যেন সরবেড়িয়ার বেতাজ বাদশা৷ এক সময় ছিলেন বামঘেঁষা, এখন তৃণমূলে৷ নামেই শুধু জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ হলেও, কার্যত, শাহজাহান শেখের অনুমতি ছাড়া এলাকায় একটা পাতাও নড়ে না বলে জানাচ্ছেন এলাকাবাসীর একাংশ৷ মাছের ভেড়ি থেকে শুরু করে ইট ভাটা, এমনকি, বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে আসা জামাকাপড়ের কারবারও, এ সবই নাকি নিয়ন্ত্রিত হয় এই শাহজাহান শেখের অঙ্গুলিহেলনে৷

দেশের সময় : মনে আছে চৌরঙ্গী সিনেমার ‘শাহজাহান রিজেন্সি’? বাঙালির ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারের সঙ্গে অঞ্জনা ভৌমিকের প্রেমের প্রেক্ষাপট?

কলকাতায় শাহজাহানের নামে এর থেকে বড় কোনও সম্পত্তি হয়তো আর নেই। কিন্তু সন্দেশখালিতে আছে। সেখানে শেখ শাহজাহানের জীবদ্দশাতেই আস্ত একটি বাজারও তৈরি হয়ে গেছে তাঁর নামে। তৈরি হয়ে গেছে মানে তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। সন্দেশখালিতে এই বাজার দিনেরাতে গমগম করে। হাজারো মানুষের ভিড় সেখানে। এই বাজারেই তাঁর দান খয়রাতের গল্প এখন গোটা তল্লাটে। আর তাঁর ঔদ্ধত্যকেই প্রকাশ্যে আনছে নামাঙ্কিত এই বাজার।

এলাকার মানুষ জানান, নয়ের দশকে বাংলাদেশ থেকে নদীপথে অবৈধভাবে ভারতে এসেছিলেন শেখ শাহজাহান ও তার পরিবার। সন্দেশখালির লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত সবই তখন বামেদের দখলে। শাসকদলের নেতা মোসলেম শেখের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছিল শেখ শাহজাহানের। কংগ্রেসের সমর্থকদের থেকে মাছের ভেরি ও জমি দখল করা, কারণে অকারণে গ্রামবাসীদের থেকে জরিমানা আদায় করার তাঁর উপরে দিয়েছিলেন মোসলেম। সেই দায়িত্ব একনিষ্ঠভাবে পালন করে সিপিআইএমের উচ্চ নেতৃত্বের মন জয় করেছিলেন শেখ শাহজাহান। তার পর তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। 

২০০৯ সালে বসিরহাট লোকসভা বামেদের হাতছাড়া হয়। সিপিআই প্রার্থী অজয় চক্রবর্তী তৃণমূল সাংসদ হাজি শেখ নুরুল ইসলামের কাছে ৮৫ হাজারেরও ভোটে হেরে যান। এরপর ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে সন্দেশখালিতে তখনও  সিপিআইএমের শেখ শাজাহানই বেতাজ বাদশা।

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সন্দেশখালি জুড়ে বুথ দখল, রিগিং, খুন জখমের জন্য শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। পরে মামলায় মামলায় জর্জরিত হয়ে শেখ শাহজাহানের অনুগামীরা তাঁকে ছাড়তে থাকে। ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে শেখ শাহজাহান ২০১৬ সালের শেষের দিকে তৃণমূলে যোগ দেন তৎকালীন অবিভক্ত উত্তর ২৪ পরগনা জেলার তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের হাত ধরেই।

পুলিশের খাতায় শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মায়ানমার থেকে সমুদ্রপথে সুন্দরবন হয়ে অবৈধভাবে ভারতে ঢোকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার। শুধু তাই নয় তাদের আধার কার্ড রেশন কার্ড ভোটার কার্ড সহ সমস্ত নথি বানিয়ে দেওয়ার ও কারিগর নাকি শেখ শাহজাহান। এছাড়া কাঠ ও গরু পাচারের অসংখ্য অভিযোগ তো রয়েইছে। সিপিএমে থাকাকালীন এইসব অভিযোগ তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা করতেন। তৃণমূলে যোগদান করার পরে অবশ্য এই অভিযোগ এখন সিপিএম, বিজেপির নেতারা করেন। তবে এ নিয়ে বিশেষ কিছু এসে যায়নি তাঁর।

১০০ শতাংশ ভোটে জিতে জেলা পরিষদের মৎস্য ও প্রাণী বিকাশ উন্নয়ন দফতরের কর্মধ্যক্ষ হন। সুদূর সুন্দরবনের এদো পাড়ার পার্টি অফিস ছেড়ে জেলা সদর বারাসাতের জেলা পরিষদের দোতলার ঝাঁ চকচকে অফিস ঘরে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। রবিন হুডের পরিচিতি করতে সন্দেশখালি বাজারে তৈরি করেন তার নিজের নামে শেখ শাজাহান মার্কেটেও। সরকার বদলায়, কিন্তু শেখ শাহজাহানের সাম্রাজ্য যে অবিকৃতই থাকে শুক্রবার সাত সকালে সন্দেশখালি সরবেড়িয়াতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ইডির দুঁদে আধিকারিকরা।

