“মা” ….

অশোক মজুমদার

‘মা’ মানে মমতা, নিরাপত্তা, এক অমোঘ নিশ্চয়তা, এক বুক ভালোবাসা। রক্তের স্রোতে স্নেহের ফল্গু ‘মা’। এ এমন সম্পর্ক যাঁকে ছাড়া জীবনের অপূর্ণতা কখনো পূর্ন হয়না।

আজ একটি মেয়ের কথা আপনাদের বলবো। যে জন্মের তেরো দিনের মাথায় তার মাকে হারায়। বড়ো হওয়া মামারবাড়িতে। তারপর মাসি, মামা, বাবা, জেঠা, জেঠিমা, গ্রামের মানুষ এদের কাছেই তার মায়ের গল্প শোনা।

ঠিক শোনা নয়। আত্মস্থ করা। মেয়েটি তার মনের সুতোয় একটু একটু করে শোনা মায়ের কথা যে যা বলতো গেঁথে রাখতো। ওই ছেঁড়া ছেঁড়া কথায় খুঁজতে থাকতো মাকে। সময়ের হাতে হাত রেখে মেধাবী মেয়েটি বড়ো হয়েছে। চাকরি পেয়েছে। বিয়ে করেছে। একদিন নিজেও মা হয়েছে। কিন্তু তার সেই তেরোদিনের মাকে খোঁজা থামে নি। তা রয়ে গেছিলো নানা গল্পের মতো।

এখন জীবনের মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়ে মেয়েটি হটাৎ একদিন আবিস্কার করে, আরে মায়ের সাথে অবচেতনে চলতে চলতে মনের স্লেটে তো অনেক লেখা জমে উঠেছে। একদিন তাই সে ঠিক করলো টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে কাগজের পাতায় সাজিয়ে রাখবে। সেই মাকে নিয়েই মেয়েটির লেখা বই “আমার মায়ের শ্বশুরবাড়ি”।

কখনো মায়ের স্নেহের ওম না পাওয়া মেয়েটি সারাজীবন ধরে একটু একটু শোনা মায়ের গল্প লিখতে তিনটে খন্ড লেগেছে। সেই বইয়েরই প্রথম খন্ডটি মেয়েটি আমাকে আজ পড়তে দিল। আশ্চর্যের বিষয় যে আজ রাত পোহালেই মেয়েটির জন্মদিন।

যে মাকে কোনদিন চোখেই দেখেনি, বইটি পড়লে তা মনে হবে না। যেন মনে হবে প্রত্যেকটা ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটেছে। সন্তানের কাছে মায়ের গল্প আমাদের সবার জীবনেই আছে। কিন্তু এই মেয়েটি তো তার মাকে দেখেনি। যতটুকু জানি বাগনানের কাছে বাইনান গ্রামে এক কমিউনিস্ট পরিবারে মেয়েটির জন্ম। যখন কমিউনিস্ট করাটাই অপরাধ ছিলো। এতো কট্টর কমিউনিস্ট ছিলো এই পরিবার যে নিজের দাদাকেও কংগ্রেস করার অপরাধে মেরে ফেলেন।
গাঙ্গুলি পরিবার কিন্তু একসাথেই থাকতেন। আনন্দনিকেতন স্কুল মেয়েটির জ্যাঠা অমল গাঙ্গুলির নিজের হাতে তৈরি। সে এক ইতিহাস।

বইটিতে মেয়েটি নিজে কোথাও নেই। সব জায়গায় শুধু তার মা। সারাক্ষণ মায়ের শ্বশুরবাড়ি, ভাসুরপো, বড়ভাসুর ,বৌভাত, ফুলশয্যা, শ্বশুরবাড়ির পথের গ্রাম, ননদ, স্বামী, গ্রামের প্রতিবেশী এদের কথা এমন ভাবে আছে যেন মেয়েটি এগুলো নিজের চোখে দেখেছে। সব মিলিয়ে মিশিয়ে মাকে নিয়ে এক অনুভূতির গল্প। মা নেই তবু সে ছোট থেকেই মা এর হাত ধরেই আছে। যেন মাকে দেখতে পায় সে। একা একা কথা বলে।

