ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের বয়স যাদের ৫০ থেকে ৭০ অথবা তার কিছু কম বা বেশি, তারা সকলেই শ্রীমতী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. সুচিত্রা মিত্র, শ্রী সবিতাব্রত দত্ত, শ্রী ভি. বালসারা প্রমুখ গৌরব সম্পাদনী ব্যক্তিত্বের কীর্তির মধ্যগগন দেখেছি। পেয়েছি তাঁদের সংস্কৃতি পরিবেশন — তার রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ। পাশাপাশি হয়তো তাদের ব্যক্তিজীবনের অনভিপ্রেত চর্চার অপপ্রয়াসও করে ফেলেছি। কিন্তু ‘সময়’ বড় বিচারক। সময়ই বলে দেয় কোনটি থাকবে, কোনটি ধুয়েমুছে যাবে।

জন্মশতবর্ষ উদযাপন আমরা কেন করি? শতবর্ষে যখন কোনো প্রয়াত বিদ্বান বা বিদূষীকে স্মরণ-মনন করি, তখন কিন্তু আমরা নির্মোহ দৃষ্টিতে, নিরপেক্ষ পর্দায়, আবেগ-অতিরঞ্জন সরিয়ে তাঁদের মহাজীবনের কথাই বলতে প্রয়াস পাই। নইলে কেন উদযাপন করবো? প্রতিটি মানুষেরই একটি দর্শন থাকে। প্রবুদ্ধ মানুষের দর্শন আরও গভীর। সেই দর্শনের মধ্যে যে অতীন্দ্রিয় জগৎ থাকে, তাকেও বোধহয় জন্মশতবর্ষে এসে অস্বীকার করা চলে না। প্রস্তুত আলোচনার মধ্যে সেই তুরীয়ানন্দের সংবাদ, সেই অমৃতলোকের কিছু কথা, আনন্দধারার কথা কণিকার জীবনপ্রবাহ অবলম্বনে বলবো।

কণিকা (১২ই অক্টোবর, ১৯২৪- ৫ এপ্রিল, ২০০০) শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি-পালিতা এক অমৃতকন্যা। তিনি ‘সুর কন্যা’ হয়েছিলেন রবীন্দ্র কণিকাগুলি ধীরে ধীরে আত্মস্থ করে। ১৯৩৪-এর এক কালবৈশাখীর ঝোড়ো সন্ধ্যায় বান্ধবীর সঙ্গে গুরুপল্লী থেকে উত্তরায়ণে দৌড়েছিলেন আম কুড়োতে। সেখানেই ‘শ্যামলী’ গৃহে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দেখা। তিনি কাছে ডাকলেন। “গান জানিস?” কোনো দ্বিধা বা জড়তা না রেখে শুনিয়ে দিলেন সদ্য শেখা গান যাতে বৃষ্টির আমেজ।
“সেদিন এমনি মেঘের ঘটা
রেবা নদীর তীরে,
এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামল শৈল শিরে।”

তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। রবি-কণিকা মানে ‘ফোটন’ কণা পেয়ে যেন ডানা উঠল জেগে। ১৯৩৫ সালে গুরুদেব আপিসের খাতায় তাঁর ‘অণিমা’ নামটি বদলে ‘কণিকা’ করে দিলেন। পিতা গ্রন্থাগার কর্মী সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের অনুমোদন ছিল। যে মানুষটির সব অনুষ্ঠান এতদিন দূর থেকে দেখেছেন, যাঁর গান শিখেছেন, এবার তাঁকেই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন। তাঁরও ‘গুরুদেব’ হলেন। কণিকা যে সারাজীবন গান গেয়েছেন কাকে উদ্দেশ্য করে?
সুন্দরকে উদ্দেশ্য করে, পরমপুরুষ জ্ঞানে, রবি ঠাকুরের গান তাঁকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন।

কণিকার মায়ের নাম ‘সোনা’ মেয়ের নাম রাখলেন ‘মোহর’। যে সে মোহর নয়! একেবারে ‘আকবরী মোহর’। শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে খড়-টিনের চাল-ছাওয়া ন’টি বাড়ি ছিল তখন। যেন ‘নবরত্ন সভা’।সেখানে থাকতে থাকতেই হয়ে উঠলেন ‘আকবরী মোহর’।

কী গান গাইতেন তিনি? রবীন্দ্র সঙ্গীত তো শুধু সুরের খেলা নয়, সুরের মায়াও নয়! এক বোধাতীতানন্দ। এক আকাশ উপলব্ধি! একজন দরদী, মরমি শিল্পী বাইরে গাইবেন; আর একজন, শ্রোতা, অন্তরে, অন্দরে। উপলব্ধির সাধনায় তিনি শিল্পীর চাইতেও উচ্চমার্গে অবস্থান করতে পারেন৷ তাই রবীন্দ্র সঙ্গীত আসলে দু’জন প্রবুদ্ধের সম্মিলন।

