দেশের সময়: আমরা অনেকেই খেতে ভালোবাসি। কিন্তু কোনটা খাওয়া ভালো তা জানি না। ফলে ভুল করে অনেক সময় এমন কিছু খাবার খাই, যা আমাদের শরীরের ক্ষতি করে। কিংবা উল্টো ঘটনাও ঘটে। এমন কিছু খাবারকে দূরে সরিয়ে রাখি, যেগুলি প্রকৃতপক্ষে শরীরের অনেকটা উপকার করে। এই যেমন মাছের তেল। কোন মাছ ভালো, বড় না ছোট, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেমন বিভ্রান্তি রয়েছে, তেমনই মাছের তেল আদৌও আমাদের খাওয়া উচিত কি না, তা নিয়েও স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে অনেকের মধ্যেই। বহু মানুষ বলে থাকেন, বড় মাছ খাওয়া ভালো নয়। মাছ খেতে হলে ছোট মাছ খাওয়া উচিত। কিন্তু সত্যিই কি তাই? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?


প্রথমেই বলে রাখা যাক, গোটা বিশ্বে প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে মানুষ পছন্দ করে থাকেন মাছ। জানা যাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৫০ মিলিয়ন টন মাছ মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। মাছ তো আমরা খেয়ে থাকি। কিন্তু মাছের প্রতিটি অংশই কি উপকারি? আরও স্পষ্ট করে বললে, মাছের তেল কতটা উপকারি? কারণ, এমন অনেকে আছেন, যাঁরা মাছ খাওয়ার সময় ত্বক ছাড়িয়ে বাদ দিয়ে দেন। তাঁরা কি ঠিক করেন? তবে এক্ষেত্রে একটি তথ্য দিয়ে রাখা দরকার, বহু দেশেই মাছের ত্বক মানুষের অন্যতম প্রিয় খাদ্য। আর এই ত্বকই পুষ্টির আধার।

কী থাকে মাছের ত্বকে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছের ত্বকে থাকে প্রোটিন, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, আয়োডিন, সেলেনিয়াম ও টাউরিন। ফলে নিয়মিত মাছ ও মাছের ত্বক বা তেল খেলে ডায়েটারি প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ হয়। একইসঙ্গে এমন কিছু পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, যা শরীরের পেশি গঠনে সাহায্য করে। আয়রনের ঘাটতি পূরণ হয়। শরীরে ফোলা ভাব থাকলে সেই সমস্যা দূর হয়। কিছু প্রোটিন যেমন হিস্টোন, ট্রান্সফারিন প্রভৃতি দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। মাছের ত্বকে এ ধরনের প্রোটিনের উপস্থিতি রয়েছে।
আয়রন এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের অন্যতম উৎস মাছ। আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ সম্পর্কিত প্রশাসন এফডিএ বলছে, সপ্তাহে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে দুই-তিনবারে ১১৩ গ্রাম মাছ খাওয়া উচিত।
মাছের দেহকোষ থেকে যে ফ্যাট বের করা হয়, তাকে ফিশ অয়েল বা মাছের তেল বলে।

মাছের তেলের ৩০ শতাংশ উপাদান ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ইকোসাপেন্টাইয়েনিক অ্যাসিড (ইপিএ) এবং ডোকোসেহেক্সায়েকনিক অ্যাসিড (ডিএইচএ)। বাকি ৭০ শতাংশ অন্যান্য ফ্যাট। চর্বি বা স্নেহ জাতীয় পদার্থে দ্রবীভূত হয় এমন ভিটামিন, যেমন ভিটামিন এ, ডি প্রভৃতি থাকে মাছের তেলে।
হার্টের যত্নে ৷


অনেকের ধারণা, মাছের তেল হার্টের ক্ষতি করে। একদমই নয়। বরং ঠিক এর উল্টো। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা নিয়মিত মাছের তেল খান, তাঁদের হার্ট ভালো থাকে। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায় অনেকটাই।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ হৃদরোগে প্রাণ হারান। ভারতের ক্ষেত্রে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ফি বছর প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা প্রায় সাত লক্ষ। হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে অনায়াসেই ভরসা রাখা যেতে পারে মাছের তেলে। কারণ, এটি সুস্থ রাখে হার্ট। ভালো কোলেস্টেরল অর্থাৎ এইচডিএলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। তবে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের মাত্রা কমাতে তেমন কোনও কাজ নেই। মাছের তেল ১৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।

