দেশের সময়: ভালো সময় যাচ্ছে না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। ওয়াগনার বিদ্রোহ দমন করলেও কূটনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, পুতিনের আগের মতো আর আত্মবিশ্বাস নেই। এমনই একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্টের ফোনে কথা হল। রাশিয়ায় যেভাবে তিনি ওয়াগনার বিদ্রোহ সামাল দিয়েছেন, তার প্রশংসা করলেন মোদী ৷

আর তারপরই মস্কোর একটি অনুষ্ঠানে মোদিকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন পুতিন। বললেন, মোদীর ব্রেন চাইল্ড মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্প ভারতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়াতেও এই মডেল অনুসরণ করা উচিত। নিজের দেশের জনগণের উদ্দেশে পুতিনের বার্তা, আপনারাও রাশিয়ায় তৈরি জিনিসপত্র আরও বেশি করে ব্যবহার করুন।

আবার অন্যদিকে, জনরোষে জ্বলছে প্যারিস। পুড়ছে সরকারি ভবন, বাড়িঘর। জ্বলছে গাড়ি। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ। ফ্রান্সের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যে কতটা গুরুতর কয়েকটি তথ্য তুলে ধরলেই তা স্পষ্ট হবে। বিক্ষোভ সামাল দিতে এখনও পর্যন্ত হাজারের বেশি গ্রেফতার। তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। সংঘর্ষে জখম তিনশোরও বেশি পুলিস কর্মী। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয়েছে ৪৫ হাজার আধাসেনা। এরমধ্যে শুধু প্যারিসের রাস্তাতেই রয়েছে ৫ হাজার আধাসেনা। রাজপথে টহল দিচ্ছে সাঁজোয়া গাড়ি।

ঠিক এই পরিস্থিতিতেই আগামী ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসে ফ্রান্সে যাওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। গেস্ট অব অনার হিসেবে তিনি যোগ দেবেন প্যারেডে। ফরাসি সেনার সঙ্গে কুচকাওয়াজে অংশ নেবে ভারতীয় সেনাও। ভারতের পাইলটদের হাতে ফ্রান্সের আকাশে উড়বে যুদ্ধবিমান রাফাল। ভারত-ফ্রান্স কৌশলী অংশীদারির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মোদীর এই ফ্রান্স সফর। অবশ্য গত বছরও ফ্রান্সে গিয়েছিলেন মোদী। ম্যাক্রঁ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে দেন। সবমিলিয়ে এটা স্পষ্ট, উন্নত বিশ্বের দু’টি দেশ যখন গভীর সঙ্কটে, ঠিক তখনই তারা ভারতকে কাছে পেতে মরিয়া।

এদিকে এই পরিস্থিতিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা প্রচার শুরু হয়েছে, প্যারিসের পরিস্থিতি সামাল দিতে দরকার যোগী আদিত্যনাথের মডেল। এই প্রচারে সায় দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন। আর তা নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। মুখ্যমন্ত্রীর অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে সেখানে যোগী আদিত্যনাথের অফিসের তরফে বলা হয়েছে, চরমপন্থা যখন ইন্ধন দেয় দাঙ্গায়, সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা, বিশ্বের যে কোনও অংশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্কট তৈরি হয়, তখনই বিশ্ব যোগী মডেলের শরণাপন্ন হয়। উত্তরপ্রদেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মহারাজ এই মডেল তৈরি করেছেন। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, যোগী মডেল মানেই বুলডোজার নীতি। বিচারের আগেই অভিযুক্তদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দাও। এই নীতিতেই চলছে যোগী সরকার। এবং যাদের বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, তারা মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সংবিধানের প্রহসন দাবি করে এই নীতির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু তাতে পাত্তা দিতে নারাজ যোগী প্রশাসন।

এবার সেই নীতিকেই বিশ্বের মডেল হওয়া উচিত বলে কার্যত দাবি করল উত্তরপ্রদেশ সরকার। যা জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের।

রোম যখন জ্বলছিল, তখন সম্রাট নিরো নাকি বেহালা বাজাচ্ছিলেন। আর প্যারিস যখন পুড়ছে, তখন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ ব্রিটিশ গায়ক এলটন জনের কনসার্টে সস্ত্রীক কোমর দোলাচ্ছেন। মুহূর্তে ভাইরাল হয়েছে এই ছবি। তুঙ্গে উঠেছে বিতর্ক। তবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এসবে কোনও হেলদোল দেখাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর মন্তব্য, মা-বাবারা সন্তানদের সামলে রাখুন। কম বয়সে সোশ্যাল মিডিয়া মগজ ধোলাই করে দিচ্ছে। যা হচ্ছে, তা নাকি অতিরিক্ত গেম খেলার কুফল। কী হচ্ছে? এককথায় বলতে গেলে প্যারিস সহ গোটা ফ্রান্স এখন ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে।

ট্রাফিক আইন ভাঙার অভিযোগে ১৭ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর নাহেল এমকে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। আর এরই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে ফ্রান্স। নাহেল আলজেরিয়া থেকে আসা অভিবাসী পরিবারের ছেলে। তার মৃত্যুর প্রতিবাদে উত্তর আফ্রিকা থেকে ফ্রান্সে আসা অভিবাসীরাই মূলত বিক্ষোভের প্রথম সারিতে। আগুন লাগানো হয়েছে প্যারিসের মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিংয়ে। মার্সেইয়ের টাউনহল পুড়ে ছাই। আগুনের গ্রাসে লাইব্রেরি। একটি বইও আর অবশিষ্ট নেই। পুড়ছে একের পর এক স্কুল, দোকান, ব্যাঙ্ক, বাস ও গাড়ি। প্রশাসন বলছে, আগুন লাগানোর ঘটনা প্রায় চার হাজার। তার মধ্যে শুধু গাড়ি পোড়ানো হয়েছে দু’হাজারের বেশি। লুট হচ্ছে বন্দুকের দোকান। অভিযোগ একটাই, দিনের পর দিন বর্ণ বৈষম্যের নীতি নিয়ে চলছে সরকার। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে অভিবাসীদের অধিকার।

এই পরিস্থিতিতে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় সম্মেলনের মাঝপথ থেকেই দেশে ফিরে এসেছেন ম্যাক্রঁ। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক করেছেন। কিন্তু তারপরও বদলায়নি পরিস্থিতি। আর এসবের মধ্যেই ভাইরাল হয়েছে একটি ব্যতিক্রমী ভিডিও। দেখা যাচ্ছে, প্যারিসের শহরতলি নঁতেরের রাস্তায় লাঠিচার্জ করছে পুলিশ। কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাচ্ছে। কিন্তু এসবে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই এক ব্যক্তির। তিনি আপন মনে স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন। এই ভিডিও দেখে একজন লিখেছেন, স্যান্ডউইচ টাইম কেউ নষ্ট করতে পারবেন না। কারও মন্তব্য, আমিও যদি এমন চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম। কিন্তু সত্যি কি চিন্তামুক্ত থাকার পরিস্থিতি রয়েছে ফ্রান্সে? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। অনেকেই বলছেন, কিছুটা হলেও আমেরিকার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ছায়া পড়েছে ফরাসি দেশে। এই ক্ষোভের আগুন কোথায় গিয়ে থামে, সেটাই দেখার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here