সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা

আশ্বিনের এক ভোর রাতে চারদিক গমগম করে উঠলো এক উদাত্ত কন্ঠস্বরে-‘ আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর’। আমাদের বাড়ির রেডিয়োটিতেও সেই কন্ঠস্বর যেন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল। আমার বাবা সেদিন অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে অপেক্ষা করছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষনের। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অমোঘ কন্ঠে চন্ডীপাঠ শুরু হতেই কেমন মন্ত্র মুগ্ধের মত স্থির হয়ে বসে পড়েন! বাবা আমাদের সকলকেই ঘুম ভাঙিয়ে সঙ্গে নিয়ে বসতেন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী – স্তোত্রপাঠ, মন্ত্রোচ্চারন আর অসাধারণ সব গানের মেলবন্ধন তখন সবাইকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেত। সেটা ছিল এক অত্যাশ্চর্য সকাল, মহালয়া। 

প্রতি বছরই এই উৎসাহে কোন ভাটা পড়ত না। যখন টেলিভিশনে মহালয়ার সম্প্রচার শুরু হল তখনও বাবার কাছে রেডিয়োরই প্রাধান্য ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেডিয়োর ব্যবহার একেবারেই কমে যায়। তখন মহালয়ার আগে বাবা রেডিয়োটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। বিকল হলে বগলদাবা করে সারাইয়ের জন্য ছুটতেন। শুধুমাত্র আমার বাবাই নন, সেই প্রজন্মের বা তারও আগের অনেকেই মহালয়ার ব্যাপারে একই রকম আবেগপ্রবণ ছিলেন। কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে মানুষের এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে, সবাই এখন খুব ব্যস্ত। ইন্টারনেটের দৌলতে সব কিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। চাইলেই যখন- তখন মহালয়া শোনা যায়। ‘মহালয়া’ শব্দটি তাই নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে পুজো শুরুর আগে একটি বিশেষ দিন। 

শুধু প্রবীণ- প্রবীনারা মহালয়ার আগে আজও রেডিয়োর তদারকি করে সেই পুরনো আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। তবে একটা সময় ছিল যখন মহালয়ার আগে রেডিয়ো কেনার বা সারাইয়ের হিড়িক পড়ে যেত, এখন সেই সংখ্যা খুবই নগণ্য। কারণ বর্তমানে অনেকেই মুঠোফোনেই মহালয়া শোনেন।

একদিকে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চন্ডীপাঠ আর অন্যদিকে ধীরে ধীরে ভোরের আভায় চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠা এ যেন এক অদ্ভুত স্বর্গীয় অনুভূতি। চন্ডীপাঠের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় আশ্বিনের শরতের মেঘের ভেলায়। আগমনীর সুর স্পর্শ করে বাঙালির হৃদয়কে।

কাশফুলের দোলা লাগে তাদের মনে। বাতাসে শিউলির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির প্রিয় উৎসব শুরুর প্রাক মুহূর্তে শারদপ্রাতে মায়ের আরাধনার ধ্বনি আকাশ- বাতাস মুখরিত করে তোলে। আসলে মহালয়া আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র যেন একই সূত্রে গাঁথা। 

তাই আমরা যতই আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলি, মহালয়ার ভোর রাতের বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই মন্ত্রোচ্চারন আমাদের মধ্যে এক অন্য শিহরন জাগায়। মনে পড়ে যায় কত স্মৃতি। তাই বাঙালি বাড়িতে আজও রেডিয়োর ব্যবহার বছরের অন্য সময় না হলেও মহালয়ার দিন প্রাধান্য পায়।

মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষের অবসান ও মাতৃপক্ষের শুরু।অমাবস্যায় পিতৃপুজো সেরে পরের পক্ষ দেবীপুজোয় প্রবৃত্ত হতে হয়। তাই দেবী পুজোর পক্ষকে বলা হয় দেবী পক্ষ বা মাতৃপক্ষ। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকেই পিতৃপক্ষ বলে। মহালয়ার দিন অমাবস্যায় পিতৃতর্পন করা হয়। হিন্দুধর্মে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বলা হয় যে, আমরা পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণী, তাই তর্পণ করে ঋণ শোধ করার চেষ্টা করি। কথিত আছে যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের থেকে অন্নজল পেয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সাধারণত তিন পুরুষের জন্য তর্পণ করা হয়ে থাকে। এর তাৎপর্য হল, বছরের এই বিশেষ একটি পক্ষে আমরা যেন তাঁদের স্মরণ করি, যাদের জন্য আমরা পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পেয়েছি।

মহালয়ার দিনটি তাই সব দিক থেকেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আগে এক সময় মহালয়ার সরাসরি সম্প্রচার হত। কিন্তু পরবর্তীকালে রেকর্ডই বাজানো হয় , তবু এত বছর পরে মহালয়ার স্মৃতি আজও অমলিন। আর তাই তো রেডিয়োতে মহালয়া শোনার মধ্যে এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here