দেশের সময় ওয়েবডেস্ক: ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল। মহামারীর আকার নিয়েছিল ‘সার্স’ (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) । চিনের মূল ভূখণ্ডেই মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৪০০ জনের। হংকংয়ে অন্তত ৩০০। ২০০৯ সালে ফের সোয়াইন ফ্লুয়ের ছোবল। শয়ে শয়ে মৃত্যু। সরকারি হিসেবেই সংখ্যাটা ছিল সাতশোর কাছাকাছি। দশ বছরে সংক্রমণের ধাক্কাটা থিতিয়ে যাওয়ার মুখেই চিনের মাটিতে ফের শুরু হল মৃত্যুমিছিল। এবারের নিউমোনিয়া, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল এবং শেষ পরিণতি মর্মান্তিক মৃত্যু—এই রহস্য ভাইরাসের আক্রমণের পদ্ধতি ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের। চিন থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইল্যান্ড হয়ে এই ভাইরাসের সংক্রমণের সতর্কতা জারি হয়েছে ভারতেও।

করোনাভাইরাস। করোনাভিরিডি (Coronaviridae) গোত্রের এই ভাইরাস পরিবারের অনেক ভয়ঙ্কর সদস্যেরা আছে, যাদের প্রভাব প্রাণঘাতী। চিনে যে করোনাভাইরাস হামলা চালাচ্ছে সেটির নাম নোভেল করোনাভাইরাস (Novel Coronavirus 2019-nCoV)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে যে তীব্র শ্বাসকষ্টজনিত রোগ হচ্ছে তার নাম সিওভিডি-১৯ (COVD-19)। এর এক ছোবল পাঁচদিনের মধ্যেই ফুসফুসের দফারফা করে দেয়। প্রথমে শ্বাসকষ্ট, টিবি সংক্রমণ ছড়িয়ে তারপর শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে কাবু করে ফেলে। শেষে মৃত্যু। করোনার সংক্রমণে চিনের মূল ভূখণ্ডে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে তিনি হাজারেরও বেশি। আক্রান্ত ৮৮ হাজারের কাছাকাছি।


চিনের উহান প্রদেশের সি-ফুড বাজার থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে খবর রটলেও, ইজরায়েলের মাইক্রোবায়োলজিস্টরা দাবি করেছিলেন যে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেটা সাধারণ ভাইরাস নয়। বরং জিনের বদলে তৈরি ভয়ঙ্কর রাসায়নিক মারণাস্ত্র। উহানের বায়ো সেফটি লেভেল ৪ ল্যাবোরেটরি থেকে এই জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ভাইরাস লিক হয় এবং সেটাই ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। বিশ্বজুড়ে সংক্রামিত লক্ষের কাছাকাছি।

ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েস কলেজের আইনের অধ্যাপক ড. ফ্রান্সিস বয়েল বলেছিলেন, উহানের এই বায়োসেফটি লেভেল ফোর ল্যাবোরেটরিকে সুপার ল্যাবোরেটরির তকমা দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বলা হয়েছিল, এই ল্যাবে ভাইরাস নিয়ে কাজ হলেও তা অনেক বেশি সুরক্ষিত ও নিরাপদ। ল্যাবোরেটরির জন্যই রয়েছে আলাদা উইং যার বাইরের পরিবেশের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। ড. ফ্রান্সিস বলেন, সার্স ও ইবোলা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার পরে অভিযোগের আঙুল ওঠে এই গবেষণাগারের দিকেই। রোগ প্রতিরোধ নয়, বরং প্রাণঘাতী জৈব অস্ত্র বানাতেই মত্ত গবেষকরা।

কী এই নোবেল করোনাভাইরাস?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই ভাইরাসকে চিহ্নিত করেছিল 2019-nCoV নামে। গবেষকরা এখন এই ভাইরাসকে ডাকছেন উহান করোনাভাইরাস (Wuhan coronavirus) নামে। নিউমোনিয়ার সঙ্গেই সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে এই ভাইরাস, তাই এর নাম উহান নিউমোনিয়াও রেখেছেন গবেষকরা। এর প্রকৃতি, স্বভাব এখনও অনেকটাই আড়ালে রয়েছে। এই সিঙ্গল-স্ট্র্যান্ড আরএনএ ভাইরাসের দেখা প্রথম মিলেছিল ২০১৯ সালে।

২০২০-র জানুয়ারির মধ্যেই এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে চিনের মূল ভূখণ্ডে। এমনকি উহান থেকে যাঁরা বাইরে গেছেন তাঁদের অনেকেই ভাইরাসের সংক্রমণ নিজের শরীরে বহন করে নিয়ে গেছেন। প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, পশু-পাখির থেকেই এই ভাইরাস বাসা বেঁধেছে মানুষের শরীরে। তবে এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের থেকে মানুষেও ক্রমশই ছড়াচ্ছে সংক্রমণ, যার প্রমাণ মিলেছে চিনের গুয়ানডঙ প্রদেশে। ব্যাংকক, টোকিও, দক্ষিণ কোরিয়া, বেজিং, সাংঘাই, হংকং, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। হালে দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াতেও ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে।

ভারতে ইতিমধ্যেই ২৮ জনের শরীরে মিলেছে করোনাভাইরাসের খোঁজ। দিল্লিতে আক্রান্ত একজন, তেলঙ্গানায় বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে দুবাই ফেরত এক যুবককে। এদিকে নয়ডার শ্রীরাম মিলেনিয়াম স্কুলে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানকার ৪০ জন পড়ুয়া ভর্তি আইসোলেশন ক্যাম্পে। এক পড়ুয়ার অভিভাবকের শরীরেও করোনা পজিটিভ। উহান ফেরত কেরলের তিন ছাত্রকে এখনও কোয়েরেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়েছে বিহার, রাজস্থানেও। আগ্রায় একই পরিবারের ছ’জন আক্রান্ত ভাইরাসের সংক্রমণে।

