দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ প্রয়াত লতা মঙ্গেশকর। জীবনযুদ্ধে হার মানলেন ৯২ বছর বয়সি কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালেই রবিবার সকালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। এদিন সকাল ৮.১২ নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর।
জানা গেছে লতা মঙ্গেশকরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে। সেখানেই তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন ভক্তরা। এই খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশজুড়ে।


করোনা সংক্রমণ নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গত মাস থেকে সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন। তাঁর শারীরিক অবস্থা ওঠা নামা করছিল। মাঝে পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করাও হয়েছিল। কিন্তু শনিবারই ফের তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। আবারও ভেন্টিলেশনে নিতে হয় বর্ষীয়ান শিল্পীকে। গত রাতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বোন আশা ভোঁসলে। তিনি জানিয়েছিলেন দিদি স্থিতিশীল রয়েছেন। তবে শেষরক্ষা হল না।

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুর সংবাদ পেতেই শোকপ্রকাশ করছেন বিভিন্ন মহলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সকলেই বলছেন, ভারতীয় সঙ্গীতের জগতে এ এক যুগের অবসান হল। এই ক্ষতি অপূরণীয়।

১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অধুনা মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরে জন্মেছিলেন লতা। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম হেমা মঙ্গেশকর। লতার বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী এবং মঞ্চাভিনেতা। মা সেবন্তি দেবী। তাঁদের পারিবারিক পদবী ছিল হারিদকর। পরিবারসূত্রে মঙ্গেশকরেরা ছিলেন গোয়ার মঙ্গেশ মন্দিরের পুরোহিত। সেই যোগসূত্রের কথা মনে রেখেই দীননাথ হারিদকর উপাধি পাল্টে তাঁদের পদবী রাখেন মঙ্গেশকর। চার সন্তানের মধ্যে হেমাই বড়। জন্মের কিছুদিন পর কিছুদিন পরে নিজের অভিনীত নাটকের এক প্রিয় চরিত্র লতিকার নাম অনুসারে বড় মেয়ে হেমার নাম বদলে দেন দীননাথ। রাখেন লতা।

সঙ্গীতের আবহে বড় হওয়া লতার। খুব ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি করা হলেও তাঁর স্কুলজীবনের মেয়াদ ছিল মাত্র একদিন। স্কুল থেকে বলা হয়েছিল স্কুলে আসতে হবে একা, নিয়ম মেনে, কোলে করে ছোটবোন আশাকে আনা যাবেনা। এসব নিয়মকানুন ধাতে সয়নি লতার। বিরক্ত হয়ে আর কোনদিন স্কুলের চৌহদ্দিতে পা-ই রাখলেন না ছোট্ট লতা। বাড়িতে গানবাজনা আর খেলাধুলোর করেই কাটছিল শৈশবের দিনগুলো। একদিন তাঁর কানে যায় তাঁর বাবার এক ছাত্র রাগের অনুশীলনে ভুল করছে। সুর লাগছেনা সঠিকভাবে। কিশোরী লতা বাবাকে লুকিয়ে সেই ছাত্রের ভুল শুধরে দেন। ঘটনাটা চোখ এড়ায়নি বাবা দীননাথ মঙ্গেডকরের। মেয়ের জন্মগত প্রতিভা দেখে বিস্ময়ে থ বাবা ঠিক করলেন, আর দেরি নয়। পরের দিন থেকেই শুরু হয় লতার সঙ্গীত শিক্ষা। ৫ বছরের ছোট্ট লতা তানপুরা হাতে অবলীলায় তুলে নিলেন পুরিয়া ধানেশ্রীর মতো সুকঠিন রাগ। এর দু’বছরের মাথায় বাবার সাথে মঞ্চে গান গেয়েছেন, কিশোর চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন লতা। একক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ আসে এর পরেই। লতা তখন ন’বছরের কিশোরী।

