ট্রাভেলগ: কেদারনাথ, বদ্রীনাথ দর্শন

লিখছেন – দেবন্বিতা চক্রবর্তী,

হিমালয় পর্বতমালার হিমসৌন্দর্য্যে মন্ডিত ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন , আদি অন্তহীন শৈলমালা ও সাধু সন্তদের পূন্যভূমি উত্তরাখন্ডে এবার দেশের সময়ের টিম সফর ।রুদ্র-রুদ্রানীর মিলনস্থল ও লীলাক্ষেত্রে

এবার ট্রাভেলগের সাথে আছেন দেশের সময় টিমের প্রদীপ দে,পার্থ কুন্ডু, গোকুল দে, দিলীপ বিষ্যুই, সড়ক পথে ভ্রমনের উদ্দেশ্যে গাড়িতে সকলকে নিয়ে পরিচিত রাস্তা গুলো হাতের রেখার মতো চিনিয়ে নিয়ে চলল ড্রাইভার কিষান ৷

আর চির পুরাতনের মায়াবী রূপের সাক্ষী হতে গোটা টিম নিয়ে হইহই করে বেড়িয়ে পড়েছেন দেশের সময়ের সম্পাদক ।
রাত ১.৩০ নাগাদ দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশানাল বিমান বন্দরে নামার পর গাড়ি নিয়ে রওনা হওয়া গেল সোজা হরিদ্বারের পথে।পরের দিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রবেশ উত্তরাখন্ডে ৷

হরিদ্বারের শোভার বিশ্লেষণ পরে হবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই দিন ই গোটা টিম চলল কেদারের উদ্দেশ্যে ৷গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা হারকিপৌড়ির বিশাল শিবের মূর্তি যেন দুহাত তুলে আশিষ জানাচ্ছে গোটা বিশ্ব সংসারকে ৷এর পর হৃষিকেশ …..

গঙ্গ্যাং বারি মনোহারী..
মর্ত্যের দিকে ধাবমান গঙ্গাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে এই অধিক লোকারণ্য বিহীন সুমধুর বাতাসে পরিপূর্ণ তীর্থ হৃষিকেষ ৷রাবন বধের প্রায়শ্চিত্য করতে রাম আসেন অনুজসহ এই স্থলে , পরে মহামতি বিদুর ওএখানে দেহত্যাগ করেন । সব মিলিয়ে এই পবিত্র স্থানে অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক ,ধর্মশালা পাওয়া গেল , আর কোনো রকমে তাতেই রাত গুজরান করতে হবে ৷

এই যে হৃষিকেশ এ এক রাত্রি কাটিয়ে তার পর আরও উচুঁতে উঠে কেদার বদ্রী, গঙ্গোত্রী , যমুনত্রী দর্শন এগুলো কিন্তু পৌরানিক যুগের সাধু সন্তদের সময় থেকে চলে আসছে , এবারে সেই নিয়মের বন্ধনে পড়লাম আমরাও ৷কখনও এই দূর্গম পথ চলা হয়ে ওঠে পূণ্যলাভের আশায় কখনও তা নৈসর্গিক শোভার টানে ৷

পরের দিন সকালেই রওনা দেওয়া হল কেদারের পথে৷ আত্মউপলব্দ্ধির প্রধান কেন্দ্রীয় স্থল হিসাবে হিমালয়ের গায়ে এই মসৃন সড়ক এন এইচ ৫৮ আমাদেরপৌঁছে দেবে হিন্দুদের দুই প্রধান তীর্থ ক্ষেত্রে ৷ পথে পড়়বে প্রাচীনতার নানা রকম সাক্ষ্যপ্রমান ৷সাথে অবিরত বহতা খরস্ত্রোতা গঙ্গা ৷

ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে থাকে দেবপ্রয়াগ ,রুদ্রপ্রয়াগ , অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর সংগমস্থল ,দূর থেকে দৃশ্যমান পঞ্চকেদার , গাড়ি ছুটে চলল গুপ্তকাশীর দিকে ৷পঞ্চপান্ডবের দর্শন থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে গুপ্তভাবে ধ্যান করেছিলেন শিব , তাই নাম গুপ্তকাশী ।

