দেশের সময়ওয়েবডেস্কঃ ফুল ফুটেছে রাফির কবরে, ফেনীর আদালত থাকবে সারা দেশের মানুষের নজরে’। সেই সঙ্গে একটা ছবি। যে ছবিতে একটি কবরের উপরে ফুটে রয়েছে লাল ও সাদা গোলাপ।

বুধবার থেকেই এমন স্টেটাস চোখে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষদের ফেসবুকের পাতায়। বৃহস্পতিবার নুসরত-মামলার রায় ঘোষণা হয় ঢাকায়। মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল দেশ। অধ্যক্ষের কুপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠায় ১৯ বছরের নুসরাতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-সহ মোট ২১ জনকে। বৃহস্পতিবার সেই মামলার রায় ঘোষণা ছিল।

রায়ের দিনেই নুসরাতের কবরে বাঁশের বেড়ায় ফুটন্ত সাদা ও লাল গোলাপের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে। এই ছবি পোস্ট করেই নুসরাতের ন্যায়বিচারের দাবিতে গর্জে উঠেছে ছোট্ট দেশটি। গর্জন বৃথা যায়নি।বৃহস্পতিবার সেই মামলার রায়ে অধ্যক্ষ এস এম সিরাজদৌল্লা-সহ ১৬ জনকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। স্বস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ।

নুসরাত জাহান রাফি খুনের পরে সব আসামি গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসী-সহ সচেতন মানুষের সমবেত স্লোগান ছিল: ‘আমার বোন কবরে, খুনি কেন বাইরে’। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছিল শুধু নুসরাতের পরিবার নয়, সারা দেশের মানুষ।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর শুনানি ও পর্যবেক্ষণ শেষে ২৪ অক্টোবর রায়ের দিন ধার্য করেন বিচারক মামুনুর রশিদ। বিচারকাজ শুরুর ৬১তম দিনে মামলাটি চূড়ান্ত রায়ের কার্যক্রম শেষ করা হয়। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি আরও জোরদার হয় নুসরাতের পরিবার ও আইনজীবীদের তরফে। অবশেষে মিলল সুবিচার।

রায়দানকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরেই উত্তপ্ত ছিল বাংলাদেশের ফেনি ও সোনাগাজির সদর উপজেলা। এ দিন সকাল থেকেই আদালত চত্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র‍্যাফ। রাস্তার মোড়ে বসানো হয় পুলিশ পিকেট। নুসরাতের বাড়িতেও পুলিশি প্রহরা বসানো হয়।

সরকার পক্ষের আইনজীবী হাফিজ আহমেদ বলেছেন, “আজকের রায় ঐতিহাসিক। বাংলাদেশ প্রমাণ করে দিয়েছে এই ধরনের অপরাধের কোনও ক্ষমা হয় না। অপরাধীরা তাদের যোগ্য শাস্তি পেয়েছে।”

বাংলাদেশের ফেনির সোনাগাজিতে মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ সিরাজদৌল্লা ও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন তিনি। ছাত্রী দাবি করেছিলেন, অধ্যক্ষ দিনের পর দিন তাঁর শ্লীলতাহানি করেছেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এই গ্রেফতারির পরেই মাদ্রাসায় অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় নুসরাতকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। হাত–পা বেঁধে, তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ৮০% পোড়া নিয়ে, গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সে সময় মেলেনি। ঘটনার পাঁচ দিন পরেই ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ন’টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।

পুলিশ জানায়, মৃত্যুর আগে জবানবন্দি দিয়ে সব জানিয়ে গিয়েছিলেন নুসরত। অধ্যক্ষকেই দায়ী করেছিলেন তিনি। তদন্তে নেমে মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা পুলিশের অপরাধ দমন শাখা। ধৃতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামি লিগের সভাপতি রুহুল আমীন এবং আওয়ামি লিগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম। গত ২৮ মে ধৃতদের মধ্যে ১৬ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেনির আদালত। মে মাসের শেষে এই মামলা স্থানান্তরিত করা হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।

এই দীর্ঘ লড়াই ও যন্ত্রণার ক্ষতে প্রলেপ পড়ার দিন ছিল গতকাল। নুসরাত ফিরবেন না, কিন্তু তাঁর খুনিদের চরম শাস্তি ঘোষিত হল। সেই সুখবরেই যেন গোলাপে ভরেছিল নুসরাতের কবর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here