ধমনীতে চর্বিজাতীয় পদার্থ জমে বাধা তৈরি করে, একে প্লাক বলে। এর জেরে রক্তবাহী নালি ক্রমশ অনমনীয় হয়ে পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই অবস্থাকে বলে অ্যাথেরোস্ক্লোরোসিস। এর ফলে ধমনীতে রক্তের অনুচক্রিকা ভেঙে যায়। রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। রক্তবাহী নালিতে থেমে যেতে পারে রক্তপ্রবাহ। এর জেরে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত মাছের তেল খেলে ধমনীতে প্লাক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। কিংবা প্লাক তৈরি হলেও তা জটিল আকার নেয় না। যে সমস্ত রোগী হদযন্ত্রের ছন্দপতন জনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে জটিলতা কমাতে পারে মাছের তেল। প্রতিরোধ করতে পারে স্ট্রোক। আমাদের মস্তিস্কের ৬০ শতাংশ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন চর্বি জাতীয় পদার্থ দ্বারা। এই ফ্যাটের বেশিরভাগটাই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড।
দূর করে অবসাদ

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা মানসিক সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা কম। তাঁদেরকে যদি নিয়মিত সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ফিশ অয়েল খাওয়ানো যায়, তাহলে রোগীর পরিস্থিতির উন্নতি হয়। শুধু তাই নয়, যাঁদের মানসিক অসুখের আশঙ্কা রয়েছে, তাঁরাও যদি আগেভাগে ফিশ অয়েল খেতে থাকেন, তা হলে ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। মাছের তেল স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো অসুখের উপসর্গ কমাতেও সাহায্য করে। গবেষণায় প্রকাশ, যাঁরা অবসাদে ভোগেন, তাঁদের মধ্যে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ কম। ওই ব্যক্তিকে যদি নিয়মিত ফিশ অয়েল খাওয়ানো যায়, তা হলে তাঁর অবসাদ অনেকটাই দূর হয়। কারণ, ফিশ অয়েলে থাকা ইপিএ এবং ডিএইচএ অবসাদ দূর করতে দারুণ কার্যকরী। স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা কাটাতে সাহায্য করতে পারে ফিশ অয়েল। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেকের অ্যালঝাইমার্স রোগ দেখা দেয়। তাঁরাও উপকৃত হতে পারেন নিয়মিত মাছের তেল গ্রহণে।


স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে
গবেষকদের দাবি, যাঁরা নিয়মিত ফিশ অয়েল খান, তাঁদের ব্রেনের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর গতিতে হয়। কিছু গবেষণায় আবার এমনটাও দাবি করা হয়েছে, বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে মাছের তেল।
কমাতে পারে ওজন
আজকের দিনে স্থূলত্ব একটি অন্যতম বড় সমস্যা। স্থূলত্ব শরীরে নানা রোগ ডেকে আনে। হার্টের অসুখের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের মতো অসুখের কারণ হতে পারে শরীরের বাড়তি ওজন।
গবেষকদের দাবি, ফিশ অয়েল স্থূলকায় ব্যক্তিদের হার্টের অসুখ ঠেকাতে পারে। নানাভাবে আমরা শরীরের বাড়তি ওজন কমানোর চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের বডি মাস ইনডেক্স বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। দেখা যায়, অনেকের বডি মাস ইনডেক্স ঠিকই আছে, কিন্তু পেটে চর্বি জমছে। একে সেন্ট্রাল ওবেসিটি বলে। এ ধরনের ওবেসিটি রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল বাড়ায়। মাছের তেল পেটের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। মাছের তেলে থাকা ইপিএ এবং ডিএইচএ-র মতো উপাদানগুলি মহিলাদের নিখুঁত শারীরিক আকার বজায় রাখতে এবং পুরুষদের বাড়তি ওজন কমাতে সহায়ক। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন ৬ গ্রাম মাছের তেল খেলে শরীরের বাড়তি ওজন কমে।


দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে
যাঁরা নিয়মিত ফিশ অয়েল খান না, তাঁদের চোখের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বয়সকালে যা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের মতো সমস্যা ডেকে আনে। একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, ১৯ সপ্তাহ টানা উচ্চ মাত্রায় ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পর বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের রোগীর দৃষ্টিশক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।
ব্যথা কমায়
যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে প্রদাহ জনিত সমস্যায় ভুগছেন, ফিশ অয়েল তাঁদের ক্ষেত্রেও উপকারি। কারণ, মাছের তেলে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেন্টারি উপাদান। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, প্রদাহ সৃষ্টিকারী উপাদান হল সাইটোকাইন। নিয়মিত মাছের তেল খেলে এটির উৎপাদন হ্রাস পায়। প্রদাহ কম থাকে। ফলে যাঁরা হাঁটুর ব্যথায় ভুগছেন, তাঁরা আরাম পেতে পারেন। তবে অটো ইমিউন ডিজিজ বা যাঁদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাঁর অসুখ তৈরির জন্য দায়ী থাকে, সেক্ষেত্রে ফিশ অয়েল কতটা সাহায্য করতে পারে, সে ব্যাপারে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ভালো রাখে ত্বক
শুধু মস্তিস্ক বা হার্ট নয়, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আমাদের ত্বকেরও দারুণ উপকার করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। দীর্ঘদিন ধরে সূর্যরশ্মি পড়ার ফলে ত্বক রুগ্ন হয়ে যায়, ফিশ অয়েল ত্বকের এই অবস্থা ঠিক করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে সোরিয়াসিস এবং ডার্মাটাইটিসের মতো অসুখ দূর করে ফিশ অয়েল।
হাড় শক্ত রাখে
একটা বয়সের পর আমাদের শরীরের হাড় থেকে বিভিন্ন খনিজ কমতে থাকে। ফলে ভাঙতে থাকে হাড়। অস্টিওপোরোসিস বা অস্টিওআর্থাইটিসের মতো সমস্যা দেখা দেয়। যাঁরা নিয়মিত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড খান, তাঁদের হাড়ে খনিজের মাত্রা সন্তোষজনক থাকে। ফলে হাড়ের ক্ষয় ধীরে হয়। হাড় মজবুত থাকে।
ফ্যাটি লিভার সারায় ৷

ইদানীং নন অ্যালকোহোলিক ফ্যাটি লিভারের সমস্যা বাড়ছে। এই অসুখে লিভারে চর্বি জমতে থাকে। এভাবে একসময় সিরোসিস অব লিভার হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, হেপাটো সেলুলার কার্সিনোমা বা লিভারের ক্যান্সার। ফিশ অয়েল লিভারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ফলে লিভারের অসুখের ঝুঁকি কমে। নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দূর করতেও কার্যকর মাছের তেলে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড।
অ্যাজমা প্রতিরোধে ৷
আমাদের শ্বাসযন্ত্রে প্রদাহ হলে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তাকে আমরা অ্যাজমা বলি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ফিশ অয়েল অ্যাজমার সমস্যা কমাতে পারে। প্রায় ১ লক্ষ শিশুর উপর করা একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, যে সব বাচ্চা নিয়মিত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করছে, তাদের অ্যাজমার সমস্যা ২৪-২৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছে।


ঝুঁকি কমে ক্যান্সারের নিয়মিত ডায়েটের মাধ্যমে ফিশ অয়েল গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। কিছু স্টাডি জানাচ্ছে, ফিশ অয়েল প্রোস্টেট ক্যান্সারের আশঙ্কা অনেকটাই রুখে দেয়। তবে তা কীভাবে, এনিয়ে এখনও বিশদ কিছু জানা যায়নি।

ভ্রুণের বিকাশে
গর্ভস্থ ভ্রুণের বিকাশে ফিশ অয়েলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সদ্যোজাতর বেড়ে ওঠার পিছনেও অবদান আছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের। ফলে যাঁরা সন্তানসম্ভবা কিংবা যে মায়েরা সন্তানদের ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছেন, তাঁদের জন্য ফিশ অয়েল ভীষণ জরুরি। এটি সদ্যোজাতর অ্যালার্জি রুখতে এবং দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। অনেক শিশুর অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার থাকে। অর্থাৎ বাচ্চা অমনোযোগী হয় এবং তার মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায়। এগুলি দূর করতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই দরকারি।


অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে এবং দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে ডিএইচএ’র বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যেসব মা নিয়মিত মাছ খান, তাঁদের সন্তানরা মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে ডিএইচএ পেতে পারে। গর্ভাবস্থায় একটি শিশুর মস্তিস্কের ৭০ শতাংশের বিকাশ হয়। বাকি ৩০ শতাংশের বিকাশ হয়ে থাকে জন্মের পর পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে। ফলে যেসব হবু মায়েরা নিয়মিত মাছের তেল খেয়ে থাকেন, তাঁদের সন্তানদের মস্তিস্কের গঠন অনেক বেশি উন্নত হয়।

বাড়বে আয়ু
নিয়মিত মাছের তেল খেলে আয়ু বাড়ে। গবেষকরা বলছেন, ধূমপানের কারণে গড়ে চার বছর আয়ু কমে যেতে পারে। আর ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যসিডের অভাবে আয়ু কমতে পারে পাঁচ বছর। ফলে এখন থেকে নিয়মিত ডায়েটে থাকুক মাছের তেল। সাম্প্রতিক এক গবেষণার ভিত্তিতে কানাডার গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জাপানের মানুষের শরীরে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে ৮ শতাংশের বেশি। এর প্রভাবে আমেরিকার নাগরিকদের চেয়ে জাপানের মানুষের গড় আয়ু পাঁচ বছরের মতো বেশি। নিয়মিত মাছ খাওয়ার অভ্যাসের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে ধারণা গবেষকদের। আমেরিকার জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র বলছে, আয়ু বাড়ানোর জন্য ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করে ব্যায়াম চর্চায় জোর দিতে বলা হয়। কিন্তু আয়ু বৃদ্ধিতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, এটা ভুললে চলবে না। আর তা সম্ভব হতে পারে নিয়মিত মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে।

কতটা মাছ খাব?
গ্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিপোক্রিটিস বলেছেন, আপনার খাবারই আপনার ওষুধ। মাছের তেল সেরকমই একটি খাবার। যা বহু রোগ আটকে দেয়। কিংবা রোগ দেখা দিলেও তা দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন বা হু’র মতে, সপ্তাহে অন্ততপক্ষে ১৪০ গ্রাম থেকে ২৮০ গ্রাম মাছ খাওয়া দরকার। যাঁরা মাছ খেতে চান না, তাঁরা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ফিশ অয়েল খেতে পারেন। অনেকের আবার মনে প্রশ্ন আছে, কোন মাছ খাব? ছোট মাছ নাকি বড় মাছ। কেউ কেউ বলে থাকেন, বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছের গুণ বেশি। সাধারণত বড় মাছে বেশি তেল থাকে। তবে বড় মাছে পারদের মতো ধাতুর দূষণে দুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। যা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। সামুদ্রিক মাছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে। বিদেশি মাছ সপ্তাহে দু’বারের বেশি খাওয়া ঠিক নয়। এক-একবারে ৭৫ গ্রাম করে খেতে হবে। দেশীয় মাছে ওমেগা থ্রির পরিমাণ কম, ফলে রোজই এক টুকরো করে রুই, কাতলা, মৃগেল খাওয়া যেতে পারে।


