দেশের সময়: জগৎজননী শ্রীশ্রী মা সারদা কলকাতায় এলেন। কিন্তু থাকবেন কোথায়? আশ্রয় নিলেন ভাড়াবাড়িতে। নানা অসুবিধা সেখানে। কিন্তু মা কোনওদিন মুখ ফুটে কিছু বলেননি। তবে দেখেশুনে বুঝতে পারলেন ঠাকুরের শিষ্যরা। সিদ্ধান্ত নিলেন মায়ের জন্য একটা স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করতে হবে। শুরু হল বাগবাজারে মায়ের বাড়ি তৈরির উদ্যোগ।

এগিয়ে এলেন স্বামী সারদানন্দ। বাগবাজারে পাওয়া জমিতে ঋণ নিয়ে শুরু হল বাড়ি তৈরির কাজ। বাড়ি তৈরি শেষ হলে প্রিয় সন্তান সারদানন্দের আবেদনে সাড়া দিয়ে মা সারদা পদার্পণ করলেন নতুন বাড়িতে। সেই বাড়িই আজ বাগবাজারে মায়ের বাড়ি নামে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত। আর ওই বাড়িতে মায়ের পদার্পণ ঘটেছিল আজকের তিথিতেই। সেই উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার সকাল থেকেই বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে শুরু হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান। ভিড় জমিয়েছেন হাজার হাজার ভক্ত। প্রতিবারের মতো আজকের দিনটি পালিত হচ্ছে শ্রীশ্রী মায়ের শুভ পদার্পণ দিবস হিসেবেই।

মায়ের জন্মতিথির মতোই তাঁর শুভ পদার্পণ তিথিও ভক্তদের কাছে বিশেষ আনন্দের দিন। বিশেষ পুজো, হোম, মাতৃ প্রসঙ্গ আলোচনা, রামায়ণ গান ও মাতৃসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে পালিত হবে আজকের দিনটি। সঙ্গে ভক্তদের অংশগ্রহণে মুখরিত হবে বাগবাজার মায়ের বাড়ি। করোনার কারণে গত কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানে খানিকটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ঠিক। ফলে পুরনো ছন্দ ফিরে পেয়েছে দিনটি।

ভোর থেকেই ভক্তদের কোলাহলে গমগম করছে গঙ্গা তীরের মায়ের বাড়ি। আনন্দের হাট বসেছে বাড়িতে। বহু দূরদুরান্ত থেকে এসেছেন ভক্তরা। মায়ের পাশাপাশি তাঁরা স্মরণ করছেন স্বামী সারদানন্দকেও। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্যোগেই বাগবাজারে গড়ে উঠেছিল মায়ের বাড়ি। যা শুধু আজ নয়, ভবিষ্যতেও হাজার হাজার ভক্তের কাছে প্রাণ জুড়নোর শান্তির নীড় হয়ে থাকবে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অনুপম উপহার হিসেবে জগৎবাসীকে দিয়ে গিয়েছিলেন মাকে। আর তাঁর অন্যতম সন্তান শরৎ মহারাজ ভক্তদের উপহার দিয়েছেন শ্রীমার পূর্ণ অবস্থানে ধন্য বাগবাজারের মায়ের বাড়ি। বাগবাজার রামকৃষ্ণ মঠের তরফে জানানো হয়েছে, ভোর চারটেয় মঙ্গলারতি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।

এরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে বেদপাঠ, ভজন ও সানাই বাদন। তারপর বিশেষ পুজো, হোম ও চণ্ডীপাঠ। বেলা এগারোটায় প্রসাদ বিতরণ। সন্ধ্যারতি হবে পৌনে সাতটায়। উদ্বোধন কার্যালয়ে সারদানন্দ হলে মাতৃসঙ্গীত পরিবেশনে থাকছেন কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। শ্রীশ্রী মায়ের কথা পাঠ ও আলোচনা করবেন বাগবাজার রামকৃষ্ণ মঠের স্বামী ত্র্যম্বকেশানন্দ মহারাজ। স্বাগত ভাষণ দেবেন বাগবাজার রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ স্বামী নিত্যমুক্তানন্দ মহারাজ।

গ্রন্থপ্রকাশে থাকছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ স্বামী শিবপ্রদানন্দ মহারাজ। বক্তৃতা রয়েছে উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ মহারাজের। কালী কীর্তন পরিবেশনে রয়েছে কাঁকুড়গাছির শ্রীশ্রী সারদা কালীকীর্তন। বাউল পরিবেশন করবেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য। রয়েছে শান্তনু রায়চৌধুরীর ভক্তিগীতি। ভজন পরিবেশন করবেন শ্রীকান্ত আচার্য। রামায়ণ গান পরিবেশন করবেন কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠের স্বামী কল্যাণেশানন্দ মহারাজ।

১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল অর্থাৎ ১১ বছর বাগবাজারের বাড়িতে অবস্থান করেছেন মা সারদা। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ লেখার যে টাকা পাওয়া যায়, তা দিয়েই তৈরি করা হয়েছিল মায়ের বাড়িটি। এই বাড়িতে বহু বিশিষ্ট মানুষ এসেছেন নানা সময়ে। এখানে যেমন এসেছেন ভগিনী নিবেদিতা, তেমনই গিরিশচন্দ্র ঘোষও এসেছেন। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সোহরাব মোদি মায়ের শিষ্য ছিলেন। তিনি এসেছেন এখানে। আবার এসেছেন জোসেফ ক্লাউড। এসেছেন বিখ্যাত অভিনেত্রী তারাসুন্দরীদেবী। নন্দলাল বসুও এসেছেন বহুবার।

অরবিন্দ ঘোষ সস্ত্রীক এসেছিলেন। কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বাগবাজার মায়ের বাড়ি। এখানে বহু বিপ্লবীও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এখন যেখানে মায়ের বাড়ি, সেই জমিটি ছিল কেদারনাথ দাসের। তিনি জমিটি দান করেন। তাঁর একটাই শর্ত ছিল, এখানে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিত্য পুজো করতে হবে। এই প্রস্তাবে আনন্দিত হন শরৎ মহারাজ। যেখানে মা থাকবেন, সেখানে তো ঠাকুরের নিত্য পুজো হবেই। এ আর কঠিন কাজ কী! কিন্তু কিছুদিন বাড়ি তৈরির কাজ চলার পরই টাকা ফুরিয়ে যায়। তখন ঋণ করেন মহারাজ।

প্রথমদিকে মা এই বাড়িতে আসতে চাননি। পরে তিনি নিজেই খবর পাঠান, আসবেন। শরৎ মহারাজ নিজে গিয়ে মাকে নিয়ে আসেন। ১৯০৯ সালের ২৩ মে মা বাগবাজারের এই বাড়িতে আসেন। তিথি ধরেই মায়ের এই পদার্পণ দিবস পালন করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here