দেশের সময়: ফিরে এল নীরা। আমজনতার মাঝে। তবে এ নীরা সুনীলের নয়। নারকেলের। নীরা এসেছে তিলক-বরফিতে, সঞ্জীবনীতে, কল্পতরুতে, কল্পরসায়। তার বাস মিষ্টির ভূবনে। অথচ তাকেই নিজেদের বাড়িতে ঠাঁই দিচ্ছেন ডায়াবেটিক রোগীরা। শুরুটা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বলাগড়ে। এখন অনেকেই পরীক্ষানিরীক্ষায় শামিল হয়েছেন।
ডাবের জল কিংবা নারকেল তো আমরা খেয়েই থাকি। কিন্তু নারকেলের ফুল বা মুচি থেকে এক ধরনের রস পাওয়া যায়। সেটা কি সবার জানা? যা কি না শুধু চিনির বিকল্প নয়, মিষ্টি স্বাদযুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত পানীয়ও বটে।
হ্যাঁ, নারকেল ফুল থেকে তৈরি হওয়া রস। এরই পোশাকি নাম নীরা বা কল্পরস।

সুগার ধরা পড়া মানেই জীবন থেকে মিষ্টি বিদায়। এমনটাই কমন পারসেপশন। কিন্তু নীরা সেই ধারণা বদলে দিয়েছে একেবারেই। বলা যেতে পারে, সুগার রোগীদের জীবনযাত্রায় ঘটে গিয়েছে নিঃশব্দ বিপ্লব। এখন কাঁড়ি কাঁড়ি মন্ডা মিঠাই খেলেও নো প্রবলেম।
রক্তে যাঁদের শর্করার মাত্রা বেশি, চিনির সঙ্গে ঘটে গিয়েছে ‘বিচ্ছেদ’, তাঁরা হামেশাই ওই রসে ডোবানো রসগোল্লা খেয়ে জিভের স্বাদ পূরণ করতে পারবেন। মোটেই লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, সুগার রোগীরা একেবারে প্রকাশ্যে বুক চিতিয়ে টপাটপ মুখে পুড়তে পারবেন ‘নীরা’র তৈরি পান্তুয়া। এমনটাই বলছেন বিজ্ঞানীরা।
নীরার বহুমুখী প্রতিভা। এক্কেবারে মঅ্যাজিক রেজাল্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই রস শুধু আপনাকে মিষ্টি-মুখ করাবে না, বাড়াবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। মিষ্টি তো আছেই, দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে খোঁজ করলে মিলবে নীরার তৈরি আইসক্রিমও। চেখে দেখতে পারেন নীরা বরফি, নীরা কস্তুরী কিংবা নীরা সন্দেশ। চেষ্টা চলছে নীরা দই তৈরির।


শুধু মুখে বলা নয়, কাজেও করে দেখিয়েছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের কাছ থেকে টিপস নিয়ে ইতিমধ্যেই কলকাতা সহ শহরতলীর বেশকিছু মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী চিনির বদলে নারকেল রসে ডুবিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন জিভে জল আনা রসগোল্লা, পান্তুয়া, রাবড়ি, দই কিংবা সন্দেশ। আর সেসব মিষ্টি যাঁরা চেখে দেখেছেন, দারুণ খুশি প্রত্যেকেই।

নীরা কি?

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা জানিয়েছেন, নারকেল গাছের অপরিণত ফুল থেকে বের হওয়া মিষ্টি স্বাদের হাল্কা ক্রিম রঙের রস হল নীরা। এই রস সংগ্রহ করার পর ছেঁকে নিয়ে ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। যাতে গেঁজে না যায়। কিন্তু কী আছে এই রসে, যা চিনির বিকল্প হিসেবে দাবি করা হচ্ছে? গবেষকরা বলছেন, নীরার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৩৫, যেখানে চিনিতে এই পরিমাণ ৬৫। ফলে রক্তে যাঁদের শর্করার মাত্রা বেশি, তাঁরা নীরার তৈরি চিনি কিংবা মিষ্টি খেতে পারেন। কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত চিনির কদর গোটা বিশ্বের বাজারেই বাড়ছে। তাছাড়া নীরা থেকে তৈরি চিনিতে ইনিউলিন নামে এক ধরনের ফাইবার পাওয়া যায়, যা গ্লুকোজকে দ্রুত রক্তে মিশতে বাধা দেয়। সুগার রোগীদের ক্ষেত্রে ফ্রুকটোজ মারাত্মক ক্ষতিকর। দেখা গিয়েছে, চিনিতে শতকরা ৫০ শতাংশ ফ্রুকটোজ থাকলেও নীরার মধ্যে তা নেই।


