শম্পা গুহ মজুমদার

 

২০২২ সালের কথা। করোনার পর প্রথম ভ্রমণ। দুই বছরের ঘরবন্দি জীবন কাটিয়ে মেয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে দ্বিতীয়বারের জন্য কানাডা যাত্রা করলাম। বাইশ সালের মাঝামাঝি হলেও করোনার সাবধানতা চলছেই। টরন্টো খুবই দূরের রাস্তা, করোনার বাতাবরণে বেশ চিন্তায় ছিলাম। আগেরবার যখন এসেছিলাম কানাডার পূর্ব দিক ও আমেরিকার কিছু জায়গা বেড়াতে গেছিলাম। সেইসব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম। টরন্টো থেকে যাবো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সাহস করে সাতদিনের প্যাকেজ ট্রিপ নিলাম। সাতদিনে কানাডার পাঁচটি প্রদেশ ঘুরে দেখবো।

ছবি : শম্পা গুহা মজুমদার।

পুরোটাই বাস জার্নি। ১৩টি প্রদেশ নিয়ে এই মহাদেশ গঠিত। আমরা টরন্টো মানে ওন্টারিও প্রদেশ থেকে রওনা হয়ে ক্যুবেক(Quebec), নিউ বার্নসিক(New Brunswick), নোভাস্কোশিয়া(Nova Scotia) হয়ে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড(Prince Edward Island) প্রভিন্সে যাবো এবং ওখান থেকে আবার টরন্টো ফিরবো। অর্থাৎ সাতদিনে পাঁচটি প্রদেশের দর্শনীয় স্থান দেখে নেবো। কানাডার জনসংখ্যা, তিন কোটি বিরাশি লক্ষ। প্রায় ১০০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই বৃহৎ দেশে স্কোয়ার কিলোমিটার পিছু চার জন লোক বাস করে। ভারতের ৩৩ লক্ষ্য বর্গ কিলোমিটার আর জনসংখ্যা ১৪২ কোটি।

এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে কানাডাতে মাইলের পর মাইল জায়গা খালি পড়ে আছে। সাত দিনে আমরা ৩৪২৫ কিলোমিটার বাসে করে যাত্রা করবো। এটা আমাদের দেশে কল্পনাও করা যাবে না। এখানে বাসের গতিবেগ ঘন্টা প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার বলেই সম্ভব। প্রথম দিন টরোন্টো থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে থাউস্যান্ড আইল্যান্ড(Thousand Islands) দেখে, কানাডার রাজধানী অটোয়া(Ottawa) হয়ে সন্ত-হায়াসিন্থে(Saint-Hyacinthe) আমাদের রাত্রিবাসের প্রগ্রাম।


থাউজেন্ড আইল্যান্ড বা ‘হাজার দ্বীপপুঞ্জ’ হল কিংস্টন থেকে ব্রকভিল পর্যন্ত সেন্ট লরেন্স নদীতে অবস্থিত ১৮০০ টিরও বেশি দ্বীপের একটি নক্ষত্রপুঞ্জ। ২০১৭ তে একটা ছোট ট্রিপে এখানে এসেছিলাম। পাঁচ বছরে থাউজেন্ড আইল্যান্ডের বাগান আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। প্যাকেজ ট্যুরে এলে খুব সুবিধা, বাস থেকে নেমেই দেখি আমাদের বোট বা লঞ্চের টিকেট নিয়ে গাইড দাঁড়িয়ে আছে। বাসে আমরা ৩০/৩৫ জন আছি। সবাই এশিয়ান কান্ট্রির। চাইনিজ গাইড আমাদের মতন বাংরেজি বলছে।

সহযাত্রীরা সবাই চাকুরেজীবি আর বেশ হিসাব করে চলছেন। নিজেদের মতন লোকজন পেয়ে আমরাও খুশি। আমাদের পেছনের সিটে বসা হাসিখুশি গুজরটি ভদ্রলোক আবার কোলকাতাতে ছিলেন। তাই পরিষ্কার বাংলাতে কথা বললেন। তার মানে বাসের মধ্যে আমাদের মনের আনন্দে বলা সব ব্যক্তিগত কথাবার্তা ও তক্কাতক্কি নিশ্চই উনি এনজয় করেছেন।

