দেশের সময়: আসন একটাই। দলও একই। অথচ প্রার্থী দু’জন। নেতা বনাম নেতা-পুত্র। আর এনিয়ে বনগাঁয় তৃণমূলের কোন্দল তুঙ্গে। একজনের পরিচয় যদি হয় পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। অন্যজনের পড়াশোনা, অধ্যাপনা ছেড়ে রাজনীতিতে অভিষেক।

শুভজিৎ দাস ৷

পঞ্চায়েত ভোটের আবহে এখন উত্তর ২৪ পরগনায় জেলা পরিষদের ৫ নম্বর আসনেই নজর সবার। কারণ, এই আসন থেকেই তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা চেয়ারম্যান শ্যামল রায়। অন্যদিকে, এই আসনেই তৃণমূল প্রার্থী দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের ছেলে শুভজিৎ দাস। ফলে শেষপর্যন্ত কে তৃণমূলের প্রতীক পাবেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর লড়াই। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না বিরোধী দলগুলি। অনেকেই এটাকে আদি ও নব্য তৃণমূলের দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখছেন। বলছেন, এসবই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার কর্মসূচির ফল।

ব্রাত্য’ হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের অনেক সিনিয়র নেতা-ই।

উত্তর ২৪ পরগনায় জেলা পরিষদের মোট ১৩টি আসন। এর মধ্যে ১১টিতেই এবার নতুন মুখ। জেলা পরিষদের ৫ নম্বর আসন থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের পুত্র শুভজিৎ। ছ’টি পঞ্চায়েত নিয়ে রয়েছে এই আসনটি। এর মধ্যে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত বাগদা বিধানসভার অন্তর্গত, তিনটি বনগাঁ বিধানসভার অধীনে। যে ছ’টি পঞ্চায়েত জেলা পরিষদের ৫ নম্বর আসনের আওতায় রয়েছে সেগুলি হল গাড়াপোঁতা, ট্যাংরা, সুন্দরপুর, ছয়ঘরিয়া, ঘাটবাওড় ও ধরমপুর। এই আসন থেকেই মনোনয়ন জমা দিয়ে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন শুভজিৎ। বিরোধীদের তোপ উড়িয়ে সদ্য রাজনীতিতে পা রাখা ভুগোলে স্নাতকোত্তর শুভজিৎ বললেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছেন, তাই ত্রিস্তর ভোটের ময়দানে নেমেছি। প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছি।

কিন্তু যে দলের হয়ে মনোনয়ন জমা করলেন, সেই দলের অনেকেই তো দুর্নীতির অভিযোগে জেল খাটছে, পড়াশোনা ও অধ্যাপনা ছেড়ে এমন একটি দলের হয়ে প্রার্থী হলে ভাবমূর্তিতে কোথাও প্রভাব পড়বে না? শুভজিতের সাফ জবাব, আমার মনে হয়, খারাপকে ভাল করতে পারাটাই আসল কাজ। সবাই মিলে যদি সঠিকভাবে কাজ করা যায়, তা হলে সমাজটা সুন্দর হতে পারে। এটা খুবই দরকার আছে। কতটা করতে পারব জানি না। তবে নিজে তো চেষ্টা করবই। আমার বিশ্বাস আছে, আমাকে দেখে অন্তত একজনও যদি নিজের কাজটা সুন্দর করে করার চেষ্টা করেন, তাহলেই আমার সাফল্য। শুভজিতের কথায়, কিছু খারাপ তো হয়েছে, এটা না বলার কিছু নেই। কিন্তু সেই খারাপের জন্য মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে হবে না। খারাপকে ভাল করতে হবে। তৃণমূল গ্রাম-শহরের যেভাবে উন্নয়ন করেছে, মানুষের জন্য রাস্তা, আলো, জলের ব্যবস্থা করেছে, বিরোধীরাও তা অস্বীকার করতে পারবেন না।

কখনও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? শুভজিৎ বললেন, অনেকবার কথা হয়েছে দিদির সঙ্গে। আমি যখন দিল্লি থাকতাম, দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে, অনেক কথা হয়েছে। কিছুদিন আগেও বিধানসভায় দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। আশীর্বাদ নিলাম। আর অভিষেকদা’র সঙ্গেও কথা হয়েছে একাধিকবার। বলতে পারেন, অভিষেকদা’কে দেখেই আমার সক্রিয় রাজনীতিতে আসা। এমননিতে আমি পিছনে থেকে কাজ করতে ভালবাসি। কিন্তু অভিষেকদা আমাকে বলেছেন, তোর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন। পঞ্চায়েতে প্রার্থী হবি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিই, মানুষের জন্য কাজ করতে হলে এটার প্রয়োজন আছে।

