পিয়ালী মুখার্জী

শুরু হয়ে গিয়েছে পুজোর কাউন্টডাউন। আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা জানান দিচ্ছে শরতের। যদিও মহামারী মায়ের অবহনের চিত্র টা বদলে দিয়েছে আমূল। তবুও বঙ্গের বাঙালি সীমিত পরিসরে হলেও দুর্গা পুজোর প্রস্তুতিতে লেগে পড়েছেন পুরোদমে।

ছবি – দেবালন্দ পাইন৷

হাবড়ার বাসিন্দা প্রতিমা ও মণ্ডপ শিল্পী ইন্দ্রজিৎ পোদ্দার উত্তর চব্বিশ পরগনার পরিচিত নাম। তাঁর সাথে কথা বলে জানা গেল, বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে লড়াই করে শিল্পী তাঁর শিল্প ও সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার এক অভিনব প্রয়াস করে চলেছেন। অন্যান্য বার পুজোর প্রতিমা ও মণ্ডপ তৈরির ছয় সাতটির বরাত পেয়েছেন বাংলা ও পড়শী রাজ্য ত্রিপুরা থেকেও। সেখানে এবার একটাই মন্ডপ তৈরীর কাজ করছেন উত্তর ২৪পরগনা জেলার সোদপুরে। তিনি আরো জানালেন কোভিড পরিস্থিতি তে মানুষের পকেটে টান পরায় পুজোর বাজেটও কমাতে হয়েছে পুজো উদ্যোক্তাদের। যেখানে হয়তো চল্লিশ লাখের পুজো হতো সেখানে বাজেট নামিয়ে আনতে হয়েছে দশ লাখে। কিন্তু আয়োজনে আপোষ করতে তারা রাজি নন। এই পরিস্থিতিতে ইন্দ্রজিৎ বাবু আবারও চমক দিতে ভেবেছেন অভিনব ভাবনা।

ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে সাজাচ্ছেন এবারের সোদপুর শহীদ কলোনীর মণ্ডপ। কাপড়ের টুকরো ফেলে দেওয়া সংসারিক জিনিষ দিয়ে তিনি তুলে ধরছেন তার এবারের থিম “আনন্দ” কে। জীবনের পাঁচটি পর্যায় বাল্য, শৈশব, কৈশোরে, যৌবন ও বার্ধক্য নিয়ে আনন্দের বিবর্তন রূপ পাচ্ছে তাঁর ভাবনায়।

ছবিগুলি তুলেছেন – দেবানন্দ পাইন

ইন্দ্রজিৎ বাবু জানালেন আনন্দ না থাকলে শুধু মাত্র পেটের টানে তিনি কাজ করতেন না। তাঁর মতে জীবনে বেঁচে থাকা, কর্মজীবন সবই ভালোবাসা ও আনন্দ থেকেই উৎপত্তি। তাই সৃষ্টির উৎস আনন্দ। তাই তাঁর সমাজের প্রতি ভালোবাসার দায়বদ্ধতা থেকে তিনি স্বইচ্ছায় নিয়েছেন বিশেষ দায়িত্ব। অনাথ আশ্রমের ছেলেমেয়েদের তিনি এই কাজের সাথে স্বক্রিয় ভাবে যুক্ত করেছেন যে হোমের দায়িত্ব তিনি ও তাঁর ছাব্বিশ জন বন্ধু মিলে পালন ও দেখাশোনা করে আসছেন। সেই ছেলে মেয়ে গুলির খাওয়া দাওয়া রক্ষণাবেক্ষনের পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে, তাদের নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছেন, দিয়েছেন পারিশ্রমিক তাদেরকে স্বনির্ভর গড়ে তোলার জন্য। যাতে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিজেরাই নিজের হাতে জোগাড় করতে পারে বাস্তব সমাজ ব্যবস্থা কে চিনতে শেখে। পাশাপাশি সমাজের ভয়ে যে সব এইচ আই ভি পজিটিভ মানুষ আমাদের আসে পাশে লুকিয়ে রাখেন নিজেদের সেরকম ছাব্বিশ সাতাশ জন কে তাদের প্রতি মাসে ইন্দ্রজিৎ বাবুরা প্রায় পনেরো ষোলোশো টাকার রেশন ও নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিষ সাহায্য করে থাকেন। তাদেরকেও তিনি যুক্ত করেছেন মণ্ডপ ও প্রতিমার কাজে। দিয়েছেন সামাজিক বার্তা।

তিনি আরো জানালেন ,এই কাজে প্রথাগত কোনো প্রশিক্ষণ নেননি। শুরুটা করেছিলেন কলেজ জীবন থেকে। প্রথম কাজ সামুদ্রিক উপাদান ঝিনুক,শামুক ওই জাতীয় কিছু জিনিস কে কাজে লাগিয়ে অভিনব এক প্রতিমা তিনি গড়ে তোলেন তাঁর কলেজের জন্য। তৎকালীন দমকল মন্ত্রী প্রতিম চট্টোপাধ্যায় হাবড়ায় একটি প্রদর্শনী তে তাঁর কাজ দেখে প্রশংসা করেছিলেন এবং উদ্যোগী হয়েছিলেন ওই রকমই একটি মূর্তি বানাতে তারকেশ্বরে একটি পাঠাগারের জন্য।

পাঁচ ফুটের একটি মূর্তি বানিয়ে দেবার পর মন্ত্রী প্রতিম বাবু সেটি সংরক্ষণ করেছিলেন একটি ভ্যাকুয়াম এয়ার টাইট দু ইঞ্চি কাঁচের বাক্সে। তাতে সব মিলিয়ে আনুমানিক খরচ হয়েছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা বলে জানালেন ইন্দ্রজিৎ বাবু। কিন্তু তার সব থেকে বড় আফসোস তিনি চেয়েছিলেন ওই খবরটা সংবাদ মাধ্যমে আসুক, কিন্তু তা আর হয়নি। তখন তিনি এই কথা তার বাবার কাছে বললে তখন তাঁর বাবা বলেছিলেন, “তুমিও বড় শিল্পী হতে পারবে এমন কিছু কারো যাতে সবাই তোমার কাজ নিয়ে আলোচনা করে সেদিন তুমি স্বার্থক হবে।” বাবার সেই কথাকেই মূলমন্ত্র করে সেইদিন থেকেই তাঁর এই পথ চলা। যা সাধারণ ভাবনাতেই আসেনা এমন সব উপাদান ব্যবহার করেই চলেছেন তিনি তাঁর সৃষ্টি তে। আজ তিনি সফল। এমন অনেক কৃতি সফল শিল্পী আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছেন স্বীকৃতির অপেক্ষায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here