অন্ধকার নেমে এল এর পরেই। ১৯৪২ সালে আচমকা হৃদরোগে মারা গেলেন বাবা দীননাথ। চার নাবালক ভাইবোন আর মাকে নিয়ে শুরু হল ১৩ বছরের লতার জীবনযুদ্ধ। বিনায়ক দামোদর কর্নাটকি বা মাস্টার বিনায়ক ছিলেন লতাদের পারিবারিক বন্ধু। তিনি তাঁর ‘নবযুগ’ ফিল্ম কোম্পানিতে ছোটখাটো চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় করার সুযোগ করে দেন লতাকে। অভিনয় করতে কোনওদিন ভালো লাগেনি লতার। কিন্তু অভুক্ত পরিবারের কথা ভেবে চালিয়ে গেছেন অভিনয়। চরিত্রের প্রয়োজনে চুল কেটে বা ভুরু প্লাক করে দিলে বাড়িতে ফিরে মা’র কোলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা তাঁর। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার একটাই পথ, গান। সুযোগ খুঁজছিলেন লতা
সুযোগ এল। পরপর কয়েকটা মারাঠি ছবিতে গান গেয়ে নজরে পড়েন তিনি। এরপর ১৯৪৩ সালে মারাঠি ছবি গজভাউ’য়ে প্রথমবার হিন্দিতে গান গাওয়ার সুযোগ এল। ১৯৪৫ সালে মাস্টার বিনায়কের সঙ্গেই বম্বে’তে পা রাখলেন লতা মঙ্গেশকর।

গান বন্ধ হয়নি লতার। লড়াই করেও সঙ্গীতশিক্ষা চালিয়ে গেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নাড়া বাঁধলেন ওস্তাদ আমান আলি খানের কাছে। অভিনয়ও চলছিল। মাস্টার বিনায়কের প্রথম হিন্দি ছবি ‘বড়ি মা’-তে অভিনয় করেন লতা। সঙ্গে ছিলেন বোন আশা। এই ছবিতে “মাতা তেরি চরনো মে” নামের একটি চমৎকার ভজন গান লতা।
কিন্তু এভাবে সকাল থেকে রাত অবধি স্টুডিওতে কাজ করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ভাইবোনদের মানুষ করার জন্য সেসময় প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন লতা। ছেড়ে দিলেন গান শেখা। প্রায় একই সময়ে ১৯৪৮ সালে মারা মাস্টার বিনায়কও। আবার পিতৃহারা হলেন লতা।

লতা ঠিক করেন অভিনয় আর নয়। এবার শুধুই সঙ্গীত নিয়ে পথ চলা শুরু। এই সময় আলাপ হয় সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের সাথে। বা পরে এক সাক্ষাৎকারে লতা স্বীকার করেছি গুলাম হায়দারই ছিলেন তাঁর আসল পথপ্রদর্শক।

এই সময় লতার আলাপ হয় সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের সাথে। বহু বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে লতা নিজেই বলেছেন, গুলাম হায়দারই ছিলেন তাঁর আসল পথপ্রদর্শক। লতার প্রতিভাকে সঠিক চিনেছিলেন তিনি। সেটা ১৯৪৮ সাল। শশধর মুখার্জি তাঁর নতুন ছবির জন্য অচেনা কণ্ঠ খুঁজছেন। গুলাম হায়দার লতার নাম প্রস্তাব করলে বাতিল করে দেন শশধর মুখার্জি।

তাঁর মনে হয়েছিলো, নায়িকার তুলনায় লতা’র কণ্ঠ পাতলা। গুলাম হায়দারও ছাড়ার পাত্র নন। ‘মজবুর’ নামের একটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করছিলেন তিনি। সেই ছবিতেই “দিল মেরা তোড়া” গানটি দিয়ে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখলেন লতা মঙ্গেশকর। প্রথম গানই প্রবল হিট করে।


শুরুর দিকে লতার গায়কিতে সিনিয়র গায়িকা নূরজাহানের প্রভাব থাকলেও, ক্রমশ সেসব কাটিয়ে ওঠেন তিনি। মারাঠি উচ্চারণের প্রভাব কাটিয়ে ঠিকঠাক হিন্দি আর উর্দু শেখাও জন্য শিক্ষকও নিয়োগ করেন লতা। এতটাই তীব্র ছিল তার শেখার ইচ্ছে।