বিশ্বজিৎ-পুত্র শুভজিৎ দ্বাদশ শ্রেণি পাশের পরই চলে যান কলকাতায়। সেখানে ভর্তি হন আশুতোষ কলেজে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করেন। ২০১৩ সাল নাগাদ অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বনগাঁ কলেজে। এক বছর পড়িয়েছেন। কিন্তু কোনও সান্মানিক নেননি। তাঁর প্রাপ্য অর্থের সবটাই দান করেছেন কলেজের ফান্ডে। যেসব গরিব ছেলেমেয়েরা পয়সার অভাবে পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করতে পারেন না, তাঁদের সাহায্য করার জন্য ওই অর্থ কাজে লাগানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করেন শুভজিৎ। কলেজে অধ্যাপনা ছেড়ে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে তিনি চলে যান দিল্লি। সেখানেই কোচিংয়ে পড়তে পড়তে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি চাকরি পান। কিন্তু তাঁর জীবনের স্বপ্ন আইএএস হওয়া। ফলে ওই চাকরি করেননি। ইউপিএসসিতে একবার মাত্র দু’নম্বরের জন্য সাফল্যের চাবিকাঠি হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ বিধায়ক-পুত্র।

শুভজিৎ-এর কথায় , ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বাবা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাবার কাছে বহু মানুষ তাঁদের নানা অভাব অভিযোগ নিয়ে আসেন। বাবা সেসবের সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টা করেন। এসব দেখে দেখে রাজনীতির প্রতি বরাবরই একটা আকর্ষণ ছিল। কিন্তু নিজের পড়াশোনা, স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এগোতে গিয়ে রাজনীতিতে সেভাবে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন অভিষেকদা বলার পর মনে হয়েছে, এবার রাজনীতিটা করা দরকার। ভোটে দাঁড়ানো উচিত। অন্তত মানুষের জন্য কিছু করতে গেলে এটা দরকার।

কিন্তু প্রথমেই তো একটা বিতর্ক পিছু নিল। আপনি যে আসন থেকে মনোনয়ন জমা করলেন, সেই আসনেই তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান শ্যামল রায়। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। আগেও জেলা পরিষদে দাঁড়িয়েছেন। জিতেওছেন। দু’জনের এভাবে একই আসনে প্রার্থী হওয়া একটা খারাপ বার্তা গেল না? শুভজিতের উত্তর, একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ওটা কোনও ব্যাপার নয়। শ্যামলকাকু মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন।

কিন্তু শ্যামলবাবু যে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন, এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে? বিধায়ক-পুত্রের জবাব, দল আমাকে প্রার্থী হতে বলেছে। তার চেয়ে বড় কথা, খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছেন যে আমি প্রার্থী হই।

শুক্রবার থেকেই ছোট ছোট মিটিংয়ে যোগ দিচ্ছেন শুভজিৎ। শনিবার মাঝেরগ্রাম কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে প্রচারের প্রস্তুতি নিয়েছেন। স্ক্রুটিনি শেষে প্রতীক পেয়ে গেলেই , রবিবার থেকে পুরোদমে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান বিধায়ক-পুত্র।

এদিকে, তিনি যে আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, সেই আসনেই বিধায়ক-পুত্রের মনোনয়ন জমা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান শ্যামল রায়। তবে দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তথা বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেছেন, ৫ নম্বর আসন নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। শ্যামল রায় মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন।

তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি’র বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি নারায়ণ ঘোষ বলেছেন, দল যাকে প্রতীক দেবে, আইএনটিটিইউসি তার হয়েই প্রচারে ঝাঁপাবে। শুভজিৎ দাসকে দল প্রার্থী করেছে বলে জানি। ওই আসনে শ্যামল রায়ের মনোনয়ন জমা ব্যক্তিগত ভাবনা বলেই মন্তব্য করেছেন তিনি। একইসঙ্গে তাঁর দাবি, দলে কোনও কোন্দল নেই। এটা নিয়ে বিরোধীরা জলঘোলা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এসবে কোনও লাভ হবে না। 

যদিও বিষয়টিকে তৃণমূলের আদি ও নব্যর লড়াই বলে তোপ দেগেছেন বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক অশোক কীর্তনিয়া। বলেছেন, মানুষ তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ এখনও ওরা ক্ষমতার স্বাদ পেতে মরিয়া। তাঁর দাবি, পঞ্চায়েত ভোটে বনগাঁয় তৃণমূল জেতা তো দূরের কথা, তৃতীয়স্থান পাবে। সর্বত্রই জয়লাভ করবে বিজেপি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here