পার্থসারথি সেনগুপ্ত কলকাতা

সল্ট লেকে চলতি বইমেলা সম্পর্ক ধারণাটা খুব পরিষ্কার নয় আমিনা বিবির। এটা তার কাছে আলো ঝলমলে এক প্রাঙ্গণে নেহাতই আর পাঁচটা মেলার মতোই একটি মেলা। সেখানে কিসের বিকি কিনি, বইয়ের না খাবারের নাকি ফ্যান্সি ঝুটো গয়নার না পরিবেশ বান্ধব ব্যাগের, সেসব নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই আমিনার। আর তার হাত ধরে মেলার এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়ানো বছর চারেকের নাতনি রুকসানা তো নেহাতই এক রত্তি। আসলে আমিনা কোনো ভাবেই বইয়ের জগতের মানুষ নন। তার জীবনের গদ্যটা ক্ষুধার স্বরলিপিতে বড়ই কঠিন। মেলা চলার দিনগুলিতে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন স্টলের বিক্রেতা বা হরেক কিসিমের মানুষ জনের কাছ থেকে হাত পেতে ভিক্ষা চাওয়াটাই এই প্রবীনা পাখির চোখ করেছেন।

তাকে বেশি কিছু শুধোতে হয় না, স্বগতোক্তির মতোই অবিরত আউড়ে যান নিজের জীবনের দুঃখের বারোমাস্যা। তাঁর কথায়, ” আমার তিনটে ছেলে। মেজো আর ছোট খোকাটা মরে গেছে। ছোট ছেলের মেয়েই রুকসানা। খাওয়া জোটানো বড় কষ্ট। নাতনিটা খিদে সহ্য করতে না পেরে কাদে, খুব ঘ্যান ঘ্যান করে।” তাই, রুকসানার হাত ধরে প্রতিদিনই খাবারের সন্ধানে ইতি উতি ঘুরে বেড়ান আমিনা। শীতের মরশুমে তিনি চেষ্টা করেন বিধান নগর চত্বরে নানা মেলা প্রদর্শনীতে কোনো মতে নাতনিকে নিয়ে ঢুকে পড়ার। কারণ, এসব জায়গায় এসে মানুষ বেশ খোস মেজাজে থাকে। ভিক্ষা জোটে বেশ। আর বাড়তি পাওনা খাবারের স্টল। বৃহস্পতিবার যেমন রুকসানার হাতে বইমেলায় কোনো কোনো দোকান থেকে তুলে দিয়েছে সান্ডউইচ্, চিপসের প্যাকেটের মত টুকিটাকি।

কে যেন আমিনাকে বলেছে শুক্রবার বড় ‘ পরব’ আছে। ছুটি থাকবে। ওদিন মেলা আরো জমবে। বহু মানুষ আসবে। সেদিন একেবারে বই মেলার মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন আমিনা। আশা, নাতনিটা নিশ্চয় পেট ভরে খেতে পাবে। তবে এই মেলায় “দয়ালু” লোকেরও অভাব নেই বলেই বিশ্বাস করেন তিনি। যেমন, পুলিশ কর্মী পল্লব দত্ত। মেলায় ডিউটি পড়েছে তার। আমিনা বলেন, ” পুলিশের এই বাবুটা টিফিনের খাবার থেকে আমাদের খেতে দেয়।’ পল্লবের কথায়, ” কি আর করবো বলুন। এই শীতের মধ্যে খালি পেটে বুড়িটা নাতনির হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আর আমার সঙ্গী সাথীরা টিফিনের খাবার থেকে ওদের কিছু দিই। আমি বলে দিয়েছি, যত দিন বই মেলা চলবে, দুপুরের দিকটা বাচ্চাটাকে নিয়ে এসো। খেতে পাবে।”

পূর্ব কলকাতায় তার দিদির সঙ্গে ঝুপড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই আমিনার। সত্যি বলতে গেলে বইয়ের পাতা ওল্টানোর মিষ্টি গন্ধের কোনো হদিস তার কাছে নেই। হাড়িতে ফ্যান উপচে গরম ভাত ফোটার সুবাসটাই ” ইন্টারন্যাশনাল কলকাতা বুক ফেয়ারে ” খাবারের সন্ধানে হাত পেতে থাকা আমিনা বিবি – রুকসানার কাছে সবচেয়ে সেরা । কিন্ত ভাত আর জোটে কই!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here