মেডিক্যাল কলেজ ইডেন ওয়ার্ড এ জন্মের তেরো দিনের মাথায় মাকে হারায়। এক রহস্যজনক ভাবে লিফট এর কাছে মা এর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। সেই সময় সব কাগজে প্রথম পাতায় খবর বেরোয়। এমনকি তদন্ত কমিশন হয়। সে কারণ আজও অধরা। অবিবাহিত মাসী মামা এদের কাছেই মেয়েটি বড় হয়। গ্রামে বাবা জ্যাঠা তখন পুলিশের তাড়া খেয়ে গ্রাম ছাড়া। সেসব কাহিনীই মেয়েটি বই বন্দি করে রেখেছে।

আমার নিজের মা এখনও বেঁচে। ৮৬ বছর বয়স। নানা রোগের উপদ্রব শরীরে। জানিনা আর কতদিন মা ডাকার সৌভাগ্য পাবো। শেষ দিনগুলো মা কি ভাবে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে তা নিজের চোখে দেখছি। আমার অনেক অসুবিধা কষ্টের ভিতরে শেষের দিনগুলো মায়ের পাশে থাকাটাই তো আমার পরম পাওয়া। কিন্তু এই মেয়েটিতো তার মাকে দেখেইনি কোনোদিন!! তাহলে এরকম একটা স্বপ্নের জাল বুনলো কি করে? মা শব্দটাই বোধয় যথেষ্ট সন্তানের ক্ষেত্রে।

অনেকদিন আগে এক ইঞ্চির একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখিয়ে মেয়েটি আমায় বলেছিল, “ছবিটা বড় করে দিতে পারবে?” যথাসাধ্য চেষ্টায় ফটোগ্রাফি ও পেইন্টিং এর মাধ্যমে ছবিটা করে দিয়েছিলাম। পরে মেয়েটি জানিয়েছিল,”এটাই আমার মা। মনীষা গাঙ্গুলী”।

কখনো সখনো সময় পেলে মেয়েটি তার মায়ের গল্প বলতো। সিনেমা দেখে এসে সুচিত্রা সেন এর ডায়লগ বলা, পুকুর পাড়ে বাসন মাজতে মাজতে গান করা। ঘরের কাজের ভিতরে রেডিওতে গান যাত্রা শোনা। গ্রামের আল দিয়ে সিনেমা আর্টিস্টদের মত হাটা আরো নানা ধরনের গল্প। আমার বেশ লাগতো সেইসব গল্প শুনতে। কিন্তু মেয়েটিকে কোনোদিন দেখিনি মায়ের কথা বলতে গিয়ে কাঁদা তো দূর চোখ দুটোও চিক চিক করে উঠেছে। মায়ের প্রতি তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখিনি কখনো।

আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না বইটি পড়ে আমার ঠিক কেমন মনে হচ্ছে। একটি মেয়ে তার মাকে কয়েকজনের স্মৃতিচারণায় মনেতে বাঁধিয়েছে। মনের ভাবনাগুলো থেকেই “আমার মায়ের শ্বশুরবাড়ি” একটা গোটা বই হয়ে গেছে। জানিনা বিশ্ব সাহিত্যে না দেখা মানুষের সাজানো স্মৃতিকথা আদৌ আছে কিনা!! আমি তো কখনো পড়িনি বা শুনিনি।

আগামীকাল মেয়েটির জন্মদিন। আমি অভিভূত তার এই কাহিনী পড়ে। নিজের জন্মদিনে মায়ের নবজন্মের মত এই বইটি ওর জীবনের অন্যতম উপহার হয়ে থাকলো। নিজেকেই নিজের দেওয়া সেরা উপহার। না দেখা মাকেও। এই স্মৃতির চাদরে মেয়েটি ভালো থাকুক। ওর মা এভাবেই বেঁচে থাকুক ওর মধ্যে আজীবন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here