দেশের সময়: ভয়াবহ আগুনে পুড়ছে কানাডার বনাঞ্চল। এর প্রভাব যেমন পড়ছে কানাডায় তেমনই পড়ছে উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এর জেরে দুই দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই আগুনকে ইতিহাসের ‘সবথেকে ভয়াবহ দাবানল’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

কানাডার দক্ষিণ অংশে রয়েছে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। সেই বনাঞ্চলের প্রায় ৩৮ লক্ষ হেক্টর জঙ্গল এলাকায় লেগেছে আগুন। প্রবল গরমের জেরেই এই দাবানল বলে জানানো হয়েছে কানাডা সরকারের তরফে। এর জেরে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অংশে বেড়েছে দূষণের মাত্রা। স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে।

দাবানলের জেরে কানাডায় প্রায় ২০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রভাব এতদূর ছড়িয়েছে যে ঘরবন্দি নিউ ইয়র্কবাসী| কানাডায় এখনও ১৫০টি অগ্নিকাণ্ড সক্রিয় রয়েছে। এর জেরে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে। যার জেরে আমেরিকার ওই শহরের প্রচুর মানুষ সমস্যায় পড়েছেন। নিউ ইয়র্কের পাশাপাশি ম্যানহাটন শহরেও এর প্রভাব পড়েছে।

কানাডার দাবানলের জেরে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিমান চলাচলে। অনেক এলাকায় দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় একাধিক বিমান বাতিল করা হয়েছে। বিভিন্ন খেলার অনুষ্ঠানও বাতিল হয়েছে গত কয়েক দিনে। মেজর লিগ বেসবলের একাধিক ম্যাচ বাতিল হয়েছে গত কয়েক দিনে। নিউ ইয়র্ক ইয়ানকির সঙ্গে চিকাগো হোয়াইট সক্সের ম্যাচ বুধবার বাতিল হয়েছে। ডেট্রয়েট টাইগারের বিরুদ্ধেও ম্যাচ বাতিল হয়েছে দূষণের কারণে। আমেরিকার বাস্কেটবল লিগ এনবিএ-র একাধিক ম্যাচও বাতিল হয়েছে।

কানাডার দাবানলের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকার বিভিন্ন নগরীতেও। দাবানলের কারণে হাজার হাজার নাগরিক বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

দাবানলে এরই মধ্যে পুড়ে গিয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ হেক্টর জমি। শুষ্ক আবহাওয়া আগামী কয়েকমাস ধরে চলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

কানাডায় দাবানল প্রায়শই হলেও পূর্ব এবং পশ্চিমে এভাবে টানা আগুন জ্বলতে সচরাচর দেখা যায় না। এই আগুন নেভাতে সহায়তার জন্য কানাডা সরকারকে সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই ভয়াবহ দাবানলের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, “এই আগুন নিত্যদিনের রুটিন, জীবন, জীবিকা এবং বাতাসের মানের ওপর প্রভাব ফেলছে।”

সবচেয়ে বেশি আগুন জ্বলছে পূর্বাঞ্চলীয় কুইবেক প্রদেশে। সেখান থেকে ১১ হাজারের বেশি মানুষকে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

গতমাসে অ্যালবার্টায় দাবানল আগেভাগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই দাবানলে পুড়ে যায় রেকর্ড পরিমাণ এলাকা।

দাবানলের ধোঁয়ার পূর্বাভাস বিষয়ক ওয়েবসাইট ব্লুস্কাই কানাডা বলছে, বৃহস্পতিবার দাবানলের ধোঁয়া দেশের বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকী নিউ ইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

ধোঁয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান কয়েকটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। কানাডাজুড়ে ৪০০’রও বেশি জায়গায় আগুন জ্বলছে। এর মধ্যে ২৩৬ টি জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

কানাডা সরকার বলেছে, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে প্রায় ১০ কোটি মানুষ এখন অত্যন্ত দূষিত বায়ুর মধ্যে বাস করছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শতশত অগ্নিনির্বাপণকর্মী কানাডায় পাঠানো হয়েছে এবং আরও কর্মী কানাডায় যাওয়ার পথে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
কানাডার পূর্বাঞ্চলে গ্রীষ্মের শুরুতেই নজিরবিহীন দাবানলের ধোঁয়ায় দূষিত বাতাসের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বাসিন্দাদের সতর্ক করেছে নিউ ইয়র্ক, টরন্টো ও অটোয়ার কর্তৃপক্ষ।

উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় এবার দাবানলের মৌসুম তুলনামূলক অনেক আগেই শুরু হয়েছে, এর তীব্রতাও ব্যাপক। এর ফলে দেশটি তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে দাবানলের বছর দেখতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

দেশটিতে উষ্ণ ও শুষ্ক পরিস্থিতিও কয়েক মাস ধরে থাকবে বলে আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে।

কানাডার ১০টি প্রদেশ ও অঞ্চলের মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই দাবানলের খবর পাওয়া যাচ্ছে, এর মধ্যে বজ্রপাতের কারণে একাধিক জায়গায় আগুন লাগা ক্যেবেকের পরিস্থিতিই সবচেয়ে খারাপ বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
পার্শ্ববর্তী দেশে দাবানলের ধোঁয়া নিয়ে নিউ ইয়র্ক, ব্রঙ্কস, কুইনসসহ একাধিক এলাকার বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে নিউ ইয়র্ক রাজ্যের পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগ।

ঝুঁকি কমাতে বাসিন্দাদেরকে ঘরের বাইরের কর্মকাণ্ড সীমিত করার কথা বিবেচনায় নিতেও পরামর্শ দিয়েছে রাজ্যটির কর্তৃপক্ষ।

দাবানলের ধোঁয়ায় মঙ্গলবার সকালে কানাডার রাজধানী ওটোয়াকে ধোঁয়াশায় ঢাকা অবস্থায় দেখা গেছে, সেখানকার বাতাসের মান ১০+ মাত্রায় পৌঁছেছে, এটা কানাডার বাতাসের মানজনিত স্বাস্থ্যতালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থান, যার অর্থ বাতাসে স্বাস্থ্যের ‘ঝুঁকি মারাত্মক’। অটোয়া ক্যেবেকের পাশে অবস্থিত।

“স্থানীয় দাবানল ও ক্যেবেকের দাবানলের ধোঁয়ায় বাতাসের মানের চরম অবনতি হয়েছে,” অটোয়ার বাতাসের মান নিয়ে সতর্কবার্তায় বলেছে এনভায়রনমেন্ট কানাডা।

টরন্টোর বাতাসও দূষিত হয়ে গেছে এবং এই পরিস্থিতি পুরো সপ্তাহ ধরেই চলতে পারে, বলেছে সরকার পরিচালিত আবহাওয়া সংস্থা।
সামান্য পরিমাণ দাবানলের ধোঁয়াও ক্ষতির কারণ হতে পারে। ফুসফুস বা হৃদরোগে আক্রান্তদের পাশাপাশি দাবানলের ধোঁয়ায় বৃদ্ধ, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্যও উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে, বলেছে এনভায়রনমেন্ট কানাডা।

মঙ্গলবার কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি দাবানল মোকাবেলায় দমকলকর্মী পাঠানোয় যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্সকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

দাবানল কানাডার পশ্চিম প্রদেশগুলোতে নিয়মিতই দেখা যায়, কিন্তু এ বছর আগুন ছড়িয়েছে কানাডার পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে, যা সেসব এলাকায় লাখো লোককে ঘরবাড়ি ছাড়তে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সামরিক বাহিনী পাঠাতে বাধ্য করেছে।

দাবানল এরই মধ্যে ওইসব এলাকার ৩৩ লাখ হেক্টর জমি পুড়িয়েছে, যা গত ১০ বছরের গড়ের চেয়েও ১৩ গুণ বেশি।

“কীভাবে নিরাপদে থাকা যায়, সে বিষয়ে লোকজন যেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কথা নিয়মিত শোনে, সে ব্যাপারে জোর দিতে চাই আমি, এমনকী অটোয়ার মতো এলাকাগুলোও, যেসব এলাকা দাবানলের ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত,” অটোয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here