পার্থ সারথি নন্দী,দেশেরসময়: বসন্ত এখনও রয়েছে। আবহাওয়াটাও বসন্তের মতোই। উত্তর২৪পরগনার বনগাঁ মহকুমার পারমাদন অভয়ারণ্যে তাই এখন ফুলের মেলা। গাছে নির্দিষ্ট সময় জল দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কয়েক জনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া মানুষের প্রবেশ নিষেধ। স্বভাবতই বেশ কিছু দিন কোনও কোলাহল না থাকায় এখন সেখানে শুধুই পাখির ডাক। বেরিয়ে পড়েছে অন্য প্রাণীও।

ডান্সিং ডল ট্রির মতো বিভিন্ন গাছ এখন ফুলে ভরা। আর দিন পনেরো পরে এই সব গাছের ফুল শুকিয়ে ঝরে যাবে। শেষ হয়ে যাবে ফুল ফোটার সময়। ভেনিজুয়েলান রোজ বা সহজ কথায় মাউন্টেন রোজেরও এখন ফুল ফোটার সময়। ফুল তাতেও ফুটছে। আগামী এক সপ্তাহ এই পারমাদন সংলগ্ন গ্রাম জুড়ে থাকবে ফুলের সমারোহ। তবে তা দেখার লোক এখন নেই।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে দেশজোড়া লকডাউন চলছে। ১৮ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অভয়ারণ্যের দরজাও। তাই সেখানে প্রকৃতি এখন ধরেছে নিজের রূপ।

অভয়ারণ্যের এক আধিকারিক জানান, “যাঁরা ফুলে ভর্তি গাছ দেখতে পছন্দ করেন এই সময় তাঁরা এই সময় আসেন। অনেকে ছবিও তোলেন। তবে এবছর ঢোকা নিষিদ্ধ। বেশিরভাগ গাছ এখন ফুলে ভরা। পলাশ গাছ, ইয়েলো ফ্লেম বায়ান্ট, শিমুল প্রভৃতি গাছে এখনও ফুল রয়েছে যদিও এই সব গাছে ফুল ফোটার সময় প্রায় শেষ।

ছবিটি তুলেছেন অশেষ বিক্রম দস্তিদার।

এখন ফুটলেও দেখার কেউ নেই। এই সুযোগে পাখি ও অন্য প্রাণীদের বেশি দেখা যাচ্ছে।” দু’দিন আগে বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ এসেছিলেন হরিণ এবং মায়ুরদের জন্য খাবার দিতে৷ বাইরের মানুষ বলতে ওই দু’ চারজন। গোটা জঙ্গলটাই এখন পাখিদের দখলে,ওরা বেশ ভাল আছে ৷কেউ বিরক্ত করছে না ওদেরকে যারা শখের ফোটোগ্রাফার তারাও আসছে না,ফলে পাখিদের এখন খুব আনন্দ, ভোর থেকে সন্ধ্যা এমন কি রাতেও ওরা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। পাখিদের এই ভাল থাকা দেখে আমাদেরও খুব ভাল লাগছে৷

বনগাঁ মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অশেষ বিক্রম দস্তিদার বলেন, এখন নির্জন গোটা বনগাঁ মহকুমার শহর,গ্রামের গাছে গাছে সর্বত্রই চরে বেড়াচ্ছে নেউল। এখানে দু’টি প্রজাতির নেউল রয়েছে। স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি ময়না। তাদের ডাক মধুর। ডাহুক, জলপিপি, মুর হেন ,রাত চরা, লক্ষী পেঁচা প্রভৃতি পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ছবি অশেষবিক্রম দস্তিদার৷

অন্য দেশের পাখিরা এখন বেরিয়ে পড়েছে। এখানে থাকা সুবিশাল গাছে এখন নতুন পাতা এসেছে। সব মিলিয়ে এখন নানা রংয়ের ফুল -পাখির সমারোহ। তবে তা দেখতে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। আর আমি চাই পাখিরা একটু প্রাণ খুলে বাঁচুক,ওদের কিচির মিচিড় শব্দে ফের মানুষ সভ্যতার ঘুম ভাঙুক।

কলকাতা থেকে দূরত্ব মাত্র ৯৭ কিলোমিটার। কাজেই এই লকডাউন উঠে গেলে বেড়ানোর আদর্শ জায়গাগুলোর একটা হতেই পারে পারমাদন:
পারমাদন বিখ্যাত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত অভয়ারণ্যের জন্য। জায়গাটা একেবারে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। ইছামতী নদীর গা ঘেঁষে শিমুল, অর্জুন, শিশু, শিরীষ গাছের ভিড়ে হারিয়ে যেতে হলে আপনাকে আসতেই হবে পারমাদনের জঙ্গলে।

ছবি -পার্থ সারথি নন্দী৷

অসংখ্য বাঁদর, ময়ূর আর খরগোশের আনাগোনা এই অভয়ারণ্যে। আর রয়েছে অজস্র পাখি। শঙ্খচিল, নীলকণ্ঠ, ফুলটুসির মতো পাখি স্পট করতে গেলে রেডি রাখুন ভাল লেন্স-সমেত ক্যামেরা।

ছবি- অশেষবিক্রম দস্তিদার।
গাছ আর পাখি ছাড়া আর যেটা খুব বেশি করে চোখে পড়বে, তা হল হরিণ। প্রায় ২৫০টা হরিণ আছে এই জঙ্গলে। এই জায়গার খুব কাছেই থাকতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বনগাঁ আর ইছামতীকে নিয়ে যেমন অনেক লেখা লিখেছেন সাহিত্যিক, তেমনই সম্ভবত এই জায়গা নিয়েই ‘আরণ্যক’এ লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ, ‘‘শুইয়া আছি, হঠাৎ কীসের পায়ের শব্দে উঠিয়া বসিয়া শিয়রের দিকে চাহিয়া দেখি ঝোপের নিভৃততর দুর্গমতম অঞ্চলে নিবিড় লতাপাতার জড়াজড়ির মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে একটা হরিণ। ভালো করিয়া চাহিয়া দেখি বড় হরিণ নয়, হরিণ শাবক। সে আমায় দেখিতে পাইয়া অবোধ বিস্ময়ে বড় বড় চোখে আমার দিকে চাহিয়া আছে, ভাবিতেছে এ আবার কোন অদ্ভুত জীব।’’

ইছামতীর ধারে ৬৮ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে পুরো অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। ভিতরে চিলড্রেন্‌স পার্ক ছাড়াও রয়েছে ছোট্ট একটা চিড়িয়াখানা আর বন দফতরের ট্যুরিস্ট লজ। ১৯৬৪ সালে ১৪টি চিতল হরিণ এই অরণ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই অভয়ারণ্যের চেহারা নেয় পারমাদন।


১৯৯৫ সালে বিভূতিভূষণের নামে নামাঙ্কিত করা হয় এই অভয়ারণ্যকে। ভিতরে ঢোকার জন্য এবং যানবাহনের জন্য আলাদা প্রবেশমূল্য রয়েছে। ভিতরে বনভোজনও করা যায় অনুমতিসাপেক্ষে। এখান থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত খুব কাছেই। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকেও। বিভূতিভূষণের বসত বাড়িও কাছেই ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here