পার্থ সারথি নন্দী , বনগাঁ: পুরভোটের ঠিক দু’দিন আগেই অর্থাৎ শুক্রবার রাত থেকেই শুরু হয়েছিল৷ বনগাঁ পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী মলয় আঢ্য থানায় অভিযোগ জানালেন প্রচারের ফাঁকে তিনি এবং দলের কয়েকজন কর্মী রাখালদাস হাইস্কুলের সামনে রাস্তার ধারের একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তখন এক দুষ্কৃতী সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে হেনস্থা করে। এমন কি টোটোতে করে যাওয়ার সময় তাঁর টোটো উল্টে দেওয়ারও চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা ছাড়ায় ৩ নম্বর ওয়ার্ড ফুলতলা থেকে ১৭ নম্বর ওয়ার্ড শিমুলতলা পর্যন্ত৷ আর তার ঝাজ ছিল এতটাই যে বনগাঁবাসীর প্রায় প্রত্যেকের মুখে একটাই কথা শোনাযাচ্ছিল যে, এবারের নির্বাচনের দিন রক্ত ঝড়বে এই দুটি ওয়ার্ডে৷ ফের পরদিন

শনিবার সকালে ১৭নম্বর ওয়ার্ড শিমুলতলায় বোমা ফেটে রক্তাক্ত হল এক দুষ্কৃতী। রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ আরও চড়ল গোটা শহর জুড়ে৷ এরপর শনিবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ বোমাবাজি হয় বনগাঁ পুরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের আরএস মাঠ এলাকায়। বাসিন্দারা লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। দুষ্কৃতীরা পালায়। পুলিশ গিয়ে একটি বোমা উদ্ধার করে।

রাত যত গভীর হয়েছে, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বোমাবাজি হয়েছে। বহিরাগতেরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শহরের অলি গলিতে বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় বলে অভিযোগ। অতীতে কোনও ভোটের আগে শহরে এমন বোমাবাজির কথা মনে করতে পারছেন না অন্তত বনগাঁর ভোটারেরা।

২৭ ফেব্রুয়ারীর সকাল থেকেই বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে একের পর এক বুথ দখল, ছাপ্পার অভিযোগ উঠেছে৷বিজেপি প্রার্থী সীমা বিশ্বাস কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘‘এক জনের ভোট অন্য জন দিয়ে দিচ্ছে। এ ভাবে কী ভোট হয়!’’

দুপুরে ১ নম্বরে ওয়ার্ডে বহিরাগতেরা ভোট লুট করতে আসে বলে অভিযোগ। বাসিন্দারা একজোট হয়ে তাড়া করেন। অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে পালায়। কয়েকটি বাড়ির কাচ, ইটপাটকেল মেরে ভেঙে দেয় তারা। কিছু বাইক ফেলে গিয়েছে।

বিরোধীদের অভিযোগ, হাতে গোনা কয়েকটি ওয়ার্ড ছাড়া সব ওয়ার্ডেই বহিরাগতেরা ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। অভিযোগ তির সব ক্ষেত্রেই তৃণমূলের দিকে। পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও ছিল দর্শকের, অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা।

সিপিএম নেতা পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘ব্যাপক রিগিং, সন্ত্রাস হয়েছে। দু’একটি ওয়ার্ড ছাড়া সব জায়গাতেই কমবেশি অবৈধ ভোট পড়েছে। বহিরাগতদের আটকাতে পারলে এই অবাঞ্ছিত পরিবেশ তৈরি হত না। আমাদের দাবি, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ফের ভোট করাতে হবে।’’

বিরোধীদের কথা অনুযায়ী হাতে গোনা কয়েকটি ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে , ৩ নম্বর ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ড৷ যা নির্বাচননের বহু আগে থেকেই বনগাঁবাসীর কাছে ছিল পাখীর চোখ৷

কারণ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এবারের তৃণমূলপ্রার্থী, পুরপ্রশাসক গোপাল শেঠ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস প্রার্থী মলয় আঢ্য যিনি প্রাক্তন পুরপ্রশাসক শঙ্কর আঢ্যর ভাই৷ অন্যদিকে ১৭নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থীও শঙ্কর বাবুর মেয়ে ঋতুপর্ণা আঢ্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল প্রার্থী প্রীতিকণা মন্ডল ৷

