দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ তাঁর একুশের বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বিধানসভা ভোটের আগে সংগঠনে বড় রকমের ঝাঁকুনি দিতে চাইছেন দিদি। বৃহস্পতিবার সেই কাজ সম্পূর্ণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন করে ঢেলে সাজা হল। দলের সাংগঠনিক গঠন কাঠামো ও কাজের ধরনও বদলে গেল অনেকটাই। তবে তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই ঝাঁকুনি সত্ত্বেও কেউই বাদ পড়েননি। ভোটের আগে সবাইকে কোথাও না কোথাও পুনর্বাসন বা পদ দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। তার ফলে কমিটির আড়ে বহরে বেড়ে এতই বড় হয়েছে যা দুই দশক পুরনো দলে সম্ভবত এই প্রথম।

নতুন কমিটিতে রাজ্য সভাপতি ও মহা সচিব
পদে বদল হয়নি। সুব্রত বক্সী এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায় বহালতবিয়তেই রয়েছেন। কিন্তু সহ সভাপতির তালিকা লম্বা হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে ১৭ জনকে। তাঁদের মধ্যে নতুন মুখ হলেন, রবি ঘোষ, শঙ্কর সিংহ, তাপস রায় প্রমুখ। সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে ৮ জনকে। ফিরহাদ হাকিম, শুভেন্দু অধিকারী, অরূপ বিশ্বাসদের সঙ্গে সেই তালিকায় ঠাঁই হয়েছে বাঁকুড়ার আদিবাসী নেত্রী জ্যোৎস্না মান্ডির। সেই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ হিসাবে আনা হয়েছে বিবেক গুপ্ত, শীলভদ্র দত্তকে। এ ছাড়া সচিব করা হয়েছে ১১ জনকে। রাজ্য কোর কমিটিতে রাখা হয়েছে ৫৮ জনকে। রাজ্য সমন্বয় কমিটিতে রয়েছেন ২১ জন।

একুশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে দলে রদবদলের ইঙ্গিত দিতে গিয়ে দিদি বলেছিলেন, “আমি চিরদিনই থাকব না। কিন্তু তৃণমূলের কর্মীদের আমি তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই।…আমার ছাত্র যৌবন এগিয়ে আসুন। স্বপ্নের ভোর নিয়ে আসুন।”

বিষ্যুদবার কমিটি ঘোষণার পর দেখা গেল, সে পথেই হেঁটেছেন তিনি। প্রবীণদের সরিয়ে সংগঠনের বড় দায়িত্বে নবীনদের নিয়ে এসেছেন। একুশে বিধানসভা ভোটের আগে যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে গোটা জেলা ঘুরে বেড়াতে পারবেন। তাঁরা কারা? লক্ষ্মীরতন শুক্ল, দুলাল মুর্মু, মহুয়া মৈত্র, পার্থপ্রতিম রায়, শ্যামল সাঁতরা, গুরুপদ টুডু প্রমুখ।

হাওড়়ার জেলা (শহর) সভাপতি পদ থেকে সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায়কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর জায়গায় আনা হয়েছে উত্তর হাওড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্লকে। লোকসভা ভোটের পর মহুয়া মৈত্রকে কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা। এবার তাঁকেই গোটা নদিয়া জেলার সভাপতি করা হল। সেই পদে আগে ছিলেন গৌরীশঙ্কর দত্ত। গোষ্ঠী কোন্দলে বিদীর্ণ কোচবিহার জেলাসভাপতি পদে আনা হল প্রাক্তন সাংসদ পার্থপ্রতিম রায়কে। বিনয়কৃষ্ণ বর্মনকে সরিয়ে তাঁর জায়গা আনা হল অপেক্ষাকৃত তরুণ পার্থকে।

জঙ্গলমহলের তিন জেলা বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম এবং পুরুলিয়াতেও সভাপতি বদল করেছেন দিদি। শুভাশিস বটব্যালের জায়গায় বাঁকুড়ার সভাপতি করা হয়েছে রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরাকে। পুরুলিয়ায় শান্তিরাম মাহাতোর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন গুরুপদ টুডু। মধ্যবয়সী গুরুপদ রাজ্যের মন্ত্রী সন্ধ্যারানি টুডুর স্বামী। ঝাড়গ্রামের সভাপতি পদ থেকে বীরবাহা সোরেনকে সরিয়ে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুলাল মুর্মুকে। বীরবাহাকে ঝাড়গ্রামের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

উত্তরবঙ্গের কেবল একটি জেলাতেই সভাপতি বদল করেছেন দিদি। দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সভাপতি পদ থেকে অর্পিতা ঘোষকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর বদলে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গৌতম দাসকে। প্রসঙ্গত, উনিশের ভোটে বালুরঘাটে তৃণমূল হেরেছিল। প্রার্থী ছিলেন ১৪-র ভোটে জেতা অর্পিতা। সেই সময়ে অভিযোগ উঠেছিল তৎকালীন জেলা সভাপতি বিপ্লব মৈত্র প্রার্থী হতে না পেরেই অন্তর্ঘাত করেছেন। বিপ্লববাবুকে সরিয়ে অরপিতাকে জেলা সভাপতি করেছিলেন মমতা। পরে যদিও বিপ্লব বিজেপিতে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যে ফের রদবদল হল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়।

