দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ‘সবার উপরে’ সিনেমায় ছবি বিশ্বাসের সেই অনবদ্য সংলাপ ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর…’ এজলাসে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় আর্তনাদ করছেন এক অসহায়-বৃদ্ধ। আজও জীবন্ত হয়ে আছে অনেকেরই মনে ৷

সেই দৃশ্যই যেন বৃহস্পতিবার নতুন করে ফিরে দেখল কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৭ নম্বর এজলাস। তবে ১২ বছর নয়, এবার ৪৭টি বছর হারিয়ে ফেলার আর্তি নিয়ে বিচারপতির মুখোমুখি হলেন ৭৬ বছরের বৃদ্ধা। বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আপনি আইনের যোদ্ধা!’ এর উত্তরে বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘আইন আপনাকে গাছতলায় দাঁড় করিয়েছিল, আবার সেই আইনই আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মান অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছে।’


শুধু তাই নয়, বিচারপতিকে রবিঠাকুরের কবিতাও আবৃত্তি করে শোনান ওই বৃদ্ধা। পাল্টা উত্তরও দেন বিচারপতি, কবিতার দ্বারাই। শেষমেশ চোখের জলে ভেসে, ৪৭ বছর ধরে জীবন-যৌবন সব হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ নিয়েই আদালত ছাড়েন তিনি।

ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটা নাগাদ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৭ নম্বর এজলাসে বেঞ্চে বসে শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষ। তাঁকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনি আদালতে এসেছেন কেন? আবার কী প্রয়োজন পড়ল? আপনার মতো প্রবীণ মানুষকে আদালতে আসতে দেখলে খারাপ লাগে। কেন কষ্ট করে আদালতে আসেন? যা পাওনা ছিল, তা তো পেয়ে গিয়েছেন।’’ বিচারপতির কথা শুনে হাতজোড় করে সামনে এগিয়ে এসে শ্যামলী বলেন, ‘‘ধর্মাবতার, আজ আমার মামলা রয়েছে। আপনার নির্দেশে জীবনের শেষ ধাপে এসে নিজের প্রাপ্য পেয়েছি। তবে যারা কেড়ে নিয়েছিল, তাদের উপযুক্ত শাস্তি আশা করেছিলাম।’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনার মামলার বিচার হবে। কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে। আপনি এ ভাবে প্রায়ই আদালতে চলে আসবেন না। যখন প্রয়োজন হবে আপনাকে ডেকে পাঠাব।’’ শ্যামলীর জবাব, ‘‘আপনাকে দেখতে আসি। আপনি কেমন আছেন?’’ মুচকি হেসে বিচারপতির জবাব, ‘‘বেঞ্চে বসে বিচার করছি মানে ভালই আছি।’’ তার পরেই শ্যামলী আবার প্রশ্ন করেন, ‘‘আমি এলে কি কোনও অসুবিধা হয়?’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘অসুবিধা থাকবে কেন! আপনার এত বয়স! এই বয়সে কোর্টে আসছেন, দেখতে ভাল লাগে না। ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছা হয় তাই করুন। কী আর বলব!’’

এর পর ফের বেঞ্চে গিয়ে বসেন শ্যামলী। কিছু ক্ষণ পর তাঁর মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। বৃহস্পতিবার এডিআই-এর বিরুদ্ধে আদালতে রিপোর্ট জমা দেয় রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশন। সেই রিপোর্ট দেখে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, শিক্ষা দফতরের সচিবকে এই রিপোর্ট পাঠাবে ভিজিল্যান্স কমিশন। তার ভিত্তিতে এডিআই উলুবেড়িয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা দফতর।

এ কথা বলেই শ্যামলীকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ বার তো আপনার মামলা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি চলে যান।’’ শ্যামলী আলতো হেসে বলেন, ‘‘কেন অবেলায় ডেকেছ খেলায়, সারা হয়ে এল দিন। বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূরবীতে এই কবিতা লিখেছিলেন কাদম্বিনীর উদ্দেশে। আমিও শেষ বয়সে এসে বিচার পেয়ে উপলব্ধি করলাম। বিধবা অবস্থায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছি।’’

বিচারপতি বৃদ্ধাকে বলেন, ‘‘কবিতা ভালবাসেন দেখছি। যাঁরা কবিতা ভালবাসেন, তাঁরা খারাপ হন না। আপনি তো রবীন্দ্র অনুরাগী! শেষবেলায় বিচার পাচ্ছেন, তাই মনে রাখবেন— এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’’
২৫ বছর ধরে বেতন না পাওয়ায় মামলা করেছিলেন শ্যামলী। সেই মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে বকেয়া বেতন-সহ প্রায় ৪০ লাখ টাকা পেয়েছেন শ্যামলী। কিন্তু তার পরেও সমস্যা তাঁর পিছু ছাড়েনি।

১৯৭৬ সালে শ্যামপুরের ওই স্কুলে চাকরি পান শ্যামলী। বাম আমলে তাঁর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বেতন। ২০১৩ সালে মেয়াদ অনুযায়ী চাকরি থেকে অবসর নেন শ্যামলী। কিন্তু বেতনের জন্য লড়াই চলতে থাকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষা দফতরে ছোটাছুটি, একের পর এক চিঠি, কোনওটাই বাদ রাখেননি তিনি। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছিল না কিছুতেই। এর পরেই আইনের পথ ধরেন তিনি। কলকাতা হাইকোর্টে বিভিন্ন এজলাস ঘুরে মামলা আসে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে। অবশেষে প্রবীণ শিক্ষিকাকে বিচার পাইয়ে দেন তিনি৷ অবশেষে রায় শুনে সেদিন হাইকোর্টে কেঁদে ফেলেছিলেন ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শ্যামলী।

মামলা শেষে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় শ্যামলীদেবীর উদ্দেশে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার কেস হয়ে গেছে, আপনি এবার বাড়ি যান।’ এই সময়ে শ্যামলী দেবী বিচারপতির সামনে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেন রবিঠাকুরের পূরবী কাব্যগ্রন্থের লীলাসঙ্গিনী কবিতার অংশ, ‘কেন অবেলায় ডেকেছো খেলায়, সারা হয়ে এল দিন, এবার কি তবে শেষ খেলা হবে নিশীথ-অন্ধকারে?’ এই কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি বলেন, ‘৭৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতা লিখেছিলেন। আমিও শেষ বয়সে এসে বিচার পেয়ে এই উপলব্ধি করলাম। কিন্তু বিধবা অবস্থায় দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যে কষ্ট সহ্য করেছি, তা বলার নয়। যাদের জন্য এই কষ্ট তারা উপযুক্ত শাস্তি পাক, সেই দেখতেই আদালতে আসা।’

এ কথার উত্তরে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে বলেন, ‘আপনি দেখছি কবিতা ভালবাসেন। যাঁরা কবিতা ভালবাসে তাঁরা খারাপ হয় না। এছাড়াও আপনি রবীন্দ্র অনুরাগী। শেষ বেলায় বিচার পাচ্ছেন সেটা ঠিকই, তবে মনে রাখবেন, এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা। আপনি ভাল থাকুন।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here