কবিগুরুর কাছে জিশু ছিলেন ‘মানবপুত্র’, ‘কল্যাণের দূত’:

দেশের সময়, বনগাঁ:: উত্তরে শিরশিরে হাওয়া শহরের পাঁজরে কাঁপুনি ধরিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। শেষরাতে সীমান্ত শহর বনগাঁ ভিজে যাচ্ছে শিশিরে৷কমলালেবু, নতুন নলেন গুড়ের গন্ধ আর শিশুদের কানঢাকা লাল রঙের টুপি মনে করিয়ে দিচ্ছে, করোনা থাকুক আর যাক, আবার এসে গেল বড়দিন।

বড়দিন সকলের। ২৫ ডিসেম্বর জিশুর জন্মদিন কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, বার্ষিক খ্রিস্টীয় উৎসবের এই দিনটি খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান নির্বিশেষে সবার প্রিয় উৎসবের দিন। এই দিনটি থেকেই খ্রিস্টধর্মের ১২ দিন ব্যাপী ক্রিসমাসটাইড অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ। উপহার দেওয়া-নেওয়া, ক্রিসমাস ক্যারলের ঝঙ্কার, গির্জায় গির্জায় বিশেষ উপাসনা, গ্রিটিংস কার্ড বিনিময়, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, জিশুর জন্মদৃশ্য, যশোর রোডের দুধারে আলোকসজ্জা, রকমারি ভোজের আয়োজন—সব মিলিয়ে বড়দিন সত্যিই বড় দিন।এক কথায় বনগাঁর বাটামোড় থেকে ছয়ঘরিয়া গীর্জা পর্যন্ত প্রায় দু’কিলো মিটার রাস্তা এদিন দেখলে মনে হয় যেন দ্বিতীয়পার্ক স্ট্রিট।

হাজার হাজার মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন। ছয়ঘরিয়ার বড় গীর্জার পাশাপাশি এবার আরও রঙিন শিমুলতলার মঙ্গলদ্বীপ , এবছর বনগাঁ পুরসভার পুরপ্রশাসক শঙ্কর আঢ্যর উদ্যোগে আধুনিক আলোক সজ্জায় সেজে উঠেছে গোটা মঙ্গলদ্বীপ এলাকা বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বড়দিনের উৎসবে মেতেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷এই ঐতিহ্যমণ্ডিত চার্চ মঙ্গলদ্বীপে ক্রিসমাস মিডনাইটে অংশ নিয়ে প্রার্থনায় গলা মেলান শতাধিক মানুষ।

বাঙালির বড়দিন মানেই শীত-শীত আমেজে সপরিবার কেক না খেলে বড়দিনের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না। দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখার মতোই এবার বনগাঁর বড়দিনের আলোকসজ্জা দেখতে ভিড় করছেন অনেকেই। বড়দিনের সাবেকি আমেজটা আজও রয়ে গেছে বনগাঁ শহরের ছয়ঘরিয়া এবং শিমুলতলা -পাড়ায় । 

শীতের পাতা ঝরার দিনে রোমে চিরহরিৎ বৃক্ষের ডাল দিয়ে ঘর সাজানোর প্রথা ছিল। কেউ কেউ একে পৌত্তলিকদের বৃক্ষপূজার রূপান্তর বলেও মনে করেন। আইভি লতার পানপাতার মতো হৃদয় আকৃতির পাতা ও লাল বেরি দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। ওই সবুজ পাতা জিশুর পুনরুত্থানের প্রতীক আর বেরিগুলো ক্রুশবিদ্ধ জিশুর রক্তবিন্দুর প্রতীক। সেই প্রথা মেনে এখানেও প্রায় বাড়ি সাজিয়েছেন স্থানীয়রা।

বড়দিনের আর একটি অপরিহার্য অঙ্গ ক্রিসমাস ক্যারল। আসলে ক্যারল বলে পরিচিত গানগুলি ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকসঙ্গীত। পরবর্তী কালে গির্জায় ক্যারল গাওয়ার সূচনা হয়। প্রাচীনতম ক্রিসমাস ক্যারল রচিত হয়েছিল রোমে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। ত্রয়োদশ শতকে ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইটালিতে আঞ্চলিক ভাষায় জনপ্রিয় ক্রিসমাস সঙ্গীতের প্রথা গড়ে ওঠে।যা এখন কান পাতলেই শোনা যায় বনগাঁর শিমুলতলায়৷

কবিগুরুর কাছে জিশু ছিলেন ‘মানবপুত্র’, ‘কল্যাণের দূত’। একটি প্রবন্ধে কবি বলেছেন, ‘‘আজ পরিতাপ করার দিন, আনন্দ করবার নয়।… বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করবার দিন, নিজেকে নম্র করবার দিন।’’ খ্রিস্টান ধর্মযাজক অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরান্ডার প্রভাব কবির জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে তিনি জিশুর জন্মোৎসব পালনকে শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবের অঙ্গীভূত করেন। তিন দিনের আনন্দময় পৌষ-উৎসবের সমাপ্তি-দিবস খ্রিস্ট-উৎসব। এই উপাসনায় মহামানব জিশুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সকলে সমবেত হন। মোমের আলোয় মুখরিত হয়ে ওঠে ‘ক্রিসমাস ক্যারল’, গাওয়া হয় কবির লেখা ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে’, উচ্চারিত হয় উপনিষদের মন্ত্র, কবির লেখা এবং বাইবেলের অংশবিশেষ থেকে পাঠ করা হয়৷

স্বামীজি আমেরিকায় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, জিশু এবং কৃষ্ণের জীবনের অনেক সাদৃশ্য। নিউ টেস্টামেন্ট এবং গীতার উপদেশগুলিতেও অনেক মিল— ‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, তখনই আমি অবতীর্ণ হই’, …যখনই দেখিবে কোন মহাত্মা মানবজাতির উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট, জানিবে আমার আবির্ভাব হইয়াছে এবং তাঁহার পূজা করিবে। … ভগবান্‌ যদি মানবীয় রূপ পরিগ্রহ করিয়া আমাদের নিকট উপস্থিত হন, কেবল তখনই আমরা তাঁহাকে চিনিতে পারি।

বনগাঁর বড়দিন এখন যত না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি করে এক অসাম্প্রদায়িক মিলনদিন। মুসলমান বুড়ো ক্রিসমাস ট্রি বিক্রি করছে হিন্দুছেলেকে— এমন দৃশ্য বনগাঁর পরতে পরতে প্রাণের মতো মিশে আছে। অনুশোচনায় আত্মশুদ্ধি, আত্মসমীক্ষা ও নম্র নিরহঙ্কার— এই সনাতন হিন্দু ভাবধারার সঙ্গে খ্রিস্টীয় জীবনবোধের মিল আছে। যাকে কেন্দ্র করে এই বড়দিন, তিনি মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার ক্রুশ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, বলেছিলেন—“তোমরাই জগতের আলো… তোমার অন্তর্জ্যোতি প্রজ্বলিত কর, যাতে অপরে তোমার সৎ কর্মগুলি দেখতে পায় ও এইভাবে তোমার স্বর্গস্থ পিতাকে গৌরবান্বিত কর।” (ম্যাথিউ ৫, ১৪-১৬)। উৎসবের জোয়ারে ভেসে গিয়ে তাঁর দেখানো রাস্তা যেন আমরা ভুলে না যাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here