সৃজিতা শীল, পুরী  :

 

মনে পড়ে? ছোটবেলায় একটা সময় গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটির মানেই ছিল সদল বদলে সপরিবারে ঘুরতে যাওয়া? আর ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলেই অনেকের মনে উঠে আসত পুরীর নাম। শুধু গ্রীষ্মকাল বা শরৎকাল কেন, অফিস ট্যুর বলুন, কলেজের বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে প্রথমবার বাবা মা ছাড়া বেড়াতে যাওয়া, এমনকী বাঙালির আদি এবং অকৃত্রিম হানিমুন ডেস্টিনেশনও ছিল আমারদের এই পুরীর সমুদ্র সৈকত।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শনের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রভু জগন্নাথের পুজোর জন্য অপেক্ষা বা সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যদয় দেখার মধ্যে যে আমেজ আছে, তা কিন্তু বাঙালির মননে এবং অবচেতনে বংশানুক্রমে বেঁচে আছে আজও। আমাদের, কিংবা আগের প্রজন্মের এবং তারও আগে থেকেই অনেকেরই ভ্রমণের প্রথম হাতেখড়ি শুরু হয়েছে পুরীর হাত ধরেই।


পুরীর সৈকতে দেখা মেলে কলকাতার এক দম্পতি তাঁরা পুরীর সেকাল ও একাল নিয়ে কি বলছেন ? দেখুন ভিডিও

বাঙালির প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ বোধহয় লুকিয়ে আছে সমুদ্রতটে। সে বিয়ের পরে নবদম্পতির হানিমুনে একে অপরের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়া থেকে হোক বা ভেতো বাঙালির মহাসমুদ্র দর্শনের পর নিজেকে মহারাজ মনে হওয়ার অনুভূতি থেকেই হোক, সমুদ্র মানেই ছিল কিন্তু একটা রাজকীয় ব্যাপার। সমুদ্রতটের পাড়ে বসে, দিগন্তে সূর্যের ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভরে ওঠে নানা রঙের কারসাজিতে, আবার ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যেত সমুদ্র থেকে নৌকা বোঝাই মাছ নিয়ে ফিরে আসছে মাঝি ভাইরা। বিকেলবেলাতে হয়তো বিচের ধারে কোনও ছোট্ট দোকান থেকে কিনে খেতেন নানা রকম মাছভাজা, কাঁকড়া বা চিংড়ি মাছ।

সকলে মিলে পুরীর অগভীর সমুদ্রের জলে নেমে সারা সকাল দুপুর কাটিয়ে, স্নান করে, হই হুল্লোড় করে উঠে আসার মধ্যে ছিল শৈশবের আনন্দের ছোঁয়া। স্মার্টফোন জমানার আগে সি বিচে তখন ছবি তুলতে সহায় হতে হতো ফ্লিম ~ এর ক্যামেরার। সেলফি তোলার হিড়িকে হারিয়ে যাওয়ার আগে পুরীরর বালুকাবেলায় প্রেয়সীর হাত ধরে হাঁটার ছবি হয়তো এখনও আপনার বাড়িতে সাজানো। রাস্তার ধারের দোকান থেকে কিনে আনা শামুকের ঘর সাজানোর জিনিস আজও স্মৃতিবিজড়িত হয়ে আছে শোকেসে। হয়তো পুরীরর বিচে কোনও এক বিকেলবেলা যখন শেষ বিকেলের আলোয় আর সমুদ্রের প্রাণখোলা হাওয়ায় সবাই মাতোয়ারা তখন আপনার মনে ভিড় করে এসেছে ছুটি শেষের মেলাঙ্কলি সুর।

আসলে ৭০ বা ৮০র দশকে বা ৯০ দশকের অধিকাংশ সময় জুড়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির সাধ আর সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটেছিল এই রকম সমুদ্র সৈকতের মাধ্যমে। তাই এই সব জায়গাগুলো হয়ে উঠেছিল এত জনপ্রিয় আর বার বার ছুটি কাটানোর ফলে হয়ে উঠেছিল যেন আমাদেরই নিজস্ব আনন্দ উদ্যান। তাই পুরী কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অবস্থানের পরেও কখনও তার আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানায় কোনও ভাটা পড়েনি আজও ।

পুরীর উত্তাল সমুদ্রে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ, আর তার ধর্মীয় নিষ্টাও পূর্ণ করেছে কখনও শ্রী জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে বা কোর্ণাকের সূর্য মন্দিরের কারুকার্যের পাশে দাঁড়িয়ে একমুখ হেসে ছবি তুলে। লোকনাথ মন্দির বলুন বা চক্র তীর্থ, পুরী বেড়াতে এসে বাঙালীর ঘুরে ঘুরে সাইট সিয়িং করা কিন্তু পৃথিবী বিখ্যাত। পুরীর খাবার কথাই বা ভোলা যায় কি করে, সামুদ্রিক মাছ মাংস না হয় ছেড়েই দিলাম, কাকাতুয়ার খাজার স্বাদ আজও আমাদের জিভে লেগে আছে। আর পুরী বেড়াতে এসে অন্তত একবার নন্দন কাননে বাঘ দেখে যাননি বা চিলকা হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে পরিতৃপ্ত হননি, এইরকম কাউকে খুঁজে বার করাটাই মুশকিল। তাই আমাদের পুরনো ফোটো অ্যালবামগুলো বের করলে দেখতে পাওয়া যায় কীভাবে আমাদের অনেকেরই শৈশব জুড়ে ছিল পুরী।

নস্টালজিয়া আর ভালোবাসার পুরীর সমুদ্র সৈকত তাই আজও আমাদের প্রজন্মকে নতুন করে ডাক দিচ্ছে, নতুন স্মৃতি গড়ে তোলার আহ্বানে আজও আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি শৈশবের পথে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here