অতীতে এখান থেকে হাঁটতে শুরু করতেন কেদার পথযাত্রীরা গোটা দলটাও পথের ক্লান্তি ও পরের দিনে সমস্ত শক্তি অর্জন করে নেওয়ার জন্য আশ্রয় নিল এখানে ৷

পরের দিন ভোরে গাড়ি সকলকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিল গৌরিকুন্ডে , গাড়ি এর বেশি এগোনোর উপায় থাকে না ৷ এখান থেকে কেদার নাথ যাত্রার প্রধান ধাপ শুরু হল, তিনভাবে পৌঁছানো যায় কেদারে আকাশ পথে হেলিকপ্টারে,

সড়ক পথে অর্থাৎ অবশ্যই পায়ে হেঁটে আর তৃতীয় সহজ রাস্তাটা হল ঘোড়ার পিঠে ,প্রত্যেকের মত নিয়ে হেলিকপ্টারে পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা ফলপ্রসু হয় নি কারন প্রায় ২ মাস আগে থাকতেই অনুমতিপত্র জোগাড় করতে হয় তাই তখনি অনুমতি পাওয়া গেল না ৷

অগত্যা প্রচন্ড বৃষ্টি র মধ্যে এগোনো আর খাঁড়া পাহাড়ী পিছল রাস্তায় ঘোড়ার পিঠে উঠে কেদারের মূল মন্দিরের দিকে চলা শুরু হল , কেদারের জলবায়ুর মূলবৈশিষ্যই হল কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি , সাথে পথের পাশে রয়েছে তুষারের শুভ্র ভারি স্তর ৷

হিমালয়ে তু কেদারাম!

শিবের বয়সের সাথে সাথে কেদারের মন্দির ও বহু প্রাচীনতার সাক্ষর রেখে চলে , মূলমন্দির তৈরী হয়েছিল আদিগুরু শঙ্করাচার্যের সময় আর মন্দিরের পাশে পানন্ডবদের হাতে গড়া মন্দির ও আছে ৷ হড়পা বানে অনেক নিদর্শন নষ্ট হলেও জৌলুস বিন্দু মাত্র নষ্ট হয়নি মূল মন্দির ও গর্ভ গৃহের ।

প্রায় সন্ধ্যেয় অসহ্য পথ পরিশ্রম করে পৌঁছানো গেল মন্দিরে , বহু আশার প্রত্যাশার কেদারনাথজী । কালো গ্রানাইট পাথরের মহিষের পৃষ্ঠদেশীয় পিরামিডের দেহে সব সময় চড়ছে ঘি ও সুগন্ধী লেপন, মূর্তি ছুঁয়ে প্রনামের রীতি ও আছে ৷প্রচুর ভক্ত সমাগমেও সর্বদা পুজোপাঠ চলছে ।

রাত প্রায় ২ টো নাগাদ স্পেশাল পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল টিমের পক্ষ থেকে , রাতের নির্মল আকাশের তলায় মহাদেবের জপ স্তুতি হিমালয়ের পরিবেশে মহাকালকে জাগিয়ে তুলল ৷বিশেষ বিষেশ পুজোর ক্ষেত্রে এই রকম ব্যবস্থা , এছাড়াও ক্ষণে ক্ষণে চলছে শৃঙ্গার পূজা ও আরতি ।

প্রচন্ড বৃষ্টি ওঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাতে কেদারের উপত্যকার উপর হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন আবার ঘোড়ায় নীচে অর্থাৎ গৌরিকুন্ডে নেমে আসা হল । এবারের আশ্চর্য পরিবর্তন , যে উঠতে যে সময় লেগেছিল নামতে লাগল তার চেয়ে অনেক কম সময়৷

ত্রিলোকনাথ শিবশম্ভুর এই নিদর্শন থেকে টিমের এবারের পথ উত্তরাখান্ডের অন্যতম টুইন তীর্থ বদ্রীনারায়ন ।ঋষিগঙ্গা ও অলকানন্দার মিলনস্থল অতীতের বাণপ্রস্থ হিসাবে প্রসিদ্ধ বদ্রীনারায়ন ৷