দেশের সময় আগেই লিখেছিল যে তৃণমূলের জেলা সংগঠনে এ বার নতুন পদ তৈরি করতে চলেছেন দিদি। সে পদের পোশাকি নাম – ‘চেয়ারম্যান।’ যেমন উত্তর কলকাতার চেয়ারম্যান করা হয়েছে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, উত্তর ২৪ পরগনার চেয়ারম্যান পদে আনা হয়েছে পাণিহাটির বিধায়ক তথা বিধানসভার মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষকে, দার্জিলিং জেলার চেয়ারম্যান করা হয়েছে পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবকে।

দলের অনেকের মতে অবশ্য, নবগঠিত ‘চেয়ারম্যান’ পদটি হল বৃদ্ধাশ্রম। ভোটের আগে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও একটা আলঙ্কারিক পদ দিয়ে রাখা হল। আসল ক্ষমতা থাকবে জেলা সভাপতির হাতেই। এই পদক্ষেপকে ভারসাম্য রাখার চেষ্টাও বলা যেতে পারে। বস্তুত এই ভারসাম্য রাখতে জেলার অনেক নেতা বা মন্ত্রীকে রাজ্য কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কিন্তু সেই পদেরও কতটা গুরুত্ব রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যেমন ডোমজুড়ের বিধায়ক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্য কমিটির সভাপতি করা হয়েছে।

স্টিয়ারিং কমিটি: এ ছাড়াও এদিন তৃণমূলের যুব সংগঠনেও রদবদল ঘটিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে সংগঠনে নতুন স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে সাত জনকে সদস্য করা হয়েছে,- সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, শুভেন্দু অধিকারী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শান্তা ছেত্রি।

সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, অরূপ বিশ্বাস, ফিরাদ হাকিমরা যে ভাবে বিভিন্ন জেলার পর্যবেক্ষক হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন, তা আর রইল না। সেই দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হল তাঁদের। পরিবর্তে একটি রাজ্য স্তরের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে দেওয়া হল। যে কমিটিতে রইলেন সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, শুভেন্দু অধিকারী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গৌতম দেব। এই কমিটিতে অরূপ বিশ্বাসের নাম নেই।

দিদির এই পদক্ষেপকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। এই সাংগঠনিক পদক্ষেপকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখাও শুরু করেছেন দলের নেতারা। ঘরোয়া আলোচনায় তৃণমূলের এক রাজ্য নেতা এদিন বলেন, এর অর্থ পরিষ্কার। একুশের ভোটের টিকিট দেওয়ার বিষয়টি সরাসরি কালীঘাটের হাতে রইল। অর্থাৎ, দিদি অভিষেক এবং টিম পিকে-র হাতেই ব্যাপারটা রইল। 

আগে পর্যবেক্ষকরা প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করতেন। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশ কিছু আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে দিদি তাঁদের পরামর্শ বা আপত্তি মেনে নিতেন। কিন্তু এখন জেলা স্তরে কোনও পর্যবেক্ষক না থাকায় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সেন্ট্রালাইজড হয়ে গেল। জেলা সভাপতি তথা জেলার নেতৃত্ব ও হাইকমান্ডের মাঝে কোনও সেতু রইল না।

আবার অনেকের মতে, বিভিন্ন জেলা সংগঠনের উপর শুভেন্দু অধিকারীর প্রভাব এর মাধ্যমে কমানো হল। লোকসভা ভোটে জেলা পর্যবেক্ষকদের মধ্যে অন্যতম সফল ছিলেন তিনি। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের পর্যবেক্ষক ছিলেন তিনি। তা ছাড়া তাঁর নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

দিদি ঘনিষ্ঠ কিছু নেতার মতে অবশ্য ব্যাপারটা এভাবে দেখা ঠিক হবে না। লোকসভা ভোটের পর বাঁকুড়া জেলার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সুব্রত বক্সীও যথাক্রমে ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের পর্যবেক্ষক পদ থেকে অব্যাহতি চাইছিলেন। অন্যদিকে অরূপ বিশ্বাস যে কার্যকরী ভাবে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব সামলাতে পারছিলেন না লোকসভা ভোটের সময় থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আর ফিরহাদ হাকিমের জন্য পুর দফতর এবং পুরসভা সামলে হাওড়া ও হুগলির উপর নজর রাখা মুশকিল হচ্ছে। 

সেই কারণেই পর্যবেক্ষক পদ তুলে দেওয়া হয়েছে। ওই নেতাদের কথায়, শুভেন্দু অধিকারী যে সব জেলার পর্যবেক্ষক ছিলেন, সেখানে সাংগঠনিক সমস্যা বিশেষ ছিল না। কিন্তু উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গের বহু জেলায় পর্যবেক্ষকরা গোষ্ঠী কোন্দল থামাতে পারছিলেন না। বরং এই সিস্টেমে কোথাও গোষ্ঠী রাজনীতি বেশিই হচ্ছিল। তাই হয়তো পর্যবেক্ষক পদটাই তুলে দেওয়া হল।

এত বড় কমিটি নিয়ে ইতিমধ্যে শাসক দলে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, এই ধরনের কমিটির বা তার অধিকাংশ সদস্যের সেই অর্থে কোনও এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা নেই। এগুলো অনেকটা স্বান্তনা পুরস্কার কমিটি। বিধানসভা ভোটের আগে কাউকেই একেবারে অখুশি রাখতে চাইছে না দল। তাই নতুন পদ, কমিটি গঠন করে বহু নেতা কর্মীকে পুনর্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here