শুভেন্দু ঘোষ, হুগলি: সন্ধিক্ষণ পুজোর বিশেষ মুহুর্তে পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস‍্য , বাড়ির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলাদের থেকে গিয়ে অনুমতি নেন আরতি আরম্ভ করার। অনুমতি মেলার সঙ্গে সঙ্গে একটি বোমা ফাটানো হয়। তারপরেই বয়োজ্যেষ্ঠ সদস‍্য “মা”  বলে ডেকে ওঠেন, সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও “মা” বলে ডাক দেন। আর অমনি এই সময়ে এক সাথে “মা” দুর্গা এবং রাধা গোবিন্দের আরতি শুরু করেন দুই পুরোহিত। ৪০০ বছরের অধিক পুরনো হরিপালের গজা এলাকার “বাবুর বাড়ি”র দুর্গা আরাধনায় সন্ধিক্ষণের সময় এই একই রীতি পালিত হয়ে আসছে আজও। 

হাওড়া তারকেশ্বর শাখার নালিকুল স্টেশনটি প্রাচীন স্টেশন গুলির মধ্যে অন্যতম। তারকেশ্বরের দিকে মুখ করে  স্টেশন থেকে ডানদিক গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ,সবুজে ঘেরা প্রান্তর, ছোট্ট নদীর বয়ে চলা, ঢাকের চামড়ায় কাঠির আওয়াজ,নদী পাড়ে শরতের নীল চাদরে কাশবনের লুটোপুটি, সাথে গ্ৰাম‍্য রমনীদের গরু নিয়ে হেঁটে চলা, আবার কখনও মিষ্ঠি সুরে ডেকে ওঠা পাখিদের কলতান এতকিছু মধ‍্যে দিয়ে প্রায় সাত কিলোমিটার কখন পাড়ি দিয়ে আপনি গজা গ্ৰামে এসে পৌছে যাবেন তা ভাবাই যায় না। এই গজা গ্ৰামেই ভট্টাচার্য্য বাড়ির ৪০০ বছরের অধিক পুরানো দুর্গাপুজোকে ঘিরে রয়েছে নানান প্রাচীন রীতি নীতি। যা এখনও নিষ্টা সহকারে পালন করে আসছেন বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। 

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আনুমানিক ৫০০ বছর আগে রাসবিহারী ভট্টাচার্য্য হরিপালের গজার গ্রামে এসে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় প্রত্যেক বছর অঘ্রাণ মাস ধরে কাত‍্যায়নি পুজো হতো জমিদার বাড়িতে। রাজবিহারী ভট্টাচার্য্যের পুত্র কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য্য একানিষ্ঠ গোবিন্দ ভক্ত ছিলেন। তিনি একদা  বৃন্দাবনে গোবিন্দ  দর্শনে বার হলে পথে স্বপ্নাদেশ পান বৃন্দাবনে নয়, জয়পুরে অধিষ্ঠিত আছেন গোবিন্দ।

সেখান থেকে গোবিন্দের মূর্তি নিয়ে গজা গ্রামে এসে প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য্য। তারপর থেকেই কাত‍্যায়নি পূজো বন্ধ হয়ে মা দুর্গার পূজা চালু হয় ভট্টাচার্য্য বাড়িতে যেটি “বাবুর বাড়ি” নামে খ‍্যাত।

এখনও রাধা গোবিন্দের নিত্য পূজো ও ভোগ আরতি হয় নিষ্ঠা ভরে। কুলো পুরোহিত পুজো দিয়ে সেবার পর শয়ন দেন রাধা গোবিন্দের। আর  সেই রাধা গোবিন্দের মন্দিরের দালানেই পূজিত হন মা দুর্গা। পুজোর চারদিন দূর্গা দালানে মা দুর্গার পাশে বিরাজমান থাকেন রাধা গোবিন্দ । এবং রাধা গোবিন্দের সাথে মা দুর্গার  একসাথে আরাধনা চলে পুজোর চারদিন।

দুটি পুরোহিত একসঙ্গে দুটি পুজোর রীতিনীতির  কাজ সম্পন্ন করেন নিষ্ঠাভরে।। সপ্তমী, অষ্ঠমী, নবমীতে রাধা-গোবিন্দকে প্রথমে উৎসর্গ করা ভোগ। সেই ভোগের একটা অংশ চলে যায় মা দুর্গার কাছে। সঙ্গে আরও অন্য ভোগ দিয়ে মা দুর্গাকে ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রাচীন এই রীতির পরিবর্তন হয়নি আজ ও। দশমীতে বিসর্জনের আগের মুহুর্তে রাধাগোবিন্দ ফিরে যান তাঁর নিজ স্থানে। 

জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পূজার মাধ্যমে ” বাবুর বাড়ি” দুর্গাপুজোর শুরু হয়। এক চালচিত্রের মধ্যেই একই বংশের পটুয়ারা বাবুর বাড়িতে এসে প্রতিমা নির্মাণের কাজ করেন। তপ্ত কাঞ্চন বর্নে রঞ্জিত হয়ে ওঠে মা দুর্গার শরীর।

মহালয়ার পর প্রতিপদে বোধন ঘট স্থাপন হয় এবং সেই থেকেই ভোগ নিবেদন শুরু হয়। বাড়ির প্রাচীন রীতি অনুযায়ী ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় হয় বিল্ব বৃক্ষ বরণ। বাড়ির বিবাহিত সমস্ত মহিলারা মাকে কন্যা রূপে বরন করেন এটা ই রীতি। সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান। সন্ধিক্ষনের পুজোও প্রাচীন রীতি মেনে সম্পন্ন হয়। গোপী মন্ত্রে পুষ্পাজ্ঞলী দেন পরিবারের সদস‍্যরা।

বলি প্রথা বন্ধ তাই মাশকড়াই নিবেদন করা হয় দুর্গার চরনে। নবমীতে মাকে অনেক রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়, সেই ভোগই পরিবারের সমস্ত সদস্যরা একসাথে মিলে অপরাহ্নে গ্রহণ করেন। দশমীতে মাকে কচু শাক , পাঁচ রকমের ভাজা সহযোগে পান্তা ভোগ নিবেদন করা  হয়।  

 “বাবুর বাড়ি”র এস্টেটের এক সদস্য জানান, দশমীতে মাকে পান্তাভোগ নিবেদন করার পর সেই ভোগ পরিবারের সবাই মিলে গ্রহণ করেন।  তারপর এস্টেটের সভাপতির অনুমতি নিয়ে সুতো কাটা হয় মা দুর্গার।

বিসর্জনের শোভাযাত্রায় পরিবার ও  স্থানীয়দের নিয়ে প্রায় হাজার মানুষ সমাবেত হন। এবং “বাবুর বাড়ি” ঠাকুর বিসর্জনের পরেই  গ্ৰামের অন‍্যান‍্য বাড়ি ও এলাকার অন‍্যান‍্য পুজা কমিটির প্রতিমা বিসর্জন  হয়।

পরিবারের সমস্ত সদস্যরা নাচ গান বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হই-হুল্লোড় করে কাটান পুজোর কদিন ৷

গ্ৰামের ছেলেরা যাত্রাপালা করে। এবং কোজাগরী লক্ষী পুজো উপলক্ষ‍্যে গ্ৰামের সমস্ত মানুষকে চিড়ে, মুড়কী বিতরণ করা হয় “বাবুর বাড়ি” থেকে। পুজোর রীতি অনুযায়ী দশমীতে আতশবাজি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here