সামনেই শ্বেত শুভ্র কিরীট শিরে কুইন অফ গাড়োয়াল শিবালিক পর্বত ,মন্দিরের দুই পাশে নর ও নারায়ণ দুই পাহাড় প্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ৷বহু প্রকার কিংবদন্তি ঘিরে পাথরের কারুকার্যময় মন্দিরে জাফরির নকশা ও বাতায়ন গুলি দৃষ্টিনন্দক তবে সামান্য বৌদ্ধ স্থাপত্যকীর্তির আদর্শ ও মেলে এই মন্দিরের আদলে ৷

দুপুর নাগাদ টিম পৌঁছালো তখন প্রায় ৪ কিলোমিটারের লম্বা পুণ্যার্থীদের লাইন । নির্বিঘ্নে পুজো দেওয়া হল সেই বিশাল লাইন ঠেলে । হঠাৎ ই মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই বেশ হতচকিত হয়ে গেল ৷

কিছুক্ষণ পর জানা গেল রিলায়েন্সের কর্ণধার মুকেশ আম্বানি পদার্পন করেছেন বদ্রীনাথ আশ্রমে ৷ফোটোগ্রাফাররা ক্যামেরা নিয়ে ছুটল , কারন ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে ৷আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই প্রকৃতির রুদ্ররূপ দর্শন করায় ও ঈশ্বরের আশীর্বাদ থেকে কেউ ই বঞ্চিত নয় ৷

মন্দির সংলগ্ন বাজারে দেখা মিলল স্মিথ ত্রিবেদী নামে এক পুণ্যার্থীর সাথে,কাঁধে তার সাড়েতিন বছরের কন্যা স্বরা ত্রিবেদী৷বাবার কাঁধে চেপেই সে চার ধাম পরিক্রমা সম্পূর্ণ করল। দেশের সময় এর লেন্সে ধরা পড়ল সেই মুহুর্ত৷

সব শেষে মন্দির থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট হোটেলে রাত কাটানো ঠিক হল Iসে এক বিপত্তি দেখা দিল ,তা হল গাড়ির জ্বালানী হঠাৎ ই শেষ । এই পাহাড় গুলোতে চলার প্রধান সমস্যা হিসাবে বলা যেতে পারে জ্বালানীর ৷

কারন সব জায়গায় পেট্রোল পাম্প না থাকায় রিস্ক না নিয়ে গাড়ি অবশ্যই ফুল করে তবেই এই রাস্তায় এগোনো উচিত হবে । এও এক দৈব পরীক্ষা …..যাই হোক বহু কষ্টে সেই রাতের মতো হোটেল পৌঁছে রাত কাটিয়ে পরের দিননভোর ভোর রওনা হওয়া গেল নীচে অবতরনের পথে ।….. এথানেও পূন্যার্থীদের ভিড় প্রতিবছর তাই তাদের অভিজ্ঞতা জানার জন্য আমরা পৌঁছে গেছিলাম কয়তাদের কাছে ৷

এবার পথ ঘুরে গেল নীলকন্ঠ পাহাড় তথা মন্দিরের দিকে ৷ স্বর্গাশ্রম থেকে ২২ কিমি দূরে বিষ্ণুকূট ,ব্রহ্মাকূট ও মনিকূট এই তিনটি পাহাড় একত্রে নীলকন্ঠ পাহাড় ।মন্দিরে জাগ্রত দেবতার শিরে নাগরাজ ফনা তুলে মনে করিয়ে দিচ্ছে মহাদেবের আকন্ঠ বিষপানে নীলকন্ঠ হওয়ার কাহিনী ।

সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা বিষ এই স্থানে এসে পানকরেন ভোলা মহেশ্বর ৷এখানেও পুজো দেওয়ার রীতি আছে ।অসংখ্য মন্দির ও তার নানান উপাখ্যান নিয়ে আমাদের এই সর্পিল পথে অবতরন চলতে লাগল ।

যেতে যেতে মনে পড়ে যায় বিখ্যাত সেই লাইন…
“নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
মহাদেবের জটা হইতে ।

গোমুখ থেকে উৎপন্ন ভারতের চিরপবিত্র নদী গঙ্গা ঠিক যেন মহাদেবের জটা থেকেই এসে নিজেকে সঁপে দিয়েছে বিশ্বজগতের কল্যান সাধনায়, কেদার যাত্রার শুরু ও শেষ এই গঙ্গা আর তার তীব্র জলস্ত্রোত , যা মূহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমস্ত কৌলিন্য ৷