বিস্তারিত আসছে.এই সময় লতার আলাপ হয় সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের সাথে। বহু বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে লতা নিজেই বলেছেন, গুলাম হায়দারই ছিলেন তাঁর আসল পথপ্রদর্শক। লতার প্রতিভাকে সঠিক চিনেছিলেন তিনি। সেটা ১৯৪৮ সাল। শশধর মুখার্জি তাঁর নতুন ছবির জন্য অচেনা কণ্ঠ খুঁজছেন। গুলাম হায়দার লতার নাম প্রস্তাব করলে বাতিল করে দেন শশধর মুখার্জি। তাঁর মনে হয়েছিলো, নায়িকার তুলনায় লতা’র কণ্ঠ পাতলা। গুলাম হায়দারও ছাড়ার পাত্র নন। ‘মজবুর’ নামের একটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করছিলেন তিনি। সেই ছবিতেই “দিল মেরা তোড়া” গানটি দিয়ে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখলেন লতা মঙ্গেশকর। প্রথম গানই প্রবল হিট করে।
শুরুর দিকে লতার গায়কিতে সিনিয়র গায়িকা নূরজাহানের প্রভাব থাকলেও, ক্রমশ সেসব কাটিয়ে ওঠেন তিনি। মারাঠি উচ্চারণের প্রভাব কাটিয়ে ঠিকঠাক হিন্দি আর উর্দু শেখাও জন্য শিক্ষকও নিয়োগ করেন লতা। এতটাই তীব্র ছিল তার শেখার ইচ্ছে।

আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লতাকে। তাঁর কণ্ঠে তৈরি হয়েছে একের পর এক কালজয়ী গান। ১৯৪৯ সালে মহল ছবিতে “আয়েগা আনেওয়ালা”র মতো গান খ্যাতির শিখরে তুলে দেয় সদ্য তরুণী লতাকে।


কাজের সুযোগ আসছিল হু হু করে। অনিল বিশ্বাস, শঙ্কর জয়কিশেন, নওশাদ আলি, এস ডি বর্মণ, হেমন্ত কুমার, সি রামচন্দ্র, সলীল চৌধুরী, খৈয়াম, রবি, সাজ্জাদ হুসেন, রোশান, কল্যাণজি-আনন্দজি, বসন্ত দেশাই, বা মদনমোহনের মতো প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতপরিচালকদের সঙ্গে একের পর এক কাজ চমকে দিচ্ছিল, সমৃদ্ধ করছিল ভারতীয় সিনেমাকে।

বৈজু বাওরা, মাদার ইন্ডিয়া, আহ, শ্রী ৪২০, ‘দেবদাস’-এর মতো অসামান্য সব ছবিতে গান গাওয়ার পর ১৯৫৮ সালে প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান মধুমতী ছবি ‘আজা রে পরদেশি’ গানের জন্য। ১৯৬০ সালে ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিতে গাইলেন সেই অবিস্মরণীয় গান ‘প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যা’… ১৯৬২ সালে ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিতে হেমন্তকুমারের সুরে ‘কহি দীপ জ্বলে কহি দিল’ গানটি তাঁকে আবার এনে দিল ফিল্মফেয়ার। ১৯৬৩ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো’ শুনে কাঁদল সারা দেশ। চোখে জল এল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর।

দুবেণি ঝোলানো কিশোরী গায়িকা থেকে সারা দেশের সুরসম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠার জার্নিটা নেহাত কম লম্বা নয়। নব্বই বছর বয়সে পৌঁছে তাঁর প্রাপ্তির ভাঁড়ারে তিনটি জাতীয় পুরস্কার, ১৫টি বিএফজেএ পুরস্কার, ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে সহ অজস্র স্বীকৃতি।
২০০১ সালে প্রৌঢ় বয়সে পেলেন দেশের সেরা সম্মান ‘ভারতরত্ন’। তারপর ২০০৭ সালে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ নাগরিক সম্মান লিজিওন অফ অনার।

দীর্ঘ জীবন, অসামান্য সাঙ্গীতিক মেধা, অনন্য কণ্ঠ- আজও প্লে-ব্যাকের জগতে লতার সমকক্ষ কেউ নেই। হবেনও না। মৃদুভাষী, শান্ত, বিনয়ী, কিন্তু প্রকৃতই সম্রাজ্ঞী ছিলেন তিনি। ২০২২, ৬ ফেব্রুয়ারি, সঙ্গীতের সরস্বতী। পঞ্চমীর রাত পোহাতেই দেশ হারাল সঙ্গীত সরস্বতীকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here