যত সময় গড়িয়েছে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চরম উত্তেজনা ছড়ায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে৷ কিন্তু রবিবার দিনভর ৩ নম্বরএবং ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে কড়ানজর ছিল পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের৷ পাশাপাশি ২২টি ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষও সজাগ দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন এই দু’টি ওয়ার্ডে৷ এই বুঝি বড়সড় কিছু দুর্ঘটনা ঘটল৷

প্রায় সকলের মনের ধারণা বদলে দিয়ে বাস্তব চিত্রটা যখন ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৫টা পেড়ল তখন দেখা গেল এই দুটি ওয়ার্ড ছাড়া ২০টি ওয়ার্ডের ব্যাপক রিগিং, সন্ত্রাস-এর ছবিটা সবার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের পর্দায়৷

৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার ফুলতলার বাসীন্দা বাসন্তীবালা দাস নিজের ভোট দিয়ে বুথ থেকে বেড়িয়ে এসে জানান, পায়ে আর কোমড়ে খুব ব্যথা ছিল তবে এবার নির্বিঘ্নে ভোটটা দিতে পেরে মনে কোন ব্যথা নেই। ১৭নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সহেলী দত্ত বলেন বিন্দু মাএ চিন্তা হয়নি ভোট দিতে এসে বুথে এবং বুথের বাইরের পরিবেশ ছিল বসন্ত উৎসবের সকালের মতো৷

অন্যদিকে এদিন ,পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে সেই সময় বিজেপি, সিপিএম, নির্দল প্রার্থীরা। নির্দল প্রার্থী সুমিত্রা দত্ত রায়ের দাবি, তাঁকে এবং দুই মেয়েকে মারধর করে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়। দু’টি মোবাইল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সুমিত্রা বলেন, ‘‘আমার মেয়ে এজেন্ট ছিল। তাঁকে বসতে দেওয়া হয়নি। প্রতিবাদ করলে মারধর করা হয়।’’

পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটগ্রহণ কেন্দ্র ছিল শক্তিগড় হাইস্কুলে। বিজেপি প্রার্থী দীপ্তেন্দু বিকাশ বৈরাগীর অভিযোগ, বহিরাগতেরা ছাপ্পা মারে। প্রতিবাদ করায় তাঁকে মারধর করা হয়েছে। বুথের কাছে বোমাবাজিও হয়। বিজেপি এজেন্ট লক্ষ্মণচন্দ্র ঘোষকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। বাটারমোড় এলাকায় যশোর রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি।

ছাপ্পা, সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডেও। দুষ্কৃতীরা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের মারধর করে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বাঁচাতে গেলে দু’জন স্কুল শিক্ষিকা তথা সিপিএম কর্মীকে দুষ্কৃতীরা মারধর, গালিগালাজ করে বলে অভিযোগ।

দুপুরে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে জীবনী কলোনি জিএসএফপি স্কুলে তৃণমূলের লোকজন ছাপ্পা দেয় বলে অভিযোগ। কংগ্রেস প্রার্থী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়ের মোবাইল কেড়ে নিয়ে তাঁকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। মহিলারা প্রতিবাদ করায় দুষ্কৃতীরা পালায়। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী বন্দনা মুন্সির স্বামী সত্যেন্দ্র মুন্সির পাল্টা অভিযোগ, তিনি ভোট দিতে গিয়ে দেখেন কংগ্রেস প্রার্থী দেবযানী এবং তাঁর স্বামী শুভম বহিরাগতদের জড়ো করেছেন। প্রতিবাদ করলে তাঁদের নির্দেশে মারধর করা হয়। সত্যেন্দ্রের মাথায় তিনটি সেলাই পড়েছে।

বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিজেপির অশোক কীর্তনীয়া বলেন, ‘‘ভোটের নামে প্রহসন হল। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হল। পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে এ সব করিয়েছে।’’

অশান্তির অভিযোগ অস্বীকার করে বনগাঁ পুরভোটে তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘বিরোধীরা মাঠে ছিল না। মানুষ ওদের সঙ্গে নেই। শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। বিরোধীশূন্য বোর্ড হবে।’’

বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার বলেন, ‘‘কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।’’

১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার পিয়ালী দত্ত জানান, বাংলায় আগামীদিনের নির্বাচন হোক বনগাঁর ৩ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মত৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিটা এখানেই প্রকৃত উজ্বল৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here