মলয়  গোস্বামী


          (প্রথম পর্ব)

সকাল হয়েছে । পাখি সব এই থিয়েটার রোডের এই বাড়িতে এখনও কলরব করে । সেই ছোট্ট বেলায় হালিশহরের চৌধুরী পাড়ায় , আমাদের গাছপালা ঘেরা বাড়িতে যেমনভাবে পাখিরা ডাকত, ঠিক তেমনই রয়েছে পাখিদের গলা ।     উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম , মানুষের গলার সুর কিন্তু পাল্টে গেছে । তাহলে পাখিরা ধরে রাখলো কী করে ? ওরা কোনো রকম অস্ত্র বানাতে শেখেনি তাই ? আমার এই বাড়িতে যে পাখিরা আসে , তার কারণ , ছোট উঠোনে পোঁতা বেশ কয়েকটি আম কাঁঠাল গাছ , ফুলবাগান আছে , তা ছোট্ট কেয়ারি মতন । রিনি করেছে । রিনি আমার মেয়ে । বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার । শিলং-এ । ও বছরে দু’বার আসবেই । এসে ফুল গাছ করবে ।

রিনির মা শ্রীতমা , এই বাড়ির জমি যখন কেনা হয়েছিল , তখনই কোনো প্ল্যান করবার আগেই নিজের হাতে লাগিয়েছিল এইসব আম জাম কাঁঠালের গাছ । বাড়ির পেছন দিকে তিনটি সুপারি আর দুটো নারকেল গাছও , তার হাতে লাগানো । এখন কত বড় ! ওরা মেঘের সাথে কথা বলতে চায় ।  আমার বাড়ির চারদিকে পেল্লায় সব বাড়ি । যাকে বলে স্কাইস্ক্র্যাপার । এ হলো মহানগরের আইকার্ড । 

বেশ বুঝতে পারছি রোদ্দুর পায়ের কাছের জানলা দিয়ে এসে আমার পা-য়ে প’ড়ে ডাকছে — ওঠো । সকাল তো বেশ হলো । ওদিকে তোমার বৌ কত সকালে উঠে ঘরের কাজকর্ম করছে । রান্নার মেয়েটি — শ্যামা এসে গেছে । তুমি কি এখনও উঠবেনা ? উঠে তোমায় লিখতে হবে তো ? পুজোর লেখা এখনও শেষ করোনি । ” এই দিনকাল ” কাগজের শারদীয়ার উপন্যাসের শেষটুকু তো আজই নিতে আসবে । আর কতো ফেরাবে ? 
আমি রোদ্দুরকে দিয়ে কথা বলাই । আসলে আমার মনের ভেতরে সত্যি কথাটা বলানোর প্রক্রিয়া আমি এইভাবে তৈরি করেছি ।       মানুষের ভেতরের সত্ত্বাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে কথা বলালে এ জীবন কিছুটা পরিস্কার হয় । পাখিদের দিয়ে কথা বলাই । আমাদের এই গাছগুলিতে হরেকরকম পাখি থাকে । এটা ওদের বাড়ি । শ্রীতমার বাবা পন্ডিত মানুষ ছিলেন । পরম ভক্ত । সেই বাবার কিছু চরিত্র শ্রীতমার মধ্যে প্রবেশ করেছে । আমার শ্বশুর মশাই যেহেতু বলতেন , সেহেতু শ্রীতমার কথা হলো —– খাবার পাতে অল্পকটি ভাত রেখে উঠবে । ওইগুলো খাবে পোকামাকড় , পিঁপড়ে টিপড়ে  । আর গাছ পুঁতবে । কারণ পাখিদের জমিতো ওই গাছপালাই ।  শুনে আমি যৌবনে হাসতাম । ” হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ– তমা , নিউইয়র্ক সিটিতে একটুকরো জমি পেলে যদি তুমি গাছপালা লাগাও , তাহলে থাকবে কি বাস টার্মিনাসে ? এখন বয়স হয়েছে । উপলব্ধিটা অন্যরকম ‌শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবি আর উপন্যাসের প্লট তৈরি করি । উপন্যাসতো আর লিখতে হয়না । যে কোনো জীবনকে লিখলেই তো উপন্যাস হয়ে যায় । আমি সবাইকে বলি , পৃথিবীতে যত কোটি মানুষ আছে , তত কোটি উপন্যাস । কোনো দিন সব লেখা হবেনা । 

উঠে আড়ামোড়া ছাড়লাম । ফ্রেশ হয়ে বারান্দার চেয়ারে বসি । সামনে তাকিয়ে দেখি ——- মহানগর । এত ভোরেও দূরের আকাশে ধোঁয়া । শিল্পের মতন রং । শ্রীতমা চা নিয়ে আসে । ওর  স্নান সারা । অসাধারণ সুন্দরী ছিল সে একসময়। তার রেশ এখনও লেগে আছে সমগ্র শরীরে ।  সামনের চেয়ারে বসলো ও । ” আচ্ছা তমা … “।  জানি শ্রীতমা এবার কিছু বলবেই । ও জানে যখন আমি ওর নাম ধরে ডাকি , তখনই আমি যৌবনের শ্রীতমাকে দেখতে পাই । ও কখনো রেগে যায় , আবার কখনও কেমন অবশ হয়ে পড়ে । 
                ( আগামী সংখ্যায় )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here