কানাডার পতাকা লাগানো খুব সুন্দর একটা লঞ্চে উঠে পড়লাম। চারিদিকে নীল জলরাশির মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ। দূষণ মুক্ত আকাশে সূর্যের ছটা জলের উপর ঠিকরে পড়ছে। সেন্ট লরেন্স নদীর ঠিক মাঝখান দিয়ে সীমান্ত-রেখা আমেরিকা ও কানাডাকে বিভক্ত করেছে। চারিদিকে ছোট, খুব ছোট্ট ও মাঝারি দ্বীপপুঞ্জ ছড়িয়ে রয়েছে। গাইড কোনটা আমেরিকার আর কোনটা কানাডার দ্বীপ ও ইতিহাস সহ দীপ গুলোর নাম ঘোষণা করে চলেছেন। সব থেকে জমকালো হলো বোল্ডট ক্যাসেল(Boldt Castle), এটি সেন্ট লরেন্স নদীর হার্ট আইল্যান্ডে অবস্থিত। বোল্ডট ক্যাসেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যের হাজার দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলের একটি প্রধান ল্যান্ডমার্ক। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে অতিথিদের জন্য এটি খোলা থাকে। জলের মধ্যে কোথাও দেখছি একটা ছোট্ট বাড়ি আর সেটাই একটা দ্বীপ। হাব আইল্যান্ড, জাভিকন, হার্ট আইল্যান্ড ইত্যাদি আরো কত দ্বীপ।

কোনটা কোন দেশের সেই হিসাবে না গিয়ে দুই চোখ ভোরে প্রকৃতির শোভা দেখে চলেছি। চোখ ঝলসানো আকাশ আর জলের নীল নেশা কাটিয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম। এবার প্রায় দুশো কিলোমিটার পথ যেতে হবে। ঝাঁকুনি বিহীন বাস যাত্রা তাই দুই ঘন্টাতেই রাজধানীতে পৌঁছে গেলাম। কুড়ি মিনিটে পার্লামেন্ট হাউস দেখে নিতে হবে, তারপর মিউজিয়াম দেখবো। অটোয়া শহরটি কানাডার অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ক্যুবেক(Quebec) প্রদেশের সাথে সীমানাতে, গাতিনো নদী, রিদো নদী ও অটোয়া নদী তিনটির সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। অটোয়া নদী অন্টারিও কিউবেক প্রদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সীমান্ত গঠন করেছে।

এখানে পার্লামেন্ট হাউস তিনটি গথিক রিভাইভাল-স্টাইলের বিল্ডিং, অটোয়া নদীর ধরে উঁচু টিলার উপর অবস্থিত, এখানে সংসদ সদস্যদের অফিস, হাউস অফ কমন্স এবং সেনেট রয়েছে। পার্লামেন্ট হাউসের সামনে শতবর্ষী শিখা বা সেন্টেনিয়াল ফ্লেইম (ফরাসি: Flamme du centenaire) বেশ ইন্টারেষ্টিং, সবসময় এটি প্রজ্বলিত থাকে। এর মাঝের ফোয়ারা শীতকালেও জমে যায় না। এটি হল কানাডিয়ান কনফেডারেশনের ১০০ তম বার্ষিকী স্মরণে সংসদ ভবনের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

এবার যাবো ‘কানাডিয়ান মিউজিয়াম অফ হিস্ট্রি’ মিউজিয়ামে।গতবার দেখেছিলাম। খুব ভালো লেগেছিলো। বিশেষ করে ‘ফার্স্ট পিপলস হল’। ‘ফার্স্ট পিপলস হল’ কানাডার ফার্স্ট নেশনস, ইনুইট এবং মেটিস জনগণকে উৎসর্গ করে খোলা হয়েছিলো। চার হাজার বছর আগে উত্তরের নুনাভাট (Nunavut) এলাকা থেকে এই ইন্ডিজেনাস বা আদিবাসী মানুষেরা দক্ষিণ দিকে চলে আসতে থাকে। মিউজিয়ামে এদের প্রাচীন ইতিহাস, আদিবাসী ভাষা এবং আদিবাসী ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাসের নিদর্শন সুন্দর করে প্রদর্শিত করা আছে। আমাদের দলের অনেকেই দেড় হাজার টাকা দিয়ে হলে ঢোকার টিকেট না কেটে মিউজিয়ামের রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করছেন।