সাপ্লিমেন্ট কেমন হবে?
ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্ট নানাভাবে পাওয়া যায়। যেমন ইথাইল ইস্টারস, ট্রাইগ্লিসারাইডস, রিফর্ম ট্রাইগ্লিসারাইডস, ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফসপোলিপিডস। বিভিন্ন সাপ্লিমেন্টে হাজার মিলিগ্রাম পর্যন্ত ফিশ অয়েল মেলে। তবে ইপিএ এবং ডিএইচএ মেলে ৩০০ মিলিগ্রাম। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের অক্সিডাইজেশন বা জারণ ঘটে, যা ফ্যাটি অ্যাসিডকে নষ্ট করে দেয়। এই সমস্যা এড়াতে এমন ধরনের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত, যার মধ্যে ভিটামিন ই বা ওই ধরনের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্ট রাখতে হবে ঠান্ডা ও অন্ধকার জায়গায়। রেফ্রিজারেটরে রাখা যেতে পারে। তবে তারিখ পেরিয়ে গেলে বা দুর্গন্ধ বের হলে সেই ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্ট কোনওভাবেই খাওয়া যাবে না। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করা চর্বি জাতীয় উপাদান শোষণ করতে পারে। সেকারণে খাবারের সঙ্গেই এই সাপ্লিমেন্ট খাওয়া উচিত। কোন ব্যক্তির কতটা পরিমাণে ইপিএ এবং ডিএইচএ দরকার, তা নির্ভর করে সেই ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্যের উপর। হু’র পরামর্শ অনুযায়ী, প্রতিদিন ডিএইচএ এবং ইপিএ মিলিয়ে ২০০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণ করা যায়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ওমেগা থ্রি অ্যাসিডের পূর্ণ লাভ পেতে চাইলে ফিশ অয়েলের কোনও বিকল্প নেই।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞ?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার শস্যশ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (মৎস্য বিজ্ঞান) ড. স্বাগত ঘোষ বলছেন, যাঁরা ডায়েটে নিয়মিত ফিশ স্কিন অর্থাৎ মাছের ত্বক রাখেন, তাঁদের ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কারণ, মাছের ত্বক ভিটামিন ই এবং কোলাজেনের খুব ভালো উৎস। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোলাজেন ত্বকের আর্দ্রতা, স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। কোলাজেন হল এক ধরনের প্রোটিন, যা সব মাছের মধ্যেই থাকে। ভিটামিন ই চর্বিতে দ্রবণীয় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা তৈলাক্ত মাছে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে ভিটামিন ই। মাছের ত্বকের সর্বোচ্চ উপকারিতা পেতে চাইলে উচ্চ তাপমাত্রায় মাছের ত্বককে প্যানে দিয়ে ফ্রাই বা গ্রিল করে নেওয়া যেতে পারে। মাছকে জলে ফুটিয়ে খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে, এতে মাছের গুণ নষ্ট হয়। সুস্বাদু ত্বকের জন্য পরিচিত মাছের মধ্যে রয়েছে বাসা, ভেটকি, কাতলা, আড়, ম্যাকারেল, স্যামন প্রভৃতি। আবার কম স্বাদযুক্ত ত্বকের মাছ হিসেবে পরিচিত স্নেকফিশ, স্কেট, তরোয়ালফিশ, টুনা প্রভৃতি। নামী শেফরা ত্বক বাদ দিয়ে মাছ রান্না করেন না। এখন তো রেস্তরাঁয় মাছের ত্বক দিয়ে তৈরি কুইজিন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। মাছের ত্বক ভেজে স্টার্টার বা সাইড ডিশ হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে। স্বাদু মাছের ত্বকের স্ন্যাকস দারুণ জনপ্রিয়। তবে এই স্ন্যাকস খাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, খাবারটি যেন ডিপ ফ্রাই করা হয়ে থাকে। অনেক রেস্টুরেন্টে আবার মাছের ত্বকের স্ন্যাকস তৈরির সময় অনেকটা নুন দেওয়া হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বাড়তি ফ্যাট ও সোডিয়ামের কারণে অন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।


এক্সিমোদের দেখেই শেখা
কথায় আছে, মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই মাছ নিয়েও বাঙালির কম কিন্তু নেই। কোন মাছ খাব, মাছ না হয় খেলাম, মাছের তেল খাব কি না, এসবই আর কী! পুষ্টিবিদরা বলছেন, মাছে উচ্চ জৈবমূল্যের প্রোটিনের শতকরা ১৬-২০ ভাগ পাওয়া যায়। আর মাছের মতোই সমান উপকারি এর তেল। মাছের তেল একাধিক রোগ উপশমে সাহায্য করতে পারে। হৃদরোগ আটকানোর জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় যে ওষুধ রয়েছে, তা তৈরি হয় মাছের তেল থেকেই। মাংসের চর্বির মতো মাছের তেল মোটেই ক্ষতিকর নয়। মাছের তেল নিয়ে ১৯৭০ সালে গবেষণা শুরু হয়। ডেনমার্কের বিজ্ঞানীরা দেখেন, গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসী এক্সিমোরা প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট জাতীয় খাবার খান। এর মধ্যে বেশিরভাগটাই সামুদ্রিক মাছ। এর ফলে তাঁদের মধ্যে হার্টের অসুখ, বাতের সমস্যা, হাড়ের সমস্যা প্রায় হয় না বললেই চলে। এর পরই মাছের তেলের যুগান্তকারী ভূমিকা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা শুরু হয়ে যায়।


