শম্পা গুহ মজুমদার

শীত প্রধান দেশে হেমন্ত কালে যে ভাবে পাতার কালার চেঞ্জ হয় তা গ্রীষ্ম প্রধান দেশে দেখা যায় না। অক্টোবর মাসে শীতের শুরুতেই সবুজ পাতার রং বদলাতে আরম্ভ করে। কোনো কোনো গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায় আবার কোনো গাছের পাতা লাল, গোলাপী বেগুনী তে পরিণত হয়। নানা গাছ আর নানা রঙের বাহার। সে এক অপার্থিব দৃশ্য।

বেশ কয়েক বছর সাউথ কোরিয়াতে থাকার ফলে আমার হেমন্তের রূপ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাই অক্টোবর মাস এলেই মন চলে যায় প্রকৃতির এই রঙিন আঙিনাতে। তবে প্রাকৃতিক এই রঙ কিন্তু খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই আগে থেকে খবর নিয়ে তবেই গন্তব্যে রাওনা দিতে হবে। কালার চেঞ্জ হওয়ার আগে গেলে সবুজ পাতা দেখতে হবে আবার দেরি হয়ে গেলে গাছে একটি পাতাও থাকবে না, সব ঝরে যাবে।

আজ কোরিয়ার একটি বিখ্যাত মন্দিরের গল্প শোনাবো। সাউথ কোরিয়ার রাজধানী সিওল (সোল্ উচ্চারণ করা হয় ) ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বুসান(Busan )। এই বুসানেই বেওমেওসা মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের উৎপত্তি নিয়ে খুব সুন্দর একটি কিংবদন্তি আছে। বেওমেওসা মানে "Heavenly Fish."বিওমোওসাকে যে পর্বতটিতে পাওয়া যায় সেখানে পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল এক শিলা ও একটি সোনার কূপ রয়েছে যা কখনও শুকিয়ে যায় না। বিশ্বাস করা হয় যে স্বর্গ থেকে সোনার মাছ নেমে এসেছিল এবং তখন থেকেই এই স্বর্ণ কূপে সে বাস করে।


বিওমোসা মন্দিরটি বুসানের বিখ্যাত পর্বত জিউমজেংসান (Geumjeongsan) মাউন্টেনের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। এটি শীলা ডাইনেস্টির রাজা মুনমু (Munmu) র রাজত্ব কালে নির্মিত হয়। ৬৭৮ সালে সন্ন্যাসী উয়াসং( Uisang) এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। Imjin যুদ্ধর সময় (১৫৯২-১৫৯৮) এই মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। ১৬১৩ সালে মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করা হয়।

মন্দিরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে ইলজুমুন গেট, নবম শতাব্দীতে চারটি স্তম্ভ নির্মিত তিনতলা প্যাগোডা, মণ্ডপ, গেট এবং এগারোটি হার্মিটেজ। অক্টোবর ও নভেম্বরের শুরুতে মন্দিরের চারিপাশের উপত্যকা অপূর্ব সুন্দর রূপ ধারণ করে। গাছের পাতার রঙে চারিদিকের পাহাড় গুলিও রঙিন হয়ে ওঠে। চারিদিকে যেন হোলি খেলা শুরু হয়ে যায়।

মেপেল গাছের পাতা গাড় লাল রঙে পরিনত হয়। কোনো কোনো গাছ পুরোটাই উজ্জ্বল হলুদ। নীল আকাশের ব্যাকগ্রউন্ডে মন্দির ঘিরে এই রঙিন প্রকৃতি যেন এক অপার্থিব দৃশ্য। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে মূল মন্দিরের দিকে। বুদ্ধদেবের প্রশান্ত মূর্তি সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। হলঘরে শ্রূতিমধুর মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বুদ্ধদেবের আরাধনা চলেছে। এখানে ফটো তোলা বারণ। এই শান্ত পরিবেশে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মন্ত্রচ্চারণ শুনছি। মনে হচ্ছে সারাজীবন তো এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যায়।

মন্দিরে থাকার ও অনেক কিছু শেখার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে খাওয়া দাওয়া ফ্রি। বোর্ডে মেনশন করা আছে নিরামিষ খাবার। এই দেখে অবশ্য ভক্তিভাব একটু কমেই গেল। চারিদিকে অনেক কোরিয়ান মহিলা তাদের ট্রাডিশনাল পোশাক হনবুক (Hanbok) পরে ঘোরাঘুরি করছেন। মন্দিরটি পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে তৈরী হয়েছে। পাহাড়ি কোরিয়ানদের কাছে এই চড়াই উৎরাই কোনো ব্যাপার ই নয়।

কিন্তু আমাদের কাছে খুবই কঠিন কাজ। লাঞ্চের সময়ও পেরিয়ে গেছে। খালি পেটে কোনো কিছুতেই মন বসে না। মন্দির চত্বর থেকে দীর্ঘ সিঁড়ি নীচে বাস স্টপেজে নেমে গেছে। ওখানে প্রানভরে বিমবাপ্( bibimbap )খেলাম। এই ডিশে ভাতের উপর মাংস, ডিম্ সবজি ভাজা আলাদা আলাদা করে সাজানো থাকে। হেমন্তের বেলা শেষে আরো রঙিন হয়ে ওঠা প্রকৃতি ও মন্দির কে পেছনে ফেলে ফেরার বাস ধরলাম। ছবি-লেখক৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here