দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ

দু’পাশে দু’জন সিবিআই অফিসার গাড়ির পিছনের সিটের মাঝে পি চিদম্বরম। নজিরবিহীন নাটকের শেষে বুধবার রাতে জোড়বাগের বাংলো চিদম্বরমকে নিয়ে সিবিআইয়ের গাড়ি পৌঁছয় লোদী রোডে সিবিআই সদর দফতরে। আজ, বৃহস্পতিবার বেলার দিকে আদালতে পেশ করা হবে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে। তাঁকে ১৪ দিন হেফাজতে রাখার আর্জি জানানো হতে পারে।

সূত্রের খবর, আইএনএক্স মিডিয়া এবং এয়ারসেল ম্যাক্সিসকাণ্ডে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় চিদম্বরমের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে সিবিআই। আইএনএক্স দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত চিদম্বরম-পুত্র কার্তি চিদম্বরও। সিবিআই জানিয়েছে, এ দিন বাবার মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হতে পারে ছেলেকেও।

২০০৭ সালে ইউপিএ জমানায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকার সময় আইএনএক্স মিডিয়ায় ৩০৫ কোটির বিদেশি অনুদানের অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই সময় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রকের অধীন ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন বোর্ডের (এফআইপিবি) অনুমোদন নিতে হত। অভিযোগ, সে সময় আইএনএক্স মিডিয়ায় ৩০৫ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগে বেআইনি ভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পরই তদন্ত শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। প্রাথমিক তদন্তের পর ইডি দাবি করে, ওই ৩০৫ কোটি টাকা যে সংস্থায় ট্রান্সফার হয়েছিল, সেটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন চিদম্বরমের ছেলে কার্তি চিদম্বরম। ইডি আরও দাবি করে, কার্তির হস্তক্ষেপেই এফআইপিবি এই বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছিল। আইএনএক্স দুর্নীতি মামলায় ২০১৭ সালে এফআইআর দায়ের করে সিবিআই। অন্য দিকে, অর্থ তছরুপের দায়ে ২০১৮ সালে অভিযোগ দায়ের করে ইডি-ও। তার পর থেকে তদন্তের স্বার্থে বেশ কয়েক বার বাবা-ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন দুই সংস্থার তদন্তকারী অফিসাররা।

আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় চিদম্বরমের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে তা চ্যালেঞ্জ করে আইনি রক্ষাকবচ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে জরুরি ভিত্তিতে মামলার শুনানি চেয়েছিলেন চিদম্বরম। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই আবেদন গ্রাহ্য না করে আগামী শুক্রবার ওই মামলার দিন ফেলে। সিবিআইয়ের টিম চিদম্বরমের বাসভবনে যায়। কিন্তু তাঁকে কোথাও পাওয়া যায়নি। মোবাইলও ছিল সুইচ অফ। সিবিআই গিয়ে তাঁর বাড়ির মেন গেটে একটি আইনি নোটিসও ঝুলিয়ে আসে।

এর প্রায় ২৭ ঘণ্টা পরে চিদম্বরম উদয় হন সরাসরি এআইসিসি সদর দফতরে। সেখানে তিনি ছোট ও লিখিত বিবৃতিতে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেন। তখন তাঁর পাশে কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিংভি ও গুলাম নবি আজাদদের মতো বড় নেতারা। এ দিকে, কংগ্রেসের দলীয় কার্যালয়ে চিদম্বরমের সাংবাদিক বৈঠক করার খবর পেয়ে সিবিআই ও ইডি সেখানে পৌঁছে গেলেও, তার কিছু আগেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যান চিদম্বরম। ফলে তখন ধরা যায়নি তাঁকে। এর পরেই তাঁকে ধাওয়া করে সিবিআই ও ইডি-র একাধিক টিম পৌঁছে যায় জোড়বাগে। সেখানে শুরু হয় নাটক। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকতে দেখা যায় সিবিআই কর্তাদের। টানটান উত্তেজনায় চিদম্বরমকে গ্রেফতার করে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে যায় সিবিআই।

দ্বিতীয় রাউন্ডে ইন্দ্রানীর বয়ানের ভিত্তিতেই জেরা চিদম্বরমকে, অভিযোগ মোটা টাকা ঘুষ নেওয়ার

বুধবার গ্রেফতারির পরে রাতভর লোদী রোডের সিবিআই দফতরেই ছিলেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। দফায় দফায় তাঁকে জেরা করেন সিবিআই অফিসাররা। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর, দ্বিতীয় রাউন্ডে চিদম্বরমকে জেরার সময় উঠে আসে আইএনএক্স মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও শিনা বরা হত্যায় মূল অভিযুক্ত ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়ের নাম। সিবিআই জানিয়েছে, আইএনএক্স মিডিয়া দুর্নীতি মামলায় চিদম্বরম ও তাঁর ছেলে কার্তির বিরুদ্ধে তদন্ত গতি পায় ইন্দ্রানীর বয়ান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই।

বুধবার রাতে গ্রেফতারির পরে চিদম্বরমকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। সেখানে তাঁর শারীরিক পরীক্ষার পরে সিবিআই গেস্ট হাউসের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ৫ নম্বর ঘরে রাখা হয় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীকে। সিবিআই জানিয়েছে, চিদম্বরম ও কার্তির বিরুদ্ধে তদন্তের অন্যতম বড় অস্ত্র হলই ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়ের বয়ান।

২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়ের বয়ান রেকর্ড করেছিলেন সিবিআই অফিসাররা। বয়ানে ইন্দ্রানী বলেছিলেন, তাঁদের আইএনএক্স মিডিয়াকে বেশ কিছু সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বদলে বড় অঙ্কের ঘুষ চেয়েছিলেন কার্তি। ইডি-র কাছে ইন্দ্রাণী ও তাঁর স্বামী মিডিয়া ব্যারন পিটার মুখোপাধ্যায় দু’জনেই দাবি করেছিলেন, চিদম্বরম অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৬ সালে তাঁরা নর্থ ব্লকে গিয়ে দেখা করেছিলেন। চিদম্বরম তাঁদের কার্তির কাছে পাঠান। চার দফায় ৭ লক্ষ ডলার কার্তির চারটি সংস্থাকে ‘ঘুষ’ দেওয়া হয়েছিল।

মেয়ে শিনা বরাকে হত্যার অভিযোগে ২০১৫-র অগস্ট থেকে মুম্বইয়ের বাইকুল্লা জেলে বন্দি ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়। অন্যদিকে, মুম্বইয়েরই আর্থার রোড জেলে রয়েছেন পিটার। তাঁরাই আইএনএক্স মিডিয়ার যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা। অর্থমন্ত্রকের অধীনস্থ ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন বোর্ডের (এফআইপিবি)-র অনুমোদন না নিয়েই, সংস্থার জন্য কোটি কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ আনার অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে আইএনএক্স মিডিয়াকে নোটিস ধরায় আয়কর দফতর। তখনই কার্তি চিদম্বরমের আইনি ও আর্থিক পরামর্শদাতা সংস্থা অ্যাডভান্টেজ স্ট্র্যাটেজিক কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেডের (ASCPL) দ্বারস্থ হন ইন্দ্রাণীরা। অভিযোগ, ইন্দ্রানী-পিটারের সংস্থার থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে তাঁদের বিদেশি লগ্নির টাকায় ছাড়পত্র পাইয়ে দেন কার্তি। এই কাজে ছেলের পাশে ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here