দেশের সময়: শুক্রবার, ১৩ জুলাই দুপুর ২:৩৫ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দ্বিতীয় চন্দ্রযাত্রার ব্যর্থতা কাটিয়ে পৃথিবীর মাটি ছাড়বে চন্দ্রযান-৩। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন স্পেস রিসার্চ সেন্টার থেকে জিএসএলভি মার্ক-৩ (GSLV Mark 3) রকেটে চেপে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সীমা ছাড়িয়ে যাবে ইসরোর চন্দ্রযান।

২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ অভিযানে রোভার-সহ বিক্রম নামের ল্যান্ডারটি চাঁদে মুখ থুবড়ে পড়ার পর থেকে কিছুদিন সে ভাবে চন্দ্রাভিযান নিয়ে সাড়াশব্দ করেনি ইসরো। বরং গগনযান (মহাকাশে মানুষ পাঠানোর অভিযান) নিয়েই নানা কথা বলা হয়েছে। গগনযান মিশন নিয়ে প্রস্তুতিও তুঙ্গে।

এর মধ্যেই গত বছর ইসরো ঘোষণা করে তৃতীয় চন্দ্রযাত্রার প্রস্তুতি শেষের দিকে। এবারের দায়িত্ব আরও বেশি। চন্দ্রযান-৩ (Chandrayaan 3) মিশনে ল্যান্ডারকে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করাতেই হবে। এবার আর কোনও ভুল করা চলবে না। তাই ল্যান্ডারের মডেল বানানো ও তার সফট ল্যান্ডিং করানোর জন্য আরও জোরদার গবেষণা হয়েছে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অভিজ্ঞ গবেষক রয়েছেন এই সফট ল্যান্ডিংয়ের দায়িত্বে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক অমিতাভ গুপ্ত ও ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক সায়ন চট্টোপাধ্যায় ল্যান্ডারের মডেল বানানোর কাজ করেছেন। এই গোটা মিশনের জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৬১৫ কোটি টাকা।

চন্দ্রযান-২ অভিযানের তিনটি অংশ ছিল, অরবিটার (যা কক্ষপথে পাক খায়), ল্যান্ডার (যা মাটিতে অবতরণ করে এবং এক জায়গায় থিতু হয়) এবং রোভার (যন্ত্রচালিত গাড়ি)। সূত্রের খবর, চন্দ্রযান-৩ অভিযানে অরবিটার থাকছে না। শুধু ল্যান্ডার এবং রোভার থাকবে। সেগুলির পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। চন্দ্রযান ৩-এর প্রযুক্তিতে কী কী বদল আনা হয়েছে সেই ব্যাপারে এখনও সবটা জানাননি ইসরোর গবেষকরা। শোনা গেছে, তৃতীয় চন্দ্রযাত্রার উদ্দেশ্যও হতে পারে চাঁদের আঁধার পিঠ অর্থাৎ দক্ষিণ মেরুর রহস্যের খোঁজ। এই দক্ষিণ মেরুরই কোথাও হারিয়ে গেছে চন্দ্রযান ২-এর ল্যান্ডার বিক্রম। চন্দ্রযান ৩ চাঁদের সেই রহস্যময় পিঠেরই গোপন কথা সামনে আনবে।

এবারের চন্দ্রযানে মোট ১৩টি ‘থ্রাস্টার’ রয়েছে, যা সফট ল্যান্ডিং করতে সাহায্য করবে। জ্বালানি সহ মহাকাশযানটির ওজন প্রায় আড়াই হাজার কেজি। জ্বালানিশূন্য অবস্থায় সেটির ওজন ৫০০ কিলোগ্রামে নেমে আসবে। তাতে থাকবে বিশেষ ক্যামেরা এবং অন্যান্য প্রযুক্তি। অবতরণস্থল থেকে যদি ল্যান্ডার সরেও যায় তাহলেও যাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় থাকে সেই প্রযুক্তিও দেওয়া হচ্ছে।

গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর রাতে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরেই ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চাঁদের কক্ষপথে ঘুরতে থাকা অরবিটার রেডিও সিগন্যাল পাঠালেও তাতে ধরা দেয়নি ল্যান্ডার বিক্রম। অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর, ৩৫X১০১ কিলোমিটার কক্ষপথ ধরে সোজা চাঁদের মাটিতে নেমে আসার কথা ছিল ল্যান্ডার বিক্রমের। এই ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব পার করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামিং ল্যান্ডারের মধ্যে করে রেখেছিলেন বিজ্ঞানীরা।

সোজা নামতে নামতে শেষ ৫ কিলোমিটারে মুখ ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে (Vertical) চাঁদের পিঠে নামার কথা ছিল বিক্রমের। এই পর্যায়ে গতি এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কথা যাতে ভার্টিকালি ঘুরে গিয়ে পালকের মতো চাঁদের মাটিতে নামতে পারে ল্যান্ডার। যাকে বলে সফট ল্যান্ডিং (Soft Landing)। এই ৯০ ডিগ্রি রোটেশন হয়নি। বরং ২.১ কিলোমিটার থেকে পুরোপুরি উল্টে গিয়ে সজোরে চাঁদের মাটিতে ধাক্কা খেয়েছে সে।

অবতরণের প্রথম পর্যায় গতিবেগের ভারসাম্য বজায় ছিল, অর্থাৎ চন্দ্রপৃষ্ঠের ৩০ কিলোমিটার থেকে ৭.৪ কিলোমিটার দূরত্বে বিক্রমের গতিবেগ স্বাভাবিক ভাবেই ১,৬৮৩ মিটার/সেকেন্ড থেকে কমে যায় ১৪৬ মিটারে। সমস্যা তৈরি হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে। চাঁদের মাটির খুব কাছাকাছি গিয়ে গতিবেগে গলদ হয়ে যায় বিক্রমের। যে নির্দিষ্ট মাত্রার বেগ তার সিস্টেমে আপডেট করা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে বিক্রম। যে জায়গায় তার ল্যান্ড করার কথা ছিল তার থেকে অন্তত ৫০০ মিটার দূরে ছিটকে পড়ে। তৃতীয় চন্দ্রাভিযানে সেই ত্রুটি সামলে নেওয়া হবে বলেই আশাবাদী সকলে।

দ্বিতীয় চন্দ্রযাত্রার ভুলগুলো শুধরে এসে গেছে
তৃতীয় চন্দ্র মিশন। ল্যান্ডার বিক্রমের দুঃখ ঘোচাবে কি চন্দ্রযান-৩ , সেদিকেই তাকিয়ে সারা দেশ। সব ঠিক থাকলে, চন্দ্রযান ৩ পালকের মতোই সফ্ট ল্যান্ড করবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর আঁধার পিঠে, কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ হবে না, এমনটাই দাবি করেছে ইসরো (ISRO)। নাসা যেমন তাদের আর্টেমিস মিশন নিয়ে হইচই করছে, ইসরোর অন্দরেও তেমনই তৃতীয় চন্দ্রযাত্রা নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে।

অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টার। ইসরোর অগ্নিপরীক্ষা কি সফল হবে, তাকিয়ে গোটা দেশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here