এও মহাকালের আশীর্বাদ স্বরূপ , দৃষ্টির পাশে ধাপে ধাপে নেমে আসছে পাহাড় তার অসাধারন সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে কত বিচিত্র তার শোভা কত রঙিন তার অবয়ব যার আকর্ষণে ছুটে আসছে যুগযুগ ধরে শত শত ভক্ত , পথিক , দুঃসাহসিক অভিযাত্রী দল ৷

সেই পরিচিত পথ দিয়ে নীচে নামার দরুন আর কোথাও দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না তাই এবার সোজা হরিদ্বার । শিবালিকের পাদদেশে সাহারানপুর জেলায় প্রায় ৩০০ মিটার উঁচু এই হরি ও হরের সহাবস্থান অর্থাৎ হরিদ্বার ।

প্রধান আকর্ষণ গঙ্গা এখানে পাহাড় থেকে সমতলে এসে নেমেছে হর কিপৌড়ি ঘাটে ।এর পরেও প্রায় ২০০০ কিমি পথ অতিক্রম করে এই পূণ্য সলীলা হাজির হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে , মোহনায় ৷

ব্রহ্মান্ডের সব পাপ মুছে ফেলা যায় এই ঘাটের স্নানে , সেই আশায় হরিদ্বার পৌছেই সবাই মিলে যাওয়া হল গঙ্গায় স্নানের জন্য । একটুকরো প্রাচীন ভারতের নিদর্শন যদি দেখতে হয় তাহলে এই ঘাটে দাঁড়িয়ে চক্ষু উন্মিলিত করলেই চলবে , নানা ভাষা , নানা মত নানা জাতির লোক সবাই এই গঙ্গা স্নানের পূণ্য লাভের আশাপ্রার্থী ৷

নদীতে স্নান ও খাওয়া সেরে সকলে চললেন চন্ডিকা মন্দিরে পুজো দিতে ৷ স্থানীয় নীলধারার অপর পাড়ে নীল পর্বতের চূড়ায় চন্ডী মন্দির , সেখানে যাওয়া হল রোপওয়ে তে ৷ নীল পাহাড়ের উপরের অপরূপ শোভা ও শান্ত পরিবেশে মন চাঙ্গা হয়ে উঠতে সময় নেয় না ৷ এখানে গঙ্গা অাদি রূপে তাই জলপ্রবাহ খানিক কমের দিকে ।
সন্ধ্যায় দেখা গেল হরিদ্বারের প্রধান আকর্ষণ হরকিপৌড়ি ঘাটে গঙ্গা আরতি । জয় জয় গঙ্গে মাতা ……আরতির তালে তালে ৬জন পুরোহিত ১০০৮ টি প্রদীপ নিয়ে গঙ্গাকে বরণ করছেন ৷

প্রত্যুষে দুধ ও সন্ধ্যায় ভসমান সন্ধ্যা প্রদীপ ভাসিয়ে মা গঙ্গাতে তুষ্ট রাখা হয় , মনের শান্তি নিয়ে আসে এই পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ ও নদীর বুকে দোদুল্যমান অগ্নিবিন্দু গুলি ।

হরিদ্বার ছেড়ে যেতে মন চায়না কারন ,যুগান্ত পেরিয়ে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আলোচনা সমালোচনার উর্ধে এক সনাতন মানব ধর্মের এই তীর্থক্ষেত্র ৷ প্রত্যেকের কানে তখনও বেজে চলেছে জয় শিব শম্ভু …..হরহর মহাদেব ধ্বনি ৷

পরের দিন দিল্লির পথে যাওয়া ও বিকেল ৬ টায় দিল্লি থেকে বিমানে চড়ে দমদম নেতাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে শেষ হল দেশের সময় টিমের এই ঝটিকা সফর ৷ সময় টা বয়ে চলে গেল নদীর স্ত্রোতের মতো তবে এই গোটা সফরটায় আমাদের সাথে থেকে প্রতি পদক্ষেপে, সর্পিল, বিপদযুক্ত পথে সঙ্গে থেকেছেন দেশের সময়ের সমস্ত পাঠক পাঠিকা তাদের উৎসাহ নিয়ে শেষ হয় দেশের সময় এর কেদারনাথ,বদ্রীনাথ পরিক্রমা ৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here