ইতালি থেকে দিল্লিতে আসা ২৩ জন ইতালিয় পর্যটকের মধ্যে ১৬ জনই ভাইরাস সংক্রামিত বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁদের পাঠানো হয়েছে আইসোলেশন ইউনিটে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, জাপানি পর্যটকদের ভিসা বাতিল করেছে ভারত সরকার।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের সঙ্গে বিটা-করোনাভাইরাসের বিস্তর মিল। বিটা-করোনাভাইরাস ছড়ায় বাদুর থেকে। সার্স (SARS) এবং মিডল-ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম-রিলেটেড করোনাভাইরাসের (MERS)সঙ্গে এর স্বভাবে কিছু মিল থকালেও জিনগতভাবে এরা অনেকটাই আলাদা। চিনের সিডিসি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোজেন বায়োলজি এবং উহান জিনিইনটান হাসপাতালের গবেষকরা নোভেল করোনার পাঁচটি জিনোম আলাদা করে পরীক্ষা করছেন। এর থেকেই এই ভাইরাসের ঠিকুজিকুষ্ঠী জানা যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

নিউমোনিয়া থেকে কিডনি বিকল—নোভেল করোনারা প্রাণঘাতী

নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ‘গ্লোবাল হেলথ ক্রাইসিস’ বলে অবিহিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আক্রান্ত মানুষদের উপসর্গের ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই ভাইরাসরা হানা দেয় চুপিসাড়ে। শরীরের ভেতর বাড়তে থাকে আড়েবহরে। বিস্ফোরণ ঘটায় আচমকাই। শুরুটা হয় সর্দি-কাশি. জ্বর দিয়ে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। কাবু করে নিউমোনিয়া। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা দেয় সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম

ভাইরাসের শান্তি হয় না তাতেও। ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরেই। একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে তার নিশানা বানায়। রোগ প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। শরীরে রক্ত প্রবাহ কমতে থাকে। কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে ফুসফুস, কিডনি। সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যু।
কর্নেল ইউনিভার্সিটি কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক গ্যারি হুইট্টেকার বলেছেন, এই ভাইরাসের আকার মানুষের চুলের ৯০০ ভাগের একভাগ মাত্র। কোনও কোষ প্রাচীর নেই। এই ভাইরাস নিজে থেকে চলাফেরাও করতে পারে না। মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে হলে এর একমাত্র পথ কোনও কিছুর মাধ্যমে বাহিত হয়েযাওয়া। সেটা শ্বাস-প্রশ্বাস হতে পারে, অথবা থুতু-লালার মধ্যে করে এটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে, একেই বলা হচ্ছে ‘ভাইরাল ড্রপলেট’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারও সঙ্গে হাত মেলালেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। হয়ত সেই রোগী মুখে, নাকে হাত দিয়েছেন, তারপরে সেই হাত মিলিয়েছেন অন্য কারও সঙ্গে। তাহলেও ভাইরাল ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগীর ধারেকাছে গেলে খুব ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে নেওয়া উচিত। আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাওয়াও মারাত্মক। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লেইসেস্টারের ভাইরোলজিস্ট জুলিয়ান ট্যাঙ বলেছেন, আক্রান্ত রোগীর ফেলে যাওয়া খাবারের গন্ধ শুঁকলেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। কারণ শ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে শরীরে। চুমুর মাধ্যমেও ছড়াতে পারে ভাইরাসের সংক্রমণ। গবেষকরা বলছেন, আক্রান্ত রোগীর তিন ফুট থেকে ছ’ফুটের মধ্যে থাকলে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল।

রোখা যাবে কি এই সংক্রমণ?

নোভেল করোনাভাইরাসের প্রকৃতি হাতে না আসা অবধি এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার পদ্ধতি জানা যাবে না। হু জানিয়েছে, প্রতিরোধের উপায় গড়ে তোলা যেতে পারে কয়েকভাবে। যেমন,

মৃত পশুপাখির সংস্পর্শে না আসা।

ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শ ত্যাগ করা। আক্রান্তদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়া অথবা একই বিছানায় শোয়া নৈব নৈব চ।

সামান্য সর্দি-কাশি-জ্বরেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। শ্বাসকষ্টকে অবহেলা করা যাবে না কোনওভাবেই।

খোলা মাছ বা মাংসের বাজারে গেলে হাত-পা ভাল করে ধোয়াটা আবশ্যক। পোষ্যের শরীরে হাত দিলে সেই হাত কখনওই নাকে-চোখে বা মুখে দেওয়াটা ঠিক হবে না।

মাংস ভাল করে রান্না করে খাওয়াই উচিত। অর্ধসিদ্ধ মাংস বা দুধ না ফুটিয়ে খাওয়াটা উচিত হবে না।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু)মুখপাত্র ক্রিস্টিয়ান লিন্ডমেয়ার বলেছেন, অন্তত তিন ফুট দূরত্ব রাখা উচিত করোনা আক্রান্ত রোগীর থেকে। অন্যদিকে, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসের সংক্রমণ যদি পজিটিভ হয়, তাহলে সেই রোগীর ছ’ফুটের মধ্যে থাকলে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা তীব্র। এখন, কীভাবে বোঝা যাবে সেই ব্যক্তি ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা।

হু জানাচ্ছে, করোনার সংক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে হলে মামুলি সর্দি-জ্বর হয়। সেক্ষেত্রে চট করে বোঝা যায়না। তবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এর অন্তিম পরিণতি শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here