দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ভারতীয় সময় সকাল ৯টা। মনিটরে চোখ রেখে অধীর অপেক্ষায় মহাকাশবিজ্ঞানীরা। শুরু হল কাউন্টডাউন। এক..দুই..তিন..১৭৩৮ সেকেন্ড। ‘বাহুবলী’ জিয়ো সিনক্রোনাইজড লঞ্চ ভেহিক্যাল (জিএসএলভি মার্ক-৩) রকেটের পেট থেকে বেরিয়ে এল তার লিকুইড চেম্বার। চাঁদের কক্ষপথে পা রাখল চন্দ্রযান ২। ভারতের ঐতিহাসিক চন্দ্রযাত্রার ইতিহাসে শুরু হল নতুন অধ্যায়।

মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সাংবাদিক সম্মেলন করে চন্দ্রযাত্রার খুঁটিনাটি জানান ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিবন। তিনি বলেন, লুনার অরবিট ইনসারশন (LOI) বা চাঁদের কক্ষপথে চন্দ্রযানের প্রবেশ, পুরোপুরি সফল। এই কক্ষপথের পরিধি ১১৪ কিলোমিটার*১৮০৭২ কিলোমিটার। লুনার অরবিট বা চাঁদের কক্ষপথে ঢোকার জন্য একাধিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে চন্দ্রযানকে। প্রথমতগতিবেগ নিয়ন্ত্রণ, দ্বিতীয়ত, চাঁদের গতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উপগ্রহের গতিকে সেই নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্ধারণ।

চন্দ্রযানের গতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ, উৎকণ্ঠা এখনও কাটেনি

কে শিবনের কথায়, কক্ষপথে পা রাখার মুহূর্তে উপগ্রহের গতি সামান্য বেশি হলে প্রতিক্রিয়া সেটা পিছিয়ে আসত অনেকটাই। ফলে ইনসারশন সম্পূর্ণ হত না। চান্দ্রায়ন-২ যখন যাত্রা করে, তখন তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩৯ হাজার ২৪০ কিলোমিটার। পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে মহাকাশে ভ্রমণ করে লুনার ট্রাজেক্টারিতে প্রবেশের আগে তার গতি ও শক্তি ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে। তবে কক্ষপথে ইনসারশনের আগে চাঁদের কক্ষপথের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই চন্দ্রযানের গতি নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।

তবে উদ্বেগের প্রহর এখনও কাটেনি বলেই জানিয়েছেন শিবন। চন্দ্রযানের উপর চোখ রেখে ২৪ ঘণ্টা মনিটর করছে ‘মিশন অপারেশনস কমপ্লেক্স’ (MOX)। নেটওয়ার্কের পর্যবেক্ষণ করছেন বেঙ্গালুরুর ট্র্যাকিং অ্যান্ড কম্যান্ড নেটওয়ার্কের (ISTRAC) বিজ্ঞানীরা।

চাঁদের কক্ষপথে কবে কোনদিন

আজ, ২০ অগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে চাঁদের প্রথম কক্ষপথ ১৮০৭৮ কিলোমিটারে ইনসারশন হয়েছে চন্দ্রযান ২-এর। আগামিকাল ২১ অগস্ট, দুপুর ১২টা নাগাদ চাঁদের দ্বিতীয় কক্ষপথে অর্থাৎ ৪৩০৩ কিমি-র অরবিটে পা রাখবে চন্দ্রযান। সেই কক্ষপথে পাক খাবে কিছুদিন। এরপরের পদক্ষেপ চাঁদের তৃতীয় কক্ষপথ যার দূরত্ব ১৪১১ কিলোমিটার। সেখানে পৌঁছতে সময় লেগে যাবে ১৮ অগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা। ৩০ অগস্ট চতুর্থ কক্ষপথ ১৬৪ কিলোমিটারে পৌঁছবে সন্ধে ৬টা নাগাদ। ফাইনাল অরবিট বা পঞ্চম কক্ষপথে পৌঁছবে ১ সেপ্টেম্বর সন্ধা ৭টা নাগাদ।

