরের মূল আয় এখান থেকেই করি। দু’বছর মেলা না হওয়ায় আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম।’’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here