সেই গানের আনন্দ ধারায় যুক্ত হয়েছে টপ্পার সংহত গুটি। আমের গুটির মতোই। আমের বোল আসার পর কুষিগুলির মতো। এই আম কুড়োতেই কি সেদিন ‘অণিমা মুখোপাধ্যায়’ গিয়েছিলেন? ফিরলেন ‘কণিকা’ হয়ে? নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তের টপ্পার মতো কুষি আম রবীন্দ্রনাথও সাদরে গ্রহণ করেছেন। তাতে সংপৃক্ত হয়ে, জারিত হয়ে নিঃশর্ত সমপর্ণে ধন্য হয়েছে কণিকা, নীলিমা সেন প্রমুখের কণ্ঠ।

রবীন্দ্র প্রয়াণের পর ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনের শিক্ষিকা হয়েছিলেন মাসিক চল্লিশ টাকা বেতনে৷ আগেই হয়েছিলেন হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির শিল্পী। পরে HMV এবং আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পী। মাঝে অখণ্ড বঙ্গ, সমগ্র ভারত এবং বহির্বিশ্বে তাঁর সঙ্গীত পরিবেশনা। ১৯৮৪ সালে সঙ্গীত ভবন থেকে অধ্যক্ষ পদে অবসর।

তাঁর গায়কীর শিক্ষায় কিন্তু ‘মাস্টারি’ ফলান নি তিনি৷ বরং নকশিকাঁথা বুনে দিয়েছেন। ছাত্র নামক কাঁথার জমিন, তার উপর বিনিসুতোর কাজ এবং দীক্ষা। গানের মুক্তো ঝরতেই, সুরের মূর্ছনাতেই বোঝা যায়, শিক্ষাগুরু কে? কোনো ছাত্র ভালো গান গাওয়ার পর যদি কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করতেন, তিনি বলতেন, “একদম আমার মত।”

গুরুদেব চলে যাওয়ার পর পঁচিশ বছর। ১৯৬৬ সাল। তাঁর ছাত্র, পরে সহকর্মী, ছায়াসঙ্গী, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গোরা সর্বাধিকারী তাঁকে শান্তিনিকেতনের অদূরে এক গুপ্ত সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যান। বাইরে অতি সাধারণ বেশ, হাল্কা গেরুয়া পোষাক, অন্তরে চির প্রশান্তি। দু’চোখের একটিতে ধিকিধিকি প্রজ্বলন, অপরটিতে চির শান্তরূপ। কণিকা তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহরক্ষার সময় তোলা ছবি, যেখানে স্বামীজী থেকে গিরিশ ঘোষ পর্যন্ত বিশিষ্ট ভক্তরা রয়েছেন, তারই একজন এই সাধুবাবা। হিন্দি, বাংলা, পঞ্জাবী, অসমীয়া নানান ভাষায় সাবলীল। যাঁর কাছে ধনী-নির্ধন, নামী-অনামী কোনো ভেদ নেই। যাঁর কাছে সব কিছু বলা যায়। একছুটে চলে যাওয়া যায়। অভিমান করা যায়, রাগ করা যায়! রবীন্দ্রনাথের কাছেও তো কণিকা ছুটে গিয়ে অভিযোগ জানাতেন, পাঠভবনের শিক্ষক ধনপতি লাহা অঙ্কের খাতায় তাকে শূন্য দেয়, ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখে। গুরুদেব বলেন, “তোকে বুঝি ধনপতি দাঁড় করিয়ে রাখে! ও তুই ভাবিস নে। আমি বলে দেবো।” তেমনই সাধুবাবা। যিনি সর্বক্ষণ ভক্তকে আগলে রাখেন, অথচ যাঁর কাছে আবাহন নেই, বিসর্জনও নেই। এই সাধুবাবার মন্দিরে প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলায় তিনি হরিণাম সংকীর্তন করেছেন, পূজা পর্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভক্তিগীতি। এই সাধুবাবার সঙ্গেই তিনি বৃন্দাবন, বদ্রীনাথ ঘুরেছেন৷ সঙ্গে গরম জামা নেই, হাতে এক পয়সা নেই। নভেম্বরের প্রথমে বদ্রীনাথ দর্শন বন্ধ হওয়ার আগে অবলীলায় একদিন, একরাত ধামে কাটিয়েছেন। বৃন্দাবন থেকে হঠাৎই বদ্রীনাথ চলে যাওয়া। “টাকা পয়সা থাকলেই তো মা এটা কিনবে, ওটা কিনবে। না থাকাই তো ভাল। আমি তো আছি।” প্রায় ভিক্ষান্নে তীর্থভ্রমণ করলেন সাধুবাবার সঙ্গে। শান্তিনিকেতনে কণিকার ‘আনন্দধারা’ গৃহের প্রথম মাটি কেটে প্রথম ইঁটটি গেঁথে দিয়েছিলেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here