ইসরোর চেয়ারম্যান শিবনের কথায়, চাঁদের প্রথম অরবিট বা কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে চন্দ্রযান। ফাইনাল অরবিট বা শেষ কক্ষপথে পৌঁছতে সময় লাগবে ২ সেপ্টেম্বর। চন্দ্রযান সেই সময় থাকবে ‘মুন সারফেস’ বা চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিমি*৩০ কিমি উপরে। চন্দ্রযানের ভিতর থেকে সেই সময় ইজেক্ট করা হবে ল্যান্ডারকে। ৭ সেপ্টেম্বর ল্যান্ডারের ‘সফট ল্যান্ডিং’ হবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে।

২২ জুলাই উৎক্ষেপণের পর থেকে ঠিক কী কী হয়েছিল!

গত ২২ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধওয়ন স্পেস রিসার্চ সেন্টার থেকে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দেয় চন্দ্রযান-২। জিয়ো সিনক্রোনাইজড লঞ্চ ভেহিক্যাল থেকে বাহুবলী রকেটের পিঠে চড়ে চন্দ্রযান উড়ে যায় তিনটি অংশ— অরবিটর স্যাটেলাইট, বিক্রম ল্যান্ডার এবং প্রজ্ঞান রোভার নিয়ে। তিনটি অংশ মিলিয়ে ওজন ৩৮৫০ কেজি।

উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবীর কক্ষপথে হই হই করে ঢুকে পড়েছিল চন্দ্রযান-২। ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এতদিন লাট্টুর মতো পৃথিবীর চারধারেই পাক খাচ্ছিল সে। ১৪ অগস্ট ভারতীয় সময় রাত ২টো ২১ মিনিট নাগাদ অভিকর্ষজ বলকে পিছনে ফেলে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে বেরিয়ে যায় চন্দ্রযান। ১২০৩ সেকেন্ডের মধ্যে রকেটের লিকুইড চেম্বারের ইজেকশন হয়। চন্দ্রযান সফল ভাবে ঢুকে পড়ে চাঁদের পথে ‘লুনার ট্রান্সফার ট্রাজেক্টরি’-তে।

ইসরো সূত্রে আগেই জানানো হয়েছিল, পৃথিবী এবং চন্দ্রের কক্ষপথে ঘোরার মধ্যে মোট ১৫টি ধাপে শক্তি বাড়ানো হবে। এই ভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে দেওয়া হবে চাঁদের দিকে। তার পর সব শেষে চাঁদের মাটিতে নামবে বিক্রম ল্যান্ডার।

চাঁদের কক্ষপথের প্রায় ১০০ কিলোমিটার উপরে থাকতেই চন্দ্রযানের পেট থেকে বেরিয়ে আসবে ল্যান্ডার ‘বিক্রম।’ সব ঠিক থাকবে ‘বাহুবলী’ জিএসএলভি মার্ক-৩ রকেট থেকে ল্যান্ডারের ছাড়াছাড়ি হবে আগামী ২ সেপ্টেম্বর। রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ল্যান্ডার পাক খেতে শুরু করবে চাঁদের কক্ষপথে। ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, নামার আগে আরও চার দিন চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে ল্যান্ডার। তার পর ধীরেসুস্থে নামবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে (৭০ ডিগ্রি অক্ষাংশ) । ইজেক্ট করবে ২৭ কেজি ওজনের ৬ চাকার রোভার ‘প্রজ্ঞান’কে।

সোনায় মোড়া অভিযান

ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’ পুরোপুরি সোনায় মোড়া। মূলত পলিমাইড ও অ্যালুমিনিয়ামের মিশ্র ধাতু বা সংকর ধাতুর তৈরি। এর সামনের অংশ তৈরি হয়েছে পলিমাইড দিয়ে, আর পিছনের ভাগে রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম। মহাকাশের ক্ষতিকর বিকিরণ যেমন মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বাঁচতেই চন্দ্রযানের এই সোনার সাজ। কারণ, মহাজাগতিক রশ্মির বিকিরণ যন্ত্রের উপর প্রতিফলিত হলে সেগুলি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কার্যক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। চাঁদের হিমশীতল দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযানকে সুস্থ-সচল রাখার জন্যই সোনার-বর্ম পরিয়ে তাকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here