যেহেতু আগের বার ঘুরে দেখেছি তাই সুভেনিয়ার শপ থেকে টুকটাক কেনাকাটি, ফটো তোলা আর খাওয়াদাওয়া করে সময় কাটালাম। কেউ অটোয়া গেলে অবশ্যই এই বিখ্যাত মিউজিয়াম দেখে নেবেন। এখানে আরো অনেক মিউজিয়াম আর আর্ট গ্যালারি আছে। বাস থেকেই ন্যাশনাল গ্যালারি অফ কানাডার ফটো নিলাম। শহর ছেড়ে বাস পুবমুখো ছুটে চলেছে। সাতটার আগেই ডিনারের জন্য বাস থামবে। বিশাল বুফে ডিনার খেলে সত্যি রাতে আর খিদে পায় না। নাম না জানা অতি ছোট্ট একটা শহর সেইন্ট-হায়াসিন্থে আমাদের হোটেল ও রাত্রিবাস। আজ ছয়শো কিলোমিটার পথ চলেছি। খুব ভালো বাস ও চালক, তাই যতটা ক্লান্ত হওয়ার কথা ততটা হইনি। আর হোটেলটা খুবই আরামদায়ক। কাল আবার ভোরবেলা রওনা দিতে হবে। যেতে হবে নিউ বার্নসউইক প্রদেশের ফ্রেডেরিক্টন শহরে (New Brunswick-Fredericton)।

যাত্রার দ্বিতীয় দিনে এবারের গন্তব্য ৭৫৯ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে নিউ বার্নসউইক প্রদেশের ফ্রেডেরিক্টন শহর (New Brunswick-Fredericton)। ফ্রেডেরিক্টন হল কানাডার নিউ বার্নসউইক প্রদেশের রাজধানী। এই দীর্ঘ যাত্রা পথে বেশি কিছু দ্রষ্টব্য নেই। বাসের জানালা দিয়ে প্রানভরে দেখছি কানাডার মাইলের পর মাইল বনভূমি আর সবুজ প্রান্তর। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতন জনহীন ছোট ছোট শহর ও গ্রাম। আজ বার্গার আর হটডগ দিয়ে লাঞ্চ সারা হলো। নাম না জানা এক ছোট জনপদে বার্গারের দোকানে দেখা হয়ে গেল দুটি বাংলাদেশি ছেলে মেয়ের সঙ্গে।

পাঁচ মিনিটে কত যে বাংলা কথা বললাম। এরপর বাস থামলো হার্টল্যান্ড শহরে। ছবির মতো শহরটি বিশ্বের দীর্ঘতম আচ্ছাদিত সেতু, ‘হার্টল্যান্ড কভার্ড ব্রিজে’র জন্য বিখ্যাত। এটি নিউ ব্রান্সউইকের সেন্ট জন নদীর উপর অবস্থিত। কাঠের পাটাতন আর ছাউনি দেওয়া ব্রিজ আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। বেশ ইন্টারেষ্টিং লাগলো। এটি কানাডার একটি হেরিটেজ ব্রিজ। সেন্ট জন নদীর ভ্যালি আলু উৎপাদনে খুব প্রসিদ্ধ। এখানেই রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন পটেটো চিপস ফ্যাক্টরি।

এখনো এই ফ্যাক্টরিতে সেই পুরানো পদ্ধতিতে চিপস বানানো হয়। লাঞ্চের খাবার অনেক আগেই হজম হয়ে গেছে। তাই সবাই আগ্রহ সহকারে চিপস ফ্যাক্টরিতে ঢুকে পড়লাম। চিপসের দাম দেখে অবশ্য একটু থমকে গেলাম। যদিও এত ঐতিহ্যপূর্ণ চিপস খেয়েও কেমন যেন স্বাদ পেলাম না। সূর্যাস্তের আগেই ফ্রেডেরিক্টন শহরে পৌঁছে গেলাম। ছিমছাম সুন্দর শহর। বিকেল ছটাতেই ডিনার খেতে হলো। সেন্ট জন নদীর ধারেই হোটেল। অসাধারণ এক সূর্যাস্তের সাক্ষী রইলাম।

কাল যাবো নোভা-স্কোশিয়া(Nova Scotia) প্রভিন্সের হ্যালিফ্যাক্স শহরে (Halifax)। ৪৩৫ কিলোমিটার যাত্রাপথ।অনেক জায়গা দেখার আছে। চারিদিকে উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রের ঘেরাটোপ আর সবুজের সমাহার নোভা স্কোশিয়া প্রভিন্সকে বিখ্যাত একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। রাস্তার দৃশ্য খুবই সুন্দর। টি-ব্রেকে ফুলে ঢাকা এক পার্কে বাস থামলো। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চার ঘন্টা কেটে গেল, এসে পৌঁছলাম হ্যালিফ্যাক্স শহরে। পৌনে তিনশো বছর আগে ব্রিটিশদের হাতে এই শহরের গোড়াপত্তন। হ্যালিফ্যাক্স নামটা শুনেই কেমন চেনা চেনা লাগছে তো !