এখানেই শেষ নয়, নীরা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা চালানো কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, নারকেল ফুলের এই রসে ১০০ মিলিলিটারে সুগার থাকে ১৫-১৮ শতাংশ। এছাড়া পাওয়া যায় শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ নানা খনিজ পদার্থ। যেমন, আয়রন, জিঙ্ক, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড। পলিফেনল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও রয়েছে এতে। ভিটামিন সমৃদ্ধ এই পানীয় দ্রুত এনার্জি বৃদ্ধিতে সহায়ক। শরীর ঠান্ডা রাখে। সাহায্য করে হজমে। প্রতিদিন নিয়ম করে নারকেলের এই রস পান করলে নাকি দূরে থাকবে জণ্ডিস, এমনও দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা।


পুষ্টি বিশেষজ্ঞরাও নীরার ঢালাও প্রশংসাপত্র দিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকা মানেই তার গ্লাইসেমিক লোডও কম হবে। ফলে সুগার রোগীরা যাঁরা মিষ্টি খেতে না পেরে মনক্ষুন্ন, তাঁরা নারকেলের এই রস ও এর থেকে তৈরি মিষ্টি খেতে পারেন। একইসঙ্গে নীরার মধ্যে বেশ ভালো মাত্রায় পটাশিয়াম রয়েছে। ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে ও হৃদরোগ জনিত রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে এটি। লিভার ভালো রাখে। সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা যায়।


বিদেশে তো বটেই, ভারতে কেরল, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকে ইতিমধ্যেই নীরার তৈরি চিনি, গুড় ও হেল্থ ড্রিঙ্ক বিক্রি শুরু হয়েছে। লাক্ষাদ্বীপ ও আন্দামানে নীরার উৎপাদন ও নীরা থেকে তৈরি চিনির কদর বাড়ছে বাজারে। আমাদের রাজ্যেও অনেকেই পরীক্ষামূলকভাবে করে দেখতে চাইছেন। অনেকে আবার বাণিজ্যিকভাবেও শুরু করেছেন। এরকমই একজন কলকাতার জানবাজারের এক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী বলেন, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর আমি উৎসাহিত হই। তার পর নীরার রসে মিষ্টি তৈরি শুরু করি। কেমন হবে, তা নিয়ে প্রথমদিকে একটু সংশয় ছিল। কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর ভয় কেটে গিয়েছে। আমরা নারকেল রসের রসমালাই, সন্দেশ, কালাকাঁদ তৈরি করছি। সেগুলি খেতে অনেকটা নলেনগুড়ের মতো হচ্ছে।

ডায়াবেটিক রোগী যাঁরা জীবনে আর কোনওদিন মিষ্টি খাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন, তাঁরাও নীরার মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ওই মিষ্টান্ন বঅ্যাবসায়ীর কথায়, নারকেল রস জ্বাল দিয়ে দানা করে বিক্রি হয়। আমরা সেটাই কিনে থাকি। এক কেজির দাম পড়ছে ৭২০ টাকা। দক্ষিণ কলকাতার আরএক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী, তিনিও নারকেল রসে ডুবিয়ে মিষ্টি তৈরি করছেন। তাঁর বক্তব্য, অন্যান্য মিষ্টি ঠিক থাকলেও রসগোল্লা একদিনের বেশি রাখা যাচ্ছে না। একটু লালচে হয়ে যাচ্ছে। তবে পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়ছি না।


গবেষকরা বলছেন, নীরা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা নেই। সারবছরই নারকেল গাছ থেকে এটি মিলতে পারে। একটি নারকেল গাছ থেকে বছরে কম করে ২০০ লিটার নীরা পাওয়া যেতে পারে। যা বিক্রি করে মোটা টাকা ঘরে তোলা সম্ভব।
কীভাবে সংগ্রহ করতে হবে নারকেলের এই রস? কৃষি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এক্ষেত্রে গাছ ও ফুল নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট গাছ থেকে এই রস সংগ্রহ করতে হবে। যে গাছ বেশি ফলন দেয়, সেটি থেকে বেশি পরিমাণে রস মিলবে।


কোন ফুল থেকে রস সংগ্রহ করতে হবে?


বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি নারকেল ফুলের দণ্ডের নীচের দিকে থাকে স্ত্রী ফুল এবং উপরের দিকে থাকে পুরুষ ফুল। স্ত্রী ফুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারকেল ফুলের দণ্ডটি নীচের দিকে ঝুলে যায়। এটা হলেই বুঝতে হবে, ওই ফুল থেকে এবার রস নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। তখন দণ্ডটিকে দড়ি দিয়ে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে, যাতে ফুলটি ফেটে না যায়। যে ফুল থেকে রস নেওয়া হবে, ভারী কিছু দিয়ে সেটিকে মালিশ করতে হবে দুই থেকে তিনদিন। এর পর ফুলের দণ্ডের মাথার দিকে ৭-৮ সেমি কেটে দিতে হবে। ঠিকমতো মালিশ করা হলে এক সপ্তাহের মধ্যেই ওই কাটা অংশ থেকে রস বের হতে শুরু করবে। নীরা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সতর্কীকরণও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবসময় খেয়াল রাখতে হবে বাতাসের সংস্পর্শে এসে রস যেন গেঁজে না যায়।


ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ-এর অন্তর্গত কেরলের সেন্ট্রাল প্লঅ্যান্টেশন ক্রপস রিসার্চ ইনস্টিটিউ-এর বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই নারকেলের উপর গবেষণা চালিয়ে আসছেন। তাঁদের লক্ষঅ্যা, নানা উপায়ে নারকেল গাছকে কাজে লাগানো। সেই উদেঅ্যাগেরই একটি অংশ নীরা। সরকারি তথঅ্যা বলছে, আমাদের দেশে ১৮.৯৫ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি জমিতে নারকেল চাষ হয়। কেরল, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, গোয়া, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গ ও লাক্ষাদ্বীপে নারকেলের চাষ সবথেকে বেশি। কিন্তু গাছের নানা রোগপোকার আক্রমণ এবং বাজারে প্রত্যাশিত দাম না মেলায় কৃষকরা দিনদিন নারকেল চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে বিকল্প দিশা দেখাতেই নীরা তৈরির উদ্যোগ।

নারকেল গাছের ফুল থেকে রস সংগ্রহের জন্য বঅ্যাবহার করা হয় কোকোসঅ্যাপ চিলার বক্স নামে একটি যন্ত্র। একটি নারকেল গাছে প্রতিমাসে একটি করে ফুল হয়। সারাবছরে যে ফুল থেকে গড়ে অন্তত ২৫০ লিটার মিষ্টি রস বের করা সম্ভব। যদি ৬০ টাকা লিটার দরেও ওই রস বিক্রি হয়, তা হলে বছরে তার থেকে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। অন্যদিকে, একটি গাছ থেকে বছরে বড়জোর ১২০টির মতো নারকেল পাওয়া যেতে পারে। তা থেকে দু’হাজার টাকার বেশি চাষির হাতে কোনওমতেই আসে না। উদ্যানপালন দপ্তরের হিসেব বলছে, আমাদের রাজ্যে মোট যে নারকেল গাছ রয়েছে, তার ৭৫ শতাংশ ডাবের জন্য ব্যবহার করা হয়।

২০ শতাংশ থেকে নেওয়া হয় নারকেল। আর বাকি ৫ শতাংশে কোনও ফল হয় না। অথচ পশ্চিমবঙ্গের এক শতাংশ নারকেল গাছ থেকে বছরে ১,০২৪ লক্ষ লিটার রস পাওয়া সম্ভব। যার বাজার দর কম করে হলেও ৬০ লক্ষ টাকা। হিসেব করে দেখা গিয়েছে, একজন চাষি যদি এক হেক্টর জমিতে নারকেল গাছ লাগান, তা থেকে সারাবছরে তিনি ২১ লক্ষ টাকার রস বিক্রি করতে পারবেন। আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে এই রস থেকে তৈরি চিনির দারুণ চাহিদা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here