শেখ শাহজাহানের উত্থান হয়েছিল উল্কার গতিতেই।
সন্দেশখালি-সরবেড়িয়ার মানুষ বলেন, শাহজাহানের হাতেখড়ি হয়েছে বাম জমানাতেই। সেই প্রতিপত্তি আড়ে বহরে বেড়েছে জোড়াফুল জমানায়।

সন্দেশখালি ১ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি হলেন শাহজাহান। এলাকায় তাঁর নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। বছর পঞ্চাশের শাহজাহানের জীবনের শুরুটা অবশ্য ভাল ছিল না। এক সময়ে দিন আনি দিন খাই করে চলত তাঁর পরিবারের। সন্দেশখালিতে তখন সিপিএমের দাপট। সরবেড়িয়ার শেষ কথা ছিলেন এলাকার প্রতাপশালী সংখ্যালঘু নেতা মোসলেম শেখ।

মোসলেম ছিলেন সরবেড়িয়া পঞ্চায়েতের প্রধান। ঘটনা হল, তৃণমূল তখন মোসলেমের অত্যাচারের কথা বলত। এলাকায় জোড়াফুলের পতাকা লাগানোর জো ছিল না। ভোটের সময়ে এই সিপিএম নেতা তৃণমূলকে পোলিং বুথ বানাতে দিতেন না এবং বুথের মধ্যে তৃণমূলের কোনও পোলিং এজেন্টকে মোসলেম বসতে দিতেন না বলে অভিযোগ ছিল। তৃণমূলের এও অভিযোগ ছিল, পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ অভিযোগ নিত না। উল্টে গ্রামছাড়া করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হত।

এই প্রভাবশালী মোসলেমরই শিষ্য ছিলেন শেখ শাহজাহান। অনেকে বলেন, মোসলেমের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলে শাহজাহান। পরবর্তী কালে মোসলেমের কাজ কারবার তিনিই দেখতেন। অনেকের মতে, কাজ বলতে ছিল, ভেড়ি দখল করা ও ভেড়ি থেকে তোলা আদায় করার কাজ।

সন্দেশখালি হল সুন্দরবনের একেবারে লাগোয়া অঞ্চল। এর দুটি ব্লকে ভেড়িতে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ চাষ হয়। শেখ শাহজাহানও ঘটনাচক্রে এখন জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ। কারণ, মাছের ব্যাপারটা তিনি ভাল বোঝেন বলে তাঁর দাবি।

সরবেড়িয়ার অনেক জমির মালিক নিজেরা মাছ চাষ করেন না। নিলাম করে জমি লিজ দেন। অভিযোগ হল, বাম জমানা থেকে মোসলেম-শাহজাহানরাই ঠিক করে দিতেন কবে কোন জমি নিলাম করা হবে এবং কারা সেই জমি পাবে। ক্রমে গোটা কারবার শাহজাহান তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।

২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে বসিরহাট লোকসভা আসনে হেরে যান বামেরা। কিন্তু তার পরেও মোসলেমের সৌজন্য সরবেড়িয়া পঞ্চায়েত বামেদের দখলেই ছিল। সেই জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন শাজাহানও। এমনকী ২০১১ সালে বাংলায় পরিবর্তনের ভোটেও সন্দেশখালির নাগাল পায়নি তৃণমূল। বরং শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরাই রিগিং, বুথ দখলের অভিযোগ তুলেছিলেন।

তবে সরকারে যেহেতু তৃণমূল ছিল, তাই বেশিদিন প্রতাপ ধরে রাখতে পারেননি শাহজাহান। ২০১৩ সালে তিনি জোড়ফুলে যোগ দেন। মোসলেম তার পরেও সিপিএমের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, মোসেলেমের বাহিনী ভেঙে চলে যাচ্ছে শাহজাহানের দিকে।

মোসলেমকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়তে শুরু করেন শাহজাহান। সন্দেশখালি ১ নম্বর ব্লকে শাহজাহান শুধু সভাপতি হন তা নয়, জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের আস্থাভাজন হওয়ায় তাঁর দাপট বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে শেষমেশ রণে ভঙ্গ দেন মোসলেম। শাহাজাহানের দলে নাম লেখান তাঁর একদা গুরু।

শাহজাহান তখন বাদশা। মোসলেম হলেন তাঁর শিষ্য। সন্দেশখালি-সরবেড়িয়ায় এই বাদশাহকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো এখন আপাতত কেউ নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here