১৯১২ সালে যখন টাইটানিক ডুবে যায় তখন এই শহর থেকেই উদ্ধারকারী জাহাজ ৭০০ নটিক্যাল মাইল দূরে রওনা হয়েছিল। শহরের ‘ফেয়ারভিউ’ কবরস্থানে একশোরও বেশি টাইটানিকের নিহিত যাত্রীদের কবর দেওয়া হয়েছিল। এটিও একটি দ্রষ্টব্য স্থান। আমাদের বাস একদম শহরের হারবারে নামিয়ে দিলো। পোর্ট বলে মনেই হচ্ছে না। নাচ, গান ও খাবারের দোকানে জমজমাট, যেন মেলা প্রাঙ্গন। এখান থেকেই ‘হারবার হপার'(Harbour Hopper) টুর নেবো। এই নৌকোর মতন বাসে চড়েই আমরা আধ ঘন্টা শহরে ঘুরবো আবার আধ ঘন্টা এই বাস জলেও চলবে। আমরা সবাই বেশ উত্তেজিত। কারণ এরকম উভচর যানে প্রথম চড়ব।

রংচঙে বাসের সামনে ফটো তোলার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে নৌকা বা বাস-বিহার খুবই মনোজ্ঞ অভিজ্ঞতা হলো। গাইড আশেপাশের জাহাজ, সাবমেরিন ও শহরের নানা ইতিহাস বেশ প্রাঞ্জল ভাষাতে বর্ণনা করে চলেছেন। ১৯১৭ সালে এই হ্যালিফ্যাক্স বন্দরে দুটি বিস্ফোরক বোঝাই জাহাজের ধাক্কার অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে দুহাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এটম বম্বের আগে এটাকেই সব থেকে বড় ম্যান মেইড এক্সপ্লোশন হিসাবে ধরা হয়। উভচর যানে সাইট সীন খুব ভালোই হলো।

হাল্কা লাঞ্চ সেরে এবার আমাদের বাসে করে ৪০ কিলোমিটার দূরে ছোট মাছ ধরার শহর পেগিস কোভে(Peggys Cove) এসে পৌঁছোলাম। সেন্ট মার্গারেট উপসাগরে অবস্থিত, ৬৪০ জন সংখ্যার এই শহর পেগিস পয়েন্ট লাইটহাউসের জন্য সুপরিচিত। জুন মাসেও আটলান্টিকের ঠান্ডা হওয়াতে বেশ শীত করছে। কাঁকড়ার স্ট্যাচু ওয়ালা রেস্টুরেন্টে গরম কফি খেয়ে ক্লান্তি দূর হলো। হ্যালিফ্যাক্স শহরেই আজ রাত্রিবাস। কাল যাবো হ্যালিফ্যাক্স থেকে ‘প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড’ প্রভিন্সের শার্লোটি শহরে(Charlottetown)।


Halifax – Prince Edward Island – Charlottetown – Moncton (388 km)

হ্যালিফ্যাক্স থেকে পরদিন সকালবেলা প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ ৩৮৮ কিমি জার্নি করে রাতে থাকবো মনকটন (Moncton) শহরে। বেশ মেঘলা আকাশ। হালকা বৃষ্টিও হচ্ছে। রাস্তাতে যে যে টুরিস্ট স্পট পড়বে তা দেখে নেব। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড কানাডার সবচেয়ে ছোট প্রদেশ। আমরা নিউ বার্নসউইক প্রদেশ থেকে ফেডারেশন ব্রিজ(Confederation Bridge) পেরিয়ে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে প্রবেশ করলাম।

প্রায় ১৩ কিমি লম্বা ফেডারেশন ব্রিজ কানাডার দীর্ঘতম সেতু। এটি আবার পৃথিবীর মধ্যে, শীতকালে বরফ হয়ে যাওয়া জলের উপর লংগেস্ট ব্রিজ হিসাবেও খ্যাত। এই ব্রিজ কানাডার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রদেশকে যুক্ত করেছে। ব্রিজ পেরিয়ে বাস থামলো ‘মেরিন রেল হিস্টোরিক্যাল পার্কে’। 