মাছের তেলে পুফা
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছের ক্যালোরি নির্ভর করে তার চর্বির মাত্রার উপর। ঋতু বিশেষে এই মাত্রা কম-বেশি হয়। মাছের ডিম পাড়ার সময় হলে তার শরীরে ফিশ অয়েলের পরিমাণ বাড়ে। তখন ক্যালোরিও বেড়ে যায়। ফ্যাট মূলত দু’ধরনের। একটি মুফা অর্থাৎ মোনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, অন্যটি পুফা অর্থাৎ পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। পুফাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড। মাছের তেলে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, ওবেসিটি রুখতে দারুণ কার্যকরী। এছাড়া নিয়মিত মাছের তেল খেলে রক্তনালিতে কোলেস্টেরল জমা হতে পারে না। মাছের তেলে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের বেশিরভাগটাই পুফা। এই পুফা আকস্মিক হৃদরোগের আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ে দেয়। বুকে ব্যথা, স্ট্রোক ও ধমনীর অসুখের আশঙ্কা কমাতেও সাহায্য করে পুফা। যাঁদের হার্টের সমস্যা নেই, তাঁদের ক্ষেত্রেও মাছের তেল করোনারি ধমনীর ভিতরের পথ লিউমেনকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ করে মাছের তেল।

কারা খাবেন না
মনে রাখতে হবে, ওমেগা থ্রি বেশি হয়ে গেলে পেট খারাপ, বমি, গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। যাঁরা সাপ্লিমেন্ট নেন, তাঁরা দিনে ৩ গ্রামের বেশি নেবেন না। কারা খাবেন না মাছের তেল, যাঁরা রক্ত তরল করার ওষুধ খান। খেলে অবশ্যই চিকিৎসক কিংবা পুষ্টিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে নেবেন। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রক্ত তরল রাখে। ফলে অপারেশনের আগে মোটেই খাওয়া চলবে না। ম্যাকারেল, হেরিং, সলোমান, টুনার মতো মাছে ১০০ গ্রামে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে ১.১-১.৬ গ্রাম। আমাদের দেশীয় মাছে এই পরিমাণ ০.৭ গ্রাম থেকে ০.৮ গ্রাম। ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড হল লিনোলিক অ্যাসিড। এটি বিপাক ক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড পরিবারের এরাকিডনিক অ্যাসিডে পরিণত হয়।
গবেষণা বলছে, ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের খাবারে অনুপাত থাকা উচিত ৬: ১। যদি কোনও কারণে ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন রক্তনালিতে চর্বি জমার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। যাঁদের হার্টের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভোগেন। ফলে তাঁদের ডায়েটে নুনের পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে নুন ব্যবহার করা হয়। ফলে প্যাকেটজাত সামুদ্রিক মাছ খেলে শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। একারণে তাঁদের দেশীয় মাছ খাওয়াই ভালো। একটা ধারণা আছে, ইউরিক অ্যাসিডে মাছের তেল খাওয়া ঠিক নয়, এই ধারণা ভুল।
মিষ্টি জলের মাছ না সামুদ্রিক মাছ?
অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, মিষ্টি জলের মাছ না সামুদ্রিক মাছ? কোনটা খাব? দুই ধরনের মাছই স্থান পেয়েছে বাঙালির পাতে। তবে পুষ্টিগুণে একটু হলেও এগিয়ে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ। ইলিশ থেকে লইট্যা, সব ধরনের সামুদ্রিক মাছই প্রোটিনের উৎকৃষ্ট আধার। এতে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ডিএইচএ, ভিটামিন ও খনিজের ভাণ্ডার। হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, অ্যানিমিয়া, আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রয়েছে ইলিশ, পমফ্রেট, সার্ডিনের মতো মাছে। ওজন কমাতে পারে চিংড়ি। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে স্যামন, টুনার মতো সামুদ্রিক মাছ। ছোটদের মস্তিস্কের বিকাশ ও অবসাদ দূর করতে সামুদ্রিক মাছ দারুণ কার্যকরী। শিশুদের পাশাপাশি প্রবীণরাও নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। সামুদ্রিক মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন প্রবীণদের চোখ, হাড় ভালো রাখতে সাহায্য করে। স্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here