দেশের সময় কলকাতা: অনেক ঘটা করে দেশের মনিষীদের ছবি টাঙিয়ে কোলকাতা ট্রাম কোম্পানীর ধর্মতলা অফিসের মূখোমূখী তৈরী হয়েছিলো সিটিসি বাসস্টান্ড,এখন সবটাই ফুটপাথবাসীদের দখলে৷

ছবিতুলেছেন দেবাশিস রায় ৷

যদিও শহরকে সুন্দর করে তুলতে হবে। এমনই পরিকল্পনা নিয়েছে কলকাতা পুরসভা। আর শহরের সৌন্দর্যায়ন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রথমেই ফুটপাতগুলি ভবঘুরে-মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই ৷ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই সাংবাদিক বৈঠক করে এমনটাই জানিয়েছিলেন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। একইসঙ্গে সমস্ত ভবঘুরেকে পুরসভার শেল্টার হোমে থাকতে হবে এবং বহিরাগতরা আর ভবঘুরে হয়ে থাকতে পারবে না বলেও সেই সঙ্গে কড়া বার্তাও দেন পুরমন্ত্রী।

ফুটপাত থেকে ভবঘুরেদের সরানো প্রসঙ্গে একই সময়ে কলকাতার মেয়র সংবাদমাধ্যমকে জানান, “কলকাতার ফুটপাত সম্পূর্ণ খালি করতে হবে। বাড়ি থেকে এসে ভবঘুরেরা বসে পড়ছে, তা হবে না। শহরকে সুন্দর করে তুলতে হবে। সাউদার্ন অ্যাভিনিউ, কালীঘাট সহ দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতগুলি নোংরা হয়ে যাচ্ছে।”

এপ্রসঙ্গেই জঞ্জাল ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্তা আধিকারিকদের ভবঘুরে গণনার কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, “বোরো ভিত্তিক গণনার কাজ শুরু করতে হবে। কোথায় কত ফুটপাতে ভবঘুরে বা সংসার বানিয়ে বহিরাগতরা বসে রয়েছে, তা আগে জানতে হবে। এলাকাভিত্তিক কত এরকম ফুটপাত দখল হয়ে রয়েছে, তার রিপোর্ট এলেই পুলিশকে বলা হবে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। সকলের আধার কার্ড আছে কিনা, বহিরাগত কারা আছে, সব খতিয়ে দেখা হবে।” এই পদক্ষেপের মাধ্যমে একদিকে যেমন কলকাতার ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার উপযুক্ত হয়ে উঠবে, তেমনই বহিরাগতদেরও হদিশ মিলবে।

সমস্ত ভবঘুরেকে পুরসভার আশ্রয়স্থলে থাকতে হবে বলেও কড়া বার্তা দিয়েছেন মেয়র। তাঁর কথায়, “কলকাতা পুরসভা বিভিন্ন জায়গায় আরবান হোম শেল্টারগুলি বানিয়েছে। সেখানে এইসব ফুটপাতবাসীদের ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাদের জন্যই ওই ব্যবস্থা করা হয়েছে।” এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় যে ফুটপাতের উপর শিশি, বোতল জড়ো করে রাখা থাকে, সেগুলিও আর থাকবে না বলে জানিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম।

হকারদের ফুটপাত দখল ঘিরে কড়া প্রশাসন। শহরে বেশ কিছু জায়গায় ফুটপাতে পা ফেলার জায়গাটুকুও নেই! হাঁটা দূরস্ত! এই পরিস্থিতিতে কতটা জায়গায় হকাররা বসতে পারবেন তার নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে অনেক আগেই। তাতে বলা হয়েছে, ফুটপাতের এক-তৃতীয়াংশ ছেড়ে বসতে হবে। নির্দেশ অনুযায়ী, মাথার উপর থেকে প্লাস্টিকের ছাউনি হটাতে হবে। এগুলি যাতে ঠিকঠাক মানা হয়, সেজন্য চলছে সমীক্ষা। টাউন ভেন্ডিং কমিটির বৈঠকের পরই সমীক্ষা চালিয়ে দ্রুত পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ ছাড়তে হলে ঠিক কতটা জায়গা পাবেন হকাররা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশের তরফে চলছে মাইকিংও। চলছে পাইলট প্রজেক্টের কাজ।নিয়ম মেনে ইতিমধ্যেই নথি জমা করেছেন হকাররা। আইন মানার আশ্বাস।

একাধিকবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও পুরসভার কথা কানেই তোলেননি কলকাতার সিংহভাগ হকার। রাস্তা দখল করে বসা যেন হকাররা অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছেন। গত কয়েক বছরে কলকাতার রাস্তায় রেজিস্টার্ড হকারের তুলনায় নথিভুক্ত হীন হকারের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। অন্যদিকে প্রশাসনের তরফে কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র ‘কড়া নজর রাখা হচ্ছে’ এই ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে ক্রমাগত। তবে শেষমেশ কলকাতার বিভিন্ন ফুটপাতে বা গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিং এ কত হকার বসে রয়েছে তা নিয়ে শুরু হয়েছে হকার সমীক্ষা।

মূলত শহরের বুকে হকার সম্পর্কে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করতে এবং কোথায় কী নিয়ম ভঙ্গ হচ্ছে বা অবৈধভাবে রাস্তা দখল হচ্ছে কি না তা তুলে ধরতেই এই সমীক্ষা বলে দাবি করেছেন কলকাতা পুলিশ-কলকাতা পুরসভা-হকারদের নিয়ে তৈরি টাউন ভেন্ডিং কমিটির কর্তারা। কিন্তু যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের জেরে যেভাবে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক হকার শহরের যান চলাচল বা হাঁটার জন্য ব্যবহৃত হওয়া রাস্তা দখল করে নিয়েছেন, তাতে আদৌ সমীক্ষা করে কতটা এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্ধিহান প্রশাসনিক মহলই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,বাম আমলে সুনির্দিষ্ট নীতি তৈরি করা হয়েছিল হকারদের জন্য। যার মধ্যে অন্যতম ছিল, ফুটপাতের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা খালি রেখে বসতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ফুটপাত সামান্য খালি রাখা তো দূর, সেটি সম্পূর্ণ ভরাট করে রাস্তায় চলে এসেছেন হকাররা। যদিও যেসব নথিভুক্ত হকার রয়েছেন, তাঁরা কিন্তু ওই সব হকারদের এই ধরনের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু সেই আপত্তি জানানোর হকারদের পরিমাণ এতটাই কম যে তাতে কোনও কাজই হয়নি।

টাউন ভেন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হকারদের সরকারি খাতায় নথিভুক্ত করতে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাতে মেট্রো ৫৯ হাজার জন হকার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নথি জমা দিয়ে নথিভুক্ত হন। কিন্তু যদি বাস্তবে হিসেবে দেখা যায়, বৃহত্তর কলকাতায় রয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার হকার। নিউ টাউন, বিধান নগর এবং রাজারহাট নিয়ে বৃহত্তর কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন ১৬ লক্ষ হকার। সারা ভারতবর্ষে ৪ কোটি হকার।

গত ২০১৮ সালে শেষবার টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি হয়েছিল। তারপর থেকে এই টাউন ভেন্ডিং কমিটি আর তৈরি হয়নি। তারপর আবার চলতি বছরে হয়েছে এক কমিটি তৈরি। নিয়মানুযায়ী, একটা টাউন ভেন্ডিং কমিটিতে নিয়মানুযায়ী থাকবে ৪০ শতাংশ হকার প্রতিনিধি, ১০ শতাংশ হকার প্রতিনিধি, ১০ শতাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি ও ৪০ শতাংশ পুলিশ এবং কলকাতা পুরসভার প্রতিনিধি। এই কমিটির সদস্য থাকবেন মোট ১৮। যদিও নিয়ম এটা থাকলেও, আদতে প্রশাসনের লোক ৭০ শতাংশ এই কমিটিতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতেই থাকে।

সংশ্লিষ্ট কমিটির কর্তারা সবথেকে বেশি জোর দিচ্ছেন, শহরের ফুটপাতের দোকানগুলির মাথার উপর থেকে প্লাস্টিকের ছাউনি সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে। কারণ একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে এই প্লাস্টিকে ছাওনি অন্যতম কারণ ছিল বলে বারবার উঠে এসেছে। এই বিষয়গুলি নিয়েও বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কলকাতা পুরসভা এবং রাজ্য প্রশাসনের তরফে। কিন্তু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হকাররা নিজেদের জায়গাতেই অনড় রয়ে গিয়েছেন।

সম্প্রতি দেখা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টালা সেতু উদ্বোধনে গিয়ে হকারদের যত্রতত্র ফুটপাত দখল এবং প্লাস্টিকের ছাউনি নিয়ে কলকাতা পৌরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের উপরে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি হকারদের কেন পরিচয় পত্র এখনো তৈরি করা গেল না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন।

এরপরই মেয়রের নির্দেশে টাউন ভেন্ডিং কমিটির কর্তাদের বৈঠক এবং দ্রুত নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গড়িয়াহাটের বস্ত্র বিপণিতে আগুন লাগার পরে প্লাস্টিকের ছাউনির মাধ্যমেই তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে হকারদের স্টলে। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি তারপরেও। গড়িয়াহাটে অগ্নিকাণ্ডের পরেই ফুটপাতের স্টল থেকে প্লাস্টিকের ছাউনি সরাতে হকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। কলকাতা পুরসভার তরফে পুলিশকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কোনও ভাবেই ফুটপাতে প্লাস্টিক থাকবে না। ফুটপাত থেকে প্লাস্টিক সরিয়ে হকারদের জন্য তাইল্যান্ড মডেলের অনুকরণ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন মেয়র। ওই মডেল অনুযায়ী, হকারদের স্টলের মধ্যে বসানো থাকবে চৌকো ছাতা।

কিন্তু কয়েক বছর পার হলেও সে সবের কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ। পুরসভার এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পুরসভার প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হননি হকাররাই। যার জন্য প্লাস্টিক সরানো এখনও সম্ভব হয়নি।’’

কলকাতা পুরসভার কর্তাদের কথায়, বাম আমলে অপারেশন সানশাইন ঘিরে যে চরম বিতর্ক হয়েছিল, সেই স্মৃতি এখনও তাজা রয়েছে। বাম আমলকে রীতিমতো কাঠগড়ায় তুলেছিলেন বিরোধী শক্তি। সেই সময় বিরোধী থাকা তৃণমূল বর্তমানে শাসক দল। তাই হকারদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে যাতে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় সে ব্যাপারে সতর্কিত শাসকদলের প্রতিনিধিরা।

তবে টাউন ভেন্ডিং কমিটির কর্তারা নির্দিষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, পিচের রাস্তার উপরে কোনও হকার বসা যাবে না। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে। তাই ফুটপাতের নির্দিষ্ট অংশ ছেড়ে এবং নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকেই হকারদের বসতে হবে। যারা পিচের রাস্তায় বসে রয়েছেন বর্তমানে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। তাদের ফুটপাতে উন্নত ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে এই বক্তব্য থেকে প্রমাণিত, আইন-কানুনের কথা যতই বলা হোক না কেন, ফুটপাত নতুন করে দখল হতে চলেছে। যেসব ফুটপাথ এখন খালি রয়েছে, সেগুলি হয়তো আগামী দিন হকারদের দখলে যাবে। বারবার করে বারুদের আগুনের মতো সমীক্ষা বা নজরদারি চালানোর কথা বলা হবে, তারপর আবার যে কে সেই।

মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বলছেন, উচ্ছেদ করা চলবে না, সেখানে টাউন ভেন্ডিং কমিটির কর্তাদের কড়া ভাবনাচিন্তা কতটা বাস্তবায়িত হবে, সেটাই বর্তমানে বিবেচ্য বিষয়। সাধারণ মানুষ অবশ্য বুঝে গিয়েছেন, ফুটপাত তাঁদের নয়। ফুটপাত তৈরি হয়েছে হকার আর ভবঘুরেদের জবরদখলের জন্যই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here