এখান থেকে  ব্রিজের ভিউ  খুব সুন্দর দেখা যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম শার্লটটাউন(Charlottetown) শহরে। এটি কানাডার প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রদেশের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। ১৮৬৪ সালে এখানে শার্লটটাউন সম্মেলন আয়োজিত হয়। যার ফলস্বরূপ কানাডিয়ান কনফেডারেশন গঠিত হয়। পুরানো চার্চ, হেরিটেজ বিল্ডিং, দোকান-বাজার সব হেঁটেই ঘুরে নিলাম। সমুদ্রের ধারে জমজমাট জেটিতে এসে বসলাম। কলকাতা থেকে বারো হাজার কিমি দূরে উত্তর আটলান্টিকের নোনা বাতাসে কেমন যেন চেনা গন্ধ। আলুভাজা সহ গরম কফিতে চুমুক দিয়ে শরীরের ক্লান্তি দূর হলো।

এবার যাচ্ছি প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড ন্যাশনাল পার্কের সেই আইকনিক বাড়ি, ‘অ্যান অফ গ্রিন গেবলস হাউস’ ও মিউজিয়াম দেখতে। বিখ্যাত কানাডিয়ান লেখিকা এলএম মন্টগোমারির (L.M. Montgomery) ১৯০৮ সালে লেখা শিশু উপন্যাস, ‘অ্যান অফ গ্রিন গেবলস’ (Anne of Green Gables) খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি যদিও গ্রিন গেবলস হাউসে বাস করেননি, কিন্তু ওঁনার গল্পে বর্ণিত বাড়িটি এই বাড়ির অনুপ্রেরণাতেই লেখা। ফুল আর চোখ জুড়ানো সবুজের ঘেরাটোপে স্বপ্নের এই বাড়ি দেখার পর উপন্যাসটি পড়ার জন্য পর্যটকরা অবশ্যই উৎসাহিত হবেন। পার্ক লাগোয়া জাদুঘরে লেখক ও বইটি সম্পর্কিত তথ্য সুন্দর ভাবে প্রদর্শন করা আছে।

পরের গন্তব্য ক্যাভেন্ডিশ বিচ (Cavendish Beach)। মেটে বালির বেশ অন্যরকম এই সমুদ্র সৈকত দেখে ভালো লাগলো। এই বিচের সঙ্গেও ‘অ্যান অফ গ্রিন গেবলস’ বইয়ের ঘটনা জড়িত আছে।

সকালেই গাইড বলে দিয়েছিলো আজকের ডিনার লবস্টার রেস্টুরেন্টে হবে । ঘড়িতে এখন সবে পাঁচটা বাজে। খিদে পাক বা না পাক রাতের খাবার এখনই খেয়ে নিতে হবে। গলদা চিংড়ির ছবি আঁকা ছিমছাম রেস্টুরেন্টে আমাদের খুব আদর যত্ন সহকারে বৃহৎ আকারের লবস্টার, সুপ্ আর স্যালাড সহ পরিবেশন করলো। এর অসামান্য স্বাদ বহুকাল ভোলা যাবে না। আমাদের গ্রূপের সবাই এশিয়ান হওয়াতে বেশিরভাগ চাইনিস রেস্টুরেন্টেই খাওয়াতে নিয়ে যেত। তাই ভেতো বাঙালি ভাতের অভাব কোথাও বোধ করিনি।

আবার ফেডারেশন ব্রিজ পেরিয়ে নিউ বার্নসউইক প্রভিন্সে এলাম। এবার দেখবো পৃথিবীর সব থেকে বড় লবস্টার স্ট্যাচু। ঝকঝকে নীলাকাশ আর ঘন নীল সমুদ্রের ধারে খুবই প্রাণবন্ত গলদা চিংড়ির মূর্তি। কত যত্ন সহকারে রাখা আছে। আর আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের পুরানো কত শত মূর্তি কি যে অবহেলাতে পড়ে আছে ভেবে একটু দুঃখ হলো।

গলদা চিংড়ি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি দেখে একটু হিংসা আর কি। আজ মনকটন শহরে (Moncton) রাত্রিবাস। কাল যাবো ‘হোপওয়েল ন্যাশনাল পার্ক’ (Hopewell National Park )।

ছবি ও লেখা, শম